দীর্ঘদিন চরম নির্যাতন সহ্য করার পর আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈলকে ফেরাউন ও তার জাতির কবল থেকে মুক্ত করেন। বনী ইসরাঈলের জন্য আল্লাহ তায়ালা লোহিত সাগরকে বিভক্ত করে মাঝে পথ করে দেন। হজরত মুসার (আ.) নেতৃত্বে বনী ইসরাঈল নিরাপদে লোহিত সাগর পার হয়। ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনী সমুদ্রে ডুবে ধ্বংস হয়।

লোহিত সাগর পার হয়ে ফিলিস্তিনে যাওয়ার পথে বনী ইসরাঈল এমন এক জাতির এলাকা অতিক্রম করে যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে বাছুরের পূজা করতো। তাদের বাছুর পূজা দেখে বনী ইসরাঈলের অজ্ঞ কিছু লোক হযরত মুসা (আ.) কে বললো, আমাদের জন্য তাদের মতো একটি ইলাহ বানিয়ে দিন। মুসা (আ.) বললেন, তোমরা এত অজ্ঞ কীভাবে হও! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ফেরাউনের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন আর এখন তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য ইলাহ চাও? তিনি তাদের সতর্ক করেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদত করতে নিষেধ করেন।

ইসরাঈলীরা যখন জর্দান সীমান্তের কাছাকাছি সিনাই উপত্যকায় পৌঁছায়। তখন আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈলের জন্য পূর্ণাঙ্গ একটি প্রত্যাদেশপত্র দেবেন বলে হযরত মুসা (আ.)-কে তুর পর্বতে ডেকে পাঠান। তিনি তার সম্প্রদায়ের ৭০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে তুর পর্বত অভিমুখে চলে যান। তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত বাকিদের এখানেই অবস্থান করতে বলেন। 

আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মুসা (আ.) নিজের ভাই হজরত হারুন (আ.)-কে বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব ও দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। 

ইসরাঈলিরা যখন মিসর থেকে পালিয়ে আসে তখন ইসরাঈলী নারীরা তাদের প্রতিবেশী মিসরীয় নারীদের কাছ থেকে এই বলে স্বর্ণালঙ্কার ধার নিয়ে আসে, ‘আমরা একটি ধর্মীয় উৎসব পালনে মিসরের বাইরে যাচ্ছি। উৎসব শেষ করে ফিরে এসে তোমাদের অলঙ্কার ফিরিয়ে দেবো’।

হজরত মুসা (আ.)-এর অনুপস্থিতিতে বনী ইসরাঈলের ‘সামেরি’ নামক এক ধূর্ত কামার চরম ধৃষ্টতামূলক এক কাজ করে বসে। সে সবার মাঝে বলতে থাকে, মিসরীয়দের কাছ থেকে চেয়ে আনা স্বর্ণ অপরের ধন। তাই তা তাদের জন্যে ব্যবহার অবৈধ, সেগুলো তাদের কাছ থেকে দূর করা আবশ্যক। তখন ইসরাঈলী মেয়েরা তাদের সঙ্গে আনা স্বর্ণালংকার নিয়ে এলো। সামেরি সেখানে অবস্থানরত হজরত হারুন (আ.)-কেও কৌশলে সেখানে উপস্থিত করলো।সমস্ত অলঙ্কার একত্রিত করে সেগুলো সামেরি একটা গর্তে ছুঁড়ে সেগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিল। 

হারুন (আ.) উপস্থিত লোকদের বললেন, ‘মুসা (আ.) ফিরে এসে এই স্বর্ণ সম্পর্কে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’ স্বর্ণ সেভাবেই জ্বলতে লাগলো। 

এ সময় সামেরি তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত হারুন (আ.)-কে দেখিয়ে বললো, ‘আমিও কি এগুলো নিক্ষেপ করবো?’ হারুন (আ.) মনে করলেন তার হাতেও হয়তো মিসরীয়দের অলঙ্কার রয়েছে, তাই তিনি তা নিক্ষেপ করতে আদেশ দিলেন।

সামেরি বললো, ‘আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক’ আপনি আমার জন্যে এ মর্মে দোয়া করলেই শুধু আমি নিক্ষেপ করবো, নয়তো নয়। আপনি আমার জন্য এমন দোয়া করুন!’ সামেরির কপটতা ও কুফর সম্পর্কে হারুন (আ.)-এর জানা ছিলো না। তাই তিনি দোয়া করলেন। তখন সে তার হাতের বস্তু আগুনে ছুঁড়ে ফেললো। 

মূলত তার হাতে কোনো অলঙ্কার ছিলো না, ছিলো হজরত জিবরাইল (আ.)-এর পায়ের নিচের মাটি। এর আগে সে এক বিস্ময়কর ঘটনা দেখেছিল- জিবরাঈল (আ.) যখন হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন তখন জিবরাঈল (আ.)- -এর বাহনের পা মাটিতে যেখানে পড়ে সেখানে তৎক্ষনাৎ ঘাস উৎপন্ন হয়। এতে সে বুঝে নিয়েছিলো এর পায়ের নিচের মাটিতে জীবনের স্পন্দন নিহিত আছে। কৌতূহলবশে সে ওই মাটির কিছুটা সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখেছিলো।

হারুন (আ.) যখন ওই স্থান পরিত্যাগ করলেন তখন সামেরি উপস্থিত অন্যান্যদের সহায়তায় ওই গলিত স্বর্ণ দিয়ে গো-বৎসের আকারে এক মূর্তি তৈরি করলো। আগুনে সামেরির নিক্ষিপ্ত জিবরাঈল (আ.)-এর অশ্বের পায়ের তলের মাটির কারণে এই মূর্তি জীবন্ত গরুর মতো আচরণ ও ডাকতে লাগলো। 

সামেরি তখন সেখানে উপস্থিত ইসরাঈলিদের বলতে লাগলো, ‘এ-ই হলো আসল খোদা। মুসা খোদার সাথে কথা বলতে তুর পাহাড়ে গেছেন, আর এদিকে ইনি সশরীরে এখানে এসে হাজির হয়েছেন।’

সামেরির এ কথা শুনে চরম অবাধ্য ইসরাঈলি ইহুদি সম্প্রদায় বিপুল উৎসাহের সাথে বাছুর পূজা করা শুরু করল। হজরত হারুন (আ.) তাদের নানাভাবে এই বাছুরের পূজা করতে নিষেধ করলেন, কিন্তু সীমালংঘনকারী ইহুদিরা বরং তাকেই অধার্মিক বলে গালমন্দ করতে লাগলো।

হজরত মুসা (আ.) তুর পর্বত থেকে সিনাই উপত্যকায় ফিরে নিজ সম্প্রদায়ের এমন অবাধ্যতা দেখে অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। এবং তাদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করেন। 

মুসা সামেরিকে বললেন, দূর হও, তোমার জন্য সারা জীবন এ শাস্তিই রইল যে তুমি বলবে, আমাকে স্পর্শ করো না এবং তোমার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিণতি অপেক্ষা করছে যার ব্যতিক্রম হবে না।

পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে, মূসা বলল, ‘হে সামেরী! তোমার কী অবস্থা’?  সে বলল, ‘আমি এমন কিছু দেখেছি যা ওরা দেখেনি। তারপর আমি দূতের (জিবরীলের) পায়ের চিহ্ন থেকে এক মুষ্টি মাটি নিয়েছিলাম। অতঃপর তা নিক্ষেপ করেছিলাম। আর আমার মন আমার জন্য এরূপ করাটা শোভন করেছিল’। 

মূসা বলল, ‘যাও, তোমার শাস্তি হল, জীবদ্দশায় তুমি বলতে থাকবে, ‘আমি অস্পৃশ্য’। আর তোমার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় রইল যার কখনো ব্যতিক্রম হবে না। আর তুমি তোমার ইলাহের প্রতি চেয়ে দেখ, যার পূজায় তুমি রত ছিলে, আমরা তা অবশ্যই জ্বালিয়ে দেব। তারপর বিক্ষিপ্ত করে তা সাগরে নিক্ষেপ করবই’।  (সুরা ত্বহা, আয়াত : ৯৫-৯৭)