বিশ্বের তিন ধর্মের কেন্দ্রভূমি ফিলিস্তিনের জেরুসালেম মুসলিমদের কাছে শুধু কোনো ঐতিহাসিক শহর নয়, এটি নবীদের স্মৃতি ধন্য, কোরআনে বর্ণিত বরকতময় ভূমি এবং ইসলামের প্রাচীন কিবলা। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর গভীর ভালোবাসা থেকেই মুসলিমদের হৃদয়ে জেরুসালেম আজও মহিমান্বিত।

বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে কাবার দিকে মুখ করে। কিন্তু অনেকেই জানেন না, ইসলামের শুরুর যুগে মুসলিমদের প্রথম কিবলা ছিল ফিলিস্তিনের জেরুসালেমের মসজিদুল আকসা। নবী করিম (সা.)-ও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এখানেই মুখ করে নামাজ আদায় করতেন। কোরআনে এই স্থানকে বরকতময় ভূমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

মসজিদুল আকসা শুধু মুসলিমদের কাছেই মর্যাদাপূর্ণ নয়; ইবরাহিম, সুলাইমান, মুসা ও ঈসা (আ.)-এর মতো আরও অনেক নবীর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে এই ভূমিতে। মুসলিমরা বিশ্বাস করেন, এক রাতে বুরাক নামের বিশেষ বাহনে চড়ে নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে জেরুসালেমে গিয়েছিলেন। সেখানে সব নবী তাকে অভ্যর্থনা জানান এবং তার নেতৃত্বে একসঙ্গে নামাজ আদায় করেন। ফলে আকসা মুসলিমদের কাছে শুধুই তৃতীয় পবিত্র মসজিদ নয়, বরং সব নবীর ঐতিহ্যকে একসূত্রে গাঁথা এক পবিত্র কেন্দ্র।

ইসলামের প্রথম দিকে আল আকসাকে মুসলিমদের কেবলা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আল্লাহর নির্দেশে কাবার দিকে কিবলা নির্ধারণ করা হয়। প্রথম দিকে আল আকসাকে মুসলিমদের কিবলা নির্ধারণের কারণ হলো যেন মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা নিজেদের যৌথ ঐতিহ্য ও বিশ্বাসকে স্মরণ করতে পারেন। 

আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

নবী করিম (সা.) অনেক হাদিসে মসজিদুল আকসার মর্যাদা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, এখানে এক ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব অন্য জায়গার পাঁচশ নামাজের সমান। যদি কারও সাধ্য থাকে তবে আকসা সফর করা উচিত; না পারলে অন্তত এর প্রদীপ জ্বালানোর জন্য তেল পাঠাতে হবে। অর্থাৎ দূর থেকেও এই মসজিদকে সমর্থন করতে হবে।

ইতিহাসে মুসলিমদের ভূমিকা

নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের কয়েক বছর পর খলিফা ওমর (রা.)-এর আমলে জেরুজালেম মুসলিমদের হাতে আসে। শহরে পৌঁছে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় চার্চ অব দ্য হলি সেপালকারে নামাজ পড়ার জন্য। কিন্তু তিনি নামাজ পড়েননি। কারণ আশঙ্কা ছিল, পরে মুসলিমরা হয়তো সেই চার্চকে মসজিদে রূপান্তর করতে চাইবে। সম্মান দেখিয়ে তিনি চার্চের পাশে নামাজ পড়েন, আর ওই স্থানে পরবর্তীতে তার নামেই একটি মসজিদ নির্মিত হয়।

ওমর (রা.) শহরের মানুষকে তাদের জীবন, সম্পদ, চার্চ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি অঙ্গীকারপত্র দেন। মুসলিম শাসনামলজুড়ে এই সম্মান বজায় রাখা হয়েছিল। 

সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ক্রুসেডের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরও হাজারো নাগরিককে মুক্তি দেন এবং ধর্মীয় স্থাপনাগুলো অক্ষত রাখেন। অটোমান আমলে ইহুদিরা প্রশাসনিক ভূমিকা পালন করেন, এমনকি কাঁদার প্রাচীরও সংস্কার করে ইহুদিদের উপাসনার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

জেরুসালেম শুধু ইতিহাস বা রাজনীতির শহর নয়। এটি মুসলিমদের আধ্যাত্মিক অনুভূতি, নবীদের প্রতি সম্মান এবং মানব সমাজের সহাবস্থানের প্রতীক। নবী মুহাম্মদ (সা.) যেমন এই ভূমিকে ভালোবেসেছিলেন, মুসলিমরা আজও তেমনই শ্রদ্ধা করে আসছে। কারণ, জেরুসালেম বহন করছে সেই ঐশী ঐতিহ্য, যেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নবীরা বসবাস করেছেন, ইবাদত করেছেন এবং মানবতার শিক্ষা দিয়েছেন।

এনটি