ছবি : এআই

কোরআন ও সুন্নাহতে নারী–পুরুষের সমান মর্যাদা এবং জনকল্যাণমূলক বিষয়ে অংশগ্রহণের নীতিগত ভিত্তি প্রদান করেছে। মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে নারীরা শুধু ঘরোয়া পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা হিসেবেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামের সূচনাকাল থেকে খিলাফত যুগ এবং মুসলিম সভ্যতার বিকাশকাল পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে নারীরা শাসকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন। এখানে ঐতিহাসিক কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো—

ইসলামের সূচনাকালে নারী পরামর্শদাতা

নবীজি মুহাম্মাদ (সা.)–এর যুগেই নারীদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও পরামর্শদানের সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা। সন্ধির শর্তে মানসিকভাবে ব্যথিত সাহাবাগণ নবীজি (সা.)–এর নির্দেশ (কোরবানি ও মাথা মুন্ডন) পালনে বিলম্ব করলে উম্মে সালামা (রা.) নবীজি (সা.)–কে পরামর্শ দেন, তিনি নিজে আগে তা সম্পাদন করলে সাহাবারা অনুসরণ করবেন। নবীজি (সা.) তার এই পরামর্শ গ্রহণ করেন। ফলে সংকট নিরসন হয় এবং মুসলিম সমাজে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এটি রাজনৈতিক সংকটে নারীর বিচক্ষণ পরামর্শ গ্রহণের একটি প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৭৩১)

অন্যদিকে হজরত আয়েশা (রা.) নবীজি সা.–এর ইন্তেকালের পরবর্তী যুগে জ্ঞানভিত্তিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি বিপুল সংখ্যক হাদিস বর্ণনার পাশাপাশি খলিফাগণের ফিকহি ও প্রশাসনিক বিষয়ে মতামত প্রদান করতেন। জামাল যুদ্ধে তার অংশগ্রহণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান, যা তৎকালীন খিলাফতের অভ্যন্তরীণ সংকটকে প্রতিফলিত করে। (ইবন হাজর আল-আসকালানি, আল-ইসাবা ফি তামইয়িজিস সাহাবা)

খিলাফত যুগে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে নারীর ভূমিকা

রাশিদুন খিলাফতের সময়েও নারীরা রাষ্ট্রীয় সংকটে নৈতিক ও রাজনৈতিক পরামর্শ প্রদান করেছেন। উম্মে সালামা (রা.) বিভিন্ন সময় খলিফা উসমান (রা.)–কে পরিস্থিতির গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে নসিহত করেছেন বলে ঐতিহাসিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। (ইবন সা‘দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা; আল-বালাজুরি, আনসাবুল আশরাফ)

খলিফা উসমান (রা.)–এর স্ত্রী নাইলা বিনত ফারাফিসা (রা.) রাজনৈতিক সংকটকালে মারওয়ান ইবন হাকামের প্রভাব সম্পর্কে আপত্তি জানান এবং খলিফাকে অধিক সতর্ক ও ন্যায়নিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহ দেন। তার এই ভূমিকা নারীর নৈতিক সাহস ও রাজনৈতিক সচেতনতার প্রতিফলন। (ইবনুল আছির, আল-কামিল ফিত তারিখ)

মুসলিম সভ্যতার উন্নতি ও সমৃদ্ধির যুগ

সিত্ত আল-মুলক (ফাতিমি যুগ) :

ফাতিমি খিলাফতের ইতিহাসে সিত্ত আল-মুলক ছিলেন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। আল-হাকিম বিআমরিল্লাহর অন্তর্ধানের পর তিনি ভাতিজা আল-জাহিরের রিজেন্ট হিসেবে কার্যত রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তার শাসনামলে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন, সামরিক বাহিনীর আনুগত্য নিশ্চিতকরণ এবং প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা হয়। মধ্যযুগীয় ইসলামী ইতিহাসে এটি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এক বিরল দৃষ্টান্ত। আল-হাকিমের নিখোঁজের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত। (আল-মাকরিজি, ইত্তি‘আজ আল-হুনাফা)

জুবাইদা বিনত জাফর (আব্বাসীয় যুগ) :

আব্বাসীয় খিলাফতের স্বর্ণ যুগে জুবাইদা বিনত জাফর দাতব্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। মক্কা–কুফা হজ রুটে জল সরবরাহ প্রকল্প (দারব জুবাইদা) তার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ। পাশাপাশি তিনি খলিফা হারুন আর-রশিদের সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখেন এবং পরবর্তীকালে গৃহযুদ্ধে পুত্র আল-আমিনকে রাজনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। (তারিখে তাবারি)

ইসলামী ইতিহাসে রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে নারীদের ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলাম নারীকে নৈতিকতা, জ্ঞান ও জনকল্যাণের ভিত্তিতে সামাজিক জীবনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে। পরবর্তী যুগে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে এই ভূমিকা সীমিত হলেও প্রারম্ভিক ও মধ্যযুগীয় দৃষ্টান্ত আজও গবেষণা ও অনুপ্রেরণার গুরুত্বপূর্ণ উৎস।