হজ ইসলামের মূল স্তম্ভগুলোর মধ্যে পঞ্চম। হজ মূলত কায়িক ও আর্থিক উভয়ের সমন্বিত একটি ইবাদত। তাই উভয় দিক থেকে সামর্থ্যবান মুসলিমের উপর হজ পালন করা ফরজ। অর্থাৎ হজ আদায়ে সক্ষম এমন শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচাপাতি ও আসবাবপত্রের অতিরিক্ত হজে যাওয়া-আসার ব্যয় এবং হজ আদায়কালীন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহে সক্ষম এমন সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর হজ আদায় করা ফরজ।

হজ আদায় ফরজ যেভাবে

হজ প্রত্যেক মুসলমানের উপর সারা জীবনে একবারই ফরজ হয়। একবার ফরজ হজ আদায়ের পর পরবর্তী হজগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে। এ সম্পর্কে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার রাসুল (সা.) আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বললেন, ‘হে মানবসকল! আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ করো। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! প্রতি বছর কি হজ করতে হবে? তিনি চুপ রইলেন এবং লোকটি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করল। অতপর রাসুল (সা.) বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে তা (প্রতি বছর হজ করা) ফরজ হয়ে যেত, কিন্তু তোমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হতো না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৩৭ (৪১২); মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১০৬০৭; সহিহ ইবনে হিববান, হাদিস : ৩৭০৪; সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস : ২৫০৮; সুনানে নাসায়ি : ৫/১১০; শরহে মুশকিলুল আছার, হাদিস : ১৪৭২; সুনানে দারাকুতনি : ২/২৮১)

ইবনে আববাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আরো বলা হয়েছে, ‘হজ (ফরজ) হল একবার, এরপরে যে অতিরিক্ত আদায় করবে তা নফল হিসেবে গণ্য।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৩০৪; সুনানে দারিমি, হাদিস : ১৭৮৮; সুনানে নাসায়ী ৫/১১; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৭২১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৮৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস : ৩২০৯)

হজ একবার ফরজ, পরে নফল

হজ যেহেতু একবারই ফরজ, তাই যার ওপর হজ ফরজ হয়েছে; সে যদি মৃত্যুর আগে যে কোনো বছর হজ আদায় করে, তবে তার ফরজ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু হজ বিধানের মৌলিক তাৎপর্য, তার যথার্থ দাবি ও আসল হুকুম হচ্ছে- হজ ফরজ হওয়ার সাথে সাথে আদায় করা। অপরাগতা ছাড়া বিলম্ব না করা। কারণ, বিনা ওজরে (অপরাগতা ছাড়া) বিলম্ব করাও গুনাহ।

আল্লাহ তাআলা ও তার রাসুল (সা.) ফরজ হজ আদায়ের প্রতি এমনভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন যে, কেউ যদি এই হজকে অস্বীকার করে বা এ বিষয়ে কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে মুক্ত ও হতভাগ্যরূপে বিবেচিত হবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭)

হজ আদায়ে কখনো বিলম্ব নয়

তাছাড়া যে কোনো ধরনের বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হওয়া বা মৃত্যুর ডাক এসে যাওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। তাই হজ ফরজ হওয়ার পর বিলম্ব করলে পরে সামর্থ্য হারিয়ে ফেললে বা মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাআলার নিকট অপরাধী হিসেবেই তাকে হাজির হতে হবে। এজন্যই হাদিস শরিফে হজ ফরজ হওয়ামাত্র আদায় করার তাগিদ ও হুকুম দেওয়া হয়েছে।

ইবনে আববাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা আদায় করে নেয়। কারণ যে কোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৮৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৮৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৭৩২; সুনানে দারিমি, হাদিস : ১৭৮৪; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস : ১৬৮৭; তাবারানি, হাদিস : ৭৩৮)

অন্য বর্ণনায় ইবনে আববাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ফরজ হজ আদায়ে তোমরা বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারও জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে ‘ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৮৬৭; সুনানে কুবরা বায়হাকি : ৪/৩৪০)

হজ আদায় না করলে যে গুনাহ ও শাস্তি

উপরন্তু একটি হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা যে স্বচ্ছল সামর্থ্যবান ব্যক্তি সত্ত্বর হজ আদায় করে না, তাকে হতভাগা ও বঞ্চিত আখ্যায়িত করেছেন।

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহ রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার শরীর সুস্থ রাখলাম, তার রিযিক ও আয়-উপার্জনে প্রশস্ততা দান করলাম। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি সে আমার গৃহের হজের উদ্দেশ্যে আগমন না করে, তবে সে হতভাগ্য, বঞ্চিত। (সহিহ ইবনে হিববান, হাদিস : ৩৬৯৫; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ১০৩১; তাবারানি, হাদিস : ৪৯০; সুনানে কুবরা বায়হাকি : ৫/২৬২; মাজমাউজ জাওয়াইদ, হাদিস : ৫২৫৯)

শুধু তাই নয়, একসময় বায়তুল্লাহ উঠিয়ে নেওয়া হলে মানুষ হজ করতে পারবে না; এই আশঙ্কার কারণেও আল্লাহর রাসুল (সা.) উম্মতকে তাড়াতাড়ি হজ করার হুকুম করেছেন। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা হজ ও উমরার মাধ্যমে এই (বায়তুল্লাহ) ঘরের উপকার গ্রহণ কর। কেননা তা ইতিপূর্বে দু’বার ধ্বংস হয়েছে। তৃতীয়বারের পর উঠিয়ে নেওয়া হবে।’ (সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস : ২৫০৬; সহিহ ইবনে হিববান, হাদিস : ৬৭১৮; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস : ১০৭২; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস : ১৬৫২)

হজ করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থ-বিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ করে না তার সম্পর্কে হাদিস শরিফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ করে না; তাহলে সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খৃস্টান হয়ে; তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৫৭৮)