ছবি : সংগৃহীত

আল্লাহর সৃষ্টি এই জগৎ কল্পনাতীত বিশাল। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, দিক-দিগান্ত জুড়ে কত দেশ, নগর, সভ্যতা ও কত রংবেরঙের মানুষ আছে— তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভ্রমণ মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। জ্ঞানের দুয়ার খোলে। ভ্রমণের মাধ্যমে ভিন্ন ভাষার ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে গসম্পর্কের সেতুবন্ধ গড়ে ওঠে।

ভ্রমণ আমাদের মন উদার করে, চোখ খুলে দেয়। চেনা জগতের ছোট পরিসর থেকে নিয়ে যায় বিশাল ময়দানে। আর এই জন্যই জাতিসংঘের অধীনে ১৯৮০ সাল থেকে সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখে সারা বিশ্বব্যাপী বিশ্ব পর্যটন দিবস পালিত হয়ে আসছে।

কোরআনে ভ্রমণের আদেশ

ইসলামে ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআনে তেরো বারের বেশি ভ্রমণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘তারা কি পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করেনি, যার ফলে তারা উপলব্ধিকারী হৃদয় ও শ্রবণকারী কানের অধিকারী হতো?’ (সুরা হজ : আয়াত : ৪৬)

এই আয়াতে আল্লাহ কোরআন বোঝার পূর্বশর্ত হিসাবে ভ্রমণের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর মহানত্ব অনুধাবনের জন্য ভ্রমণকে তিনি আবশ্যকীয় করেছেন।

কোরআনে অন্য জায়গায় আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে নবী) তাদের বলো— পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করো এবং দেখো তিনি কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেছেন, তারপর আল্লাহ‌ (এসবকে) আবার জীবন দান করবেন। অবশ্যই আল্লাহ‌ সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ২০)

ভ্রমণে নামাজের ক্ষেত্রে সহজতা

শুধু এতটুকুই নয়, ভ্রমণকারীর যেন ইবাদত-বন্দেগিতে কষ্ট না হয় এইজন্য ইসলামে ‘কসর’ বা চার রাকাআতের নামাজ দুই রাকাআত পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এবং রোজা না রেখে পরবর্তীতে কাজা করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এমনকি ভ্রমণকারী অর্থকষ্টে যেন না ভোগে, তাই তাকে জাকাত দেওয়ারও হুকুম করা হয়েছে। আর কোনো কাজে এতটা সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই কারণে অনেক ইসলামবিশেষজ্ঞ বলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে ভ্রমণ কেবল বৈধ নির্দেশ নয় বরং একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইবাদত। ভ্রমণ করা মুসলিমদের জন্য ওয়াজিব।

বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার সফরনামার অনুবাদক এইচ আর গিব লিখেন, মরক্কো থেকে চীন— এই পুরোটা পথ ভ্রমণে ইবনে বতুতা কোথাও ভ্রমণসংক্রান্ত ঝামেলায় পড়েননি। প্রত্যেকটা দেশেই মুসলিমরা তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তার খাতির-যত্ন করেছে, এর একমাত্র কারণ ছিল— ভ্রমণ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি।

ভ্রমণ যেন ভালো উদ্দেশ্যে হয়

মুসলিমরা জ্ঞান অন্বেষণে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর যেখানেই কোনো উপকারী জ্ঞান পেয়েছেন, তাকে ধারণ করে নিজ জাতির উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছেন। একই সাথে নিজেরাও ছড়িয়েছেন বিশ্বব্যাপী ইসলামের শান্তিময় বাণী ও সভ্যতা। এইজন্য খুব কম সংখ্যক সাহাবির কবর আরব ভূখণ্ডে পাওয়া যায়। আটলান্টিকের এই পার থেকে শুরু করে সুদূর চীনের নানান জায়গায় সাহাবিদের কবর। মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত তারা দ্বীন প্রচারের উদ্দেশে— ভ্রমণে ও সফরে কাটিয়েছেন।

ভ্রমণের পথ যেন চোর-ডাকাত থেকে মুক্ত থাকে, সেইজন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) তার শাসনব্যবস্থায় জোর তাগিদ দেন। পরবর্তী খলিফারাও সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। আদি ইবনে হাতিম তাই (রা) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মজলিসে বসা ছিলাম। তখন এক ব্যাক্তি এসে দুর্ভিক্ষের অভিযোগ করল। তারপর আরেক ব্যাক্তি এসে ডাকাতের উৎপাতের কথা বলে অনুযোগ করল। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে আদি, তুমি কি হিরা নামক অঞ্চলে গিয়েছ?’ আমি বললাম, না, যাইনি; তবে অঞ্চলটি সম্পর্কে জানি। তিনি বললেন, ‘তুমি যদি দীর্ঘজীবি হও তবে দেখতে পাবে— একজন উট সওয়ার হাওদানশিন নারী হিরা অঞ্চল থেকে রওয়ানা হয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করে যাবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও ভয় করবে না।...’ আদি (রা.) বলেন, আমি নিজে দেখেছি, এক উট সওয়ার নারী হিরা থেকে একাকী রওয়ানা হয়ে এসে কাবাঘর তাওয়াফ করে গেছে। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৪০)

ভ্রমণে সঙ্গী-সাথী নির্বাচন

আল্লাহর রাসুল (সা.) ভ্রমণে সঙ্গী-সাথীর সংখ্যা সম্পর্কেও নির্দেশনা দেন। বলেন, ‘একজন কিংবা দুইজন সঙ্গীর চেয়ে তিনজন সঙ্গী অধিক উত্তম। তিনজনের ভ্রমণকে কাফেলা বলা হয়। একজন কিংবা দুইজনের ওপর শয়তান প্রভাব বিস্তার করতে পারে, কিন্তু তিনজনের ওপর সম্ভব হয় না।’ (তিরমিজি : হাদিস : ১৫৯৮)

তিনি তিনজনের সফরে একজনকে দলনেতা নির্বাচন করতে বলেছেন। ইরশাদ করেন, ‘যখন একসঙ্গে তিনজন ভ্রমণে বের হবে, তখন একজনকে নেতা নিযুক্ত করবে।’ (আবু দাউদ : হাদিস : ২২৪১)

ভ্রমণ কেবল মানুষকে নতুন কিছু দেখায় না, নিজেকে ও সঙ্গী-সাথীদের চিনতে সাহায্য করে। ভ্রমণের কারণে মানুষ ধৈর্যশীল হয়, সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক আবু রায়হান মুহাম্মদ আলবেরুনি যখন ভারতে জ্ঞান অন্বেষণে আসেন, তখন এই অঞ্চলের মানুষের সংকীর্ণতা ও অহমিকা দেখে অবাক হয়ে যান। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন যে, এই অঞ্চলের মানুষ ভারতভূমির বাইরে কোথাও যান না।

ভারততত্ত্বের প্রথম অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন : ‘...বলতে গেলে কুৎসার মতো শোনাবে কিন্তু তা আসলে ওদের (ভারতবর্ষীয়দের) জাতীয় চরিত্রের একটি সর্বজনবিদিত বৈশিষ্ট্য; আর নির্বুদ্ধিতা এমন রোগ যার কোনো ঔষধ নাই। এ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : এরা বিশ্বাস করে যে পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র তাদের দেশই শ্রেষ্ঠ, মানবজাতির মধ্যে একমাত্র তারাই সর্বোত্তম, রাজাদের মধ্যে একমাত্র তাদের রাজারাই সর্বশ্রেষ্ঠ, ধর্মের মধ্যে একমাত্র তাদের ধর্মই শ্রেষ্ঠ এবং তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানই একমাত্র জ্ঞান। মূর্খের মতো নিজেকে ওরা বড় জাহির করে ওরা পরম পরিতৃপ্ত। জ্ঞান বিতরণে কার্পণ্য করা ওদের স্বভাব। ওদেরই মধ্যে যাদেরকে ওরা শিক্ষার অধিকারী মনে করে না তাদের থেকে জ্ঞানকে ওরা সাবধানতার সাথে রক্ষা করে। এ অবস্থায় বিদেশির কাছ থেকে সে জ্ঞান কত বেশি পরিমাণে রক্ষা করে তা সহজেই অনুমেয়। ওদের বিশ্বাস, ওদের দেশ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো দেশ নাই; ওরা ছাড়া আর কোনো মনুষ্য জাতি নাই এবং সৃষ্টিজীবদের মধ্যে ওরা ছাড়া আর কারোরই কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান নাই। ফলে, যদি খুরাসান বা পারস্যের কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি বিজ্ঞানের কথা ওদের বলে তাহলে ওরা তার কথায় বিশ্বাস করে না, নিজ অহমিকার বশে ওরা তাকে মিথ্যা মনে করে। ভারতীয়রা যদি বিদেশ ভ্রমণ করত এবং অন্য দেশের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করত তাহলে তাদের ওই ভ্রান্ত ধারণা দূর হতো।’

ভ্রমণের সবচেয়ে উপকারী দিক

ভ্রমণের সবচেয়ে উপকারী দিক হলো অভিজ্ঞতা। আমির মুআবিয়া (রা) বলেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া প্রজ্ঞাবান হওয়া যায় না। যদিও সাবধানতা গ্রহণ করা উচিৎ, তবু বলতে বলতে হয় ভ্রমণে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাথে পরিচিত হতে হয়, এরমধ্যে অনেক প্রতারকও থাকে, কখনো কখনো তাদের খপ্পরে পড়ে যেতে হয়, সেখান থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। হাদিসে আছে, আল্লাহর রসুল (স) বলেন, মুমিন এক গর্তে দুই বার দংশিত হয় না। (বুখারি, হাদিস : ২৫১৬) ইসলাম প্রতারিত হওয়াটাকেও শিক্ষায় রূপান্তর করতে বলে।

ভ্রমণের অনেক নিয়মকানুন আছে, অবস্থান বোঝে নিয়মকানুন ভিন্ন হয়, সেগুলো মান্য করা। বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করা। ভ্রমণে বের হওয়ার আগে আল্লাহর রসুল (স) এই দোয়া করতে বলেছেন— আল্লাহর নামে (বের হচ্ছি); আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো উপায় নেই; আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো শক্তিও নেই।’ (তিরমিজি ৫/৪৯০, হাদিস নং ৩৪২৬)

আল্লাহ আমাদের বেশি বেশি ভ্রমণ করার এবং ভ্রমণ থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন, আমিন।