ওয়াজ-মাহফিলে যেসব নিয়ম মেনে চলবেন। ছবি : সংগৃহীত

ওয়াজ-নসিহত বা উপদেশ মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এটি মানবসমাজের উন্নতি ও সংশোধনের অতুলনীয় পন্থা। ইসলামের শুরুলগ্ন থেকেই এর পবিত্র ধারা অদ্যাবধি চলে আসছে। এমনকি ইসলামপূর্ব যুগেও যুগে যুগে মনীষী ও পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে জনসাধারণের প্রতি ওয়াজ-নসিহতের বিষয়টি পাওয়া যায়।

কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর স্মরণ করো ওই সময়ের কথা, যখন লোকমান তার পুত্রকে ওয়াজ (উপদেশ) করতে গিয়ে বলল, হে পুত্র আমার! আল্লাহর সঙ্গে শরিক কোরো না, নিঃসন্দেহে শিরক মহা-অপরাধ।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৩)

ওয়াজ ও নসিহতের এ কল্যাণ ধারা রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের যুগ অতিক্রম করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত উম্মতের আলেমদের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে। যদিও যুগ, স্বভাব ও পরিবেশের পরিবর্তনে এতে ব্যবস্থাপনাগত কিছু বৈচিত্র্য এসেছে। তবে বর্তমান পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে এবং থাকাও অপরিহার্য। বর্তমানে তাতে কিছু বিচ্যুতি সত্ত্বেও এর মৌলিক গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। বর্তমানে উলামায়ে কিরাম ও দ্বিনি ভাইয়েরা যদি কিছু বিচ্যুতির সংশোধনের প্রতি খেয়াল করেন, তাহলে এর উপকারিতা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

কেমন আলোচক বা বক্তা নির্বাচন করবেন?

অবশ্যই সতর্ক হতে হবে যে বক্তা যেন হক্কানি আলেম তথা দ্বিনের সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন ও মুত্তাকি হয়ে থাকেন। অযোগ্য ব্যক্তির হাতে ইসলাহের কাজ সোপর্দ করা রাসুল (সা.)-এর বাণী অনুসারে কিয়ামতের নিদর্শন। ইসলামী আইন বিষয়ক বিশ্বকোষ ‘আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ওয়ায়েজ হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত আছে—
এক. ওয়ায়েজ ব্যক্তি বিবেকবান ও বালেগ হওয়া।
দুই. ন্যায়পরায়ণ হওয়া।
তিন. হাদিসের শব্দ, অর্থ, ব্যাখ্যা, বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা।
চার. কোরআনের তাফসিরকারক হওয়া। কোরআনের কঠিন থেকে কঠিন বিষয়গুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকা। আগের তাফসিরবিদদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা।’ (আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যা : ৪৪/৮১)

‘এলাকার লোক’, ‘সুললিত কণ্ঠের অধিকারী’, রেডিও-টিভির ভাষ্যকার’ ইত্যাদি বক্তা নির্বাচনের শরয়ি মানদণ্ড নয়। তবে হ্যাঁ, পরহেজগার ও হক্কানি আলেম হওয়ার পাশাপাশি এসব গুণ কারো মধ্যে থাকলে তাঁদের আমন্ত্রণ জানাতে কোনো অসুবিধা নেই। (আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা : ৪৪/৮১; ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া : ২/৩৬৭)

ওয়াজ ও আলোচনার বিষয় যেমন হওয়া চাই

ওয়াজ যেন দ্বিন ও শরিয়তের বিভিন্ন শাখা থেকে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হয়ে থাকে। অপ্রয়োজনীয় ও বেহুদা হাসি-মজাতে যেন সময় নষ্ট না হয়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ব্যক্তির (জীবনে) ইসলামের সৌন্দর্য হলো অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৭)

আরও পড়ুন : জাহান্নাম থেকে বাঁচতে যে ৫ আমল করবেন

জাল হাদিস ও জাল কাহিনিমুক্ত হওয়া

কোরআন, তাফসির, গ্রহণযোগ্য হাদিস এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের বাণী এবং সত্য ও শিক্ষণীয় ঘটনাবলির আলোকেই ওয়াজ করা অপরিহার্য। জাল হাদিস ও অসত্য কাহিনি বর্ণনা করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। যাচাই করা ছাড়া যেকোনো বই থেকে কোনো কথা বা ঘটনা পেয়েই বয়ান শুরু করবে না। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেমদের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করবে। জেনে-শুনে উপদেশস্বরূপ জাল হাদিস বর্ণনা করা কবিরা গুনাহ। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি জেনে-শুনে আমার নামে কোনো মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করে, সে মিথ্যাবাদীদের একজন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৬৬২)

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আমি যা বলিনি, এমন কথা আমার পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃত বর্ণনা করে, সে যেন জাহান্নামে তার স্থান বানিয়ে নেয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১০৭)

ওয়াজে যেন অপব্যয় না হয়

ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচে মধ্যপন্থা কাম্য। অপব্যয় থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে খরচ করবে না। জেনে রেখো, যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই, আর শয়তান নিজ প্রতিপালকের ঘোর অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৬-২৭)

ওয়াজের নামে রাত গভীর না হওয়া

গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ হলে সাধারণ মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত হওয়াসহ পরদিন ফজরের নামাজে ব্যাঘাত হবে। তাই গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ না হওয়াই কাম্য। এ বিষয়ে ‘রদ্দুল মুহতার’ নামক কিতাবে এসেছে, ‘এশার নামাজের আগে ঘুমানো এবং এর পরে কথা বলা হাদিস শরিফে নিষেধ করা হয়েছে।

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এশার পর কোনো কাজ নেই। কিন্তু মুসল্লির জন্য নামাজ আদায় আর মুসাফিরের জন্য সফর করা বৈধ।’ (রাদ্দুল মুহতার : ১/৩৬৮)

মাইক ব্যবহারে সতর্ক জরুরি

সভাস্থলে প্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহার কাম্য। দূর-দূরান্তে এবং বাজার-ঘাটে অপ্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহারে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। এতে শরিয়তবিরোধী অনেক কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়, যেমন—নামাজির নামাজে, ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুমে ব্যাঘাত হয়, অসুস্থ ব্যক্তির কষ্ট হয় এবং বিভিন্ন বৈধ কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাজে ব্যাঘাত হয়। আলেমরা মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত হয়—এমন জোরে কোরআন তিলাওয়াতও অবৈধ বলেছেন। (ফাতহুল কদির : ১/২৯৮, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ৩/৫৫২, জিকর ও ফিকির, পৃষ্ঠা ২৬)

হজরত ওমর (রা.)-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদ-ই-নববীতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করেন। এতে পাশেই হুজরায় অবস্থানরত আয়েশা (রা.)-এর কাজে ব্যাঘাত হতো। তাই তিনি হজরত ওমর (রা.)-কে বিষয়টি অবহিত করলে ওমর (রা.) ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে ওমর (রা.) এসে তাঁকে শাস্তি দেন। (আখবারু মাদিনা, ওমর ইবনে শাব্বাহ : ১/১৫)

মুফতি মাহমুদ হাসান।। ফতোয়া গবেষক ও শিক্ষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা।