সভা-মাহফিল ও অনুষ্ঠানের বাইরে আওয়াজ গেলে যে গুনাহ

রাজনৈতিক সভা, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রচারণা কিংবা ধর্মীয় ওয়াজ-আলোচনার সাউন্ড ও আওয়াজ মূল অনুষ্ঠানস্থলে সীমাবদ্ধ রাখা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কাজ। অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে মাইক লাগিয়ে অন্যদের শুনতে বাধ্য করা অন্যায়, অনৈতিক ও অযৌক্তিক। কারণ, এতে আপামর জনগণ কষ্ট পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

এর চেয়ে ভয়ানক কথা হলো- অতিরিক্ত সাউন্ড ব্যবহার করার মাধ্যমে ঘরে-বাড়িতে বা দোকানপাটে অবস্থানরত মানুষের কষ্ট হতে পারে। তাদের ওপর তো ওয়াজ শোনা ফরজ-ওয়াজিব নয়। তাদের মাঝে অনেকে অসুস্থ থাকতে পারে। আবার অনেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রয়েছে; তারাও ওয়াজ শুনতে আগ্রহী না— তাদের কষ্ট হবে। অথচ ইসলামের পরিষ্কার নির্দেশ হলো- রাসুল (সা.) বলেছেন, ‌‌‘যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে সেই প্রকৃত মুসলিম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১)

অতএব, বলার অপেক্ষা রাখে না যে— কাউকে কোনোরূপ কষ্ট দেওয়ার সুযোগ নেই। শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিমকেও অযথা কোনো রকম কষ্ট দেওয়া যাবে না। এমনকি কোনো জীব-জন্তুকেও কারণ ছাড়া কষ্ট দেওয়া নিষেধ।

সভা, অনুষ্ঠান ও মাহফিলে কি মাইক ব্যবহার করা যাবে?

সভাস্থলে প্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহার কাম্য। দূর-দূরান্তে ও বাজার-ঘাটে অপ্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহারে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। এতে শরিয়তবিরোধী অনেক কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়, যেমন- নামাজির নামাজে ও ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুমে ব্যাঘাত হয়, অসুস্থ ব্যক্তির কষ্ট হয়। বিভিন্ন বৈধ কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাজে ও মনোযোগে ব্যাঘাত হয়।

ফতোয়ার কিতাবে আছে, মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত হয়— এমন জোরে কোরআন তেলাওয়াতকেও ফিকাহবিদরা অবৈধ বলেছেন। (ফাতহুল কদির : ১/২৯৮; ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ৩/৫৫২; জিকর ও ফিকির, পৃষ্ঠা : ২৬)

উমর (রা.)-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদে-নববীতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করে, এতে পাশেই হুজরায় অবস্থানরত হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাজে ব্যাঘাত হতো, তাই তিনি উমর (রা.)-কে বিষয়টি অবহিত করলে ওমর (রা.) ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে ওমর (রা.) এসে তাকে শাস্তি দেন।’ (আখবারু মাদিনা : ১/১৫)

মাহফিলের আশপাশে যেভাবে মাইক ব্যবহার করবেন

ওয়াজ-মাহফিলে প্যান্ডেলের বাইরে মাইক ব্যবহার না করাই ভালো। কেউ করলেও বড়জোর রাত ০৯ বা ১০টা পর্যন্ত চালু থাকতে পারে; এর বেশি কোনোভাবেই উচিত নয়। কারণ, গভীর রাত পর্যন্ত বাইরের মাইক ব্যবহারের কারণে ঘুমন্ত মানুষ, শিশু, অসুস্থ লোক এবং বিশেষ করে এইচএসসি ও আলিম-সহ অন্যান্য পরিক্ষার্থী এবং অন্য ধর্মের অনুসারী; এমনকি মাহফিলের আশপাশের মানুষদের জরুরি প্রয়োজনে মোবাইলে কথাবার্তা বলাও কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।

কারও ক্ষতি করে, কাউকে কষ্ট দিয়ে এভাবে ইসলাম প্রচার কোনোভাবেই ইসলামে অনুমোদিত নয়। এমন অযৌক্তিক কাজে বহু সাধারণ মানুষ বরং ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবেন; বরং বলতে গেলে— হচ্ছেন।

কষ্টদায়ক আওয়াজে পড়া নিষেধ করেছেন রাসুল (সা.)

আল্লাহর রাসুল (সা.) মসজিদে ইতিকাফ-কালে সাহাবিদের উচ্চস্বরে ক্বিরাত পড়তে শুনে পর্দা সরিয়ে বললেন, ‘জেনে রাখো! তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় রবের সাথে চুপিসারে আলাপে রত আছো। কাজেই তোমরা পরস্পরকে কষ্ট দিও না এবং পরস্পরের সামনে ক্বিরাতে বা সালাতে আওয়াজ উঁচু করো না।’ (আবু দাউদ, সালাত অধ্যায়, হাদিস: ১৩৩২)

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তুমি প্রতি জুমায় লোকদের হাদিস শোনাবে। যদি এতে তুমি ক্লান্ত না হও তবে সপ্তাহে দুইবার। আরও অধিক করতে চাও তবে তিনবার। আরও অধিক নসিহত করে এই কোরআনের প্রতি মানুষের মনে বিরক্তি সৃষ্টি করো না। লোকেরা তাদের কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকা অবস্থায় তুমি তাদের কাছে এসে তাদের নির্দেশ দেবে, আমি যেন এমন হালাতে তোমাকে না পাই। কারণ এতে তাদের কথায় বিঘ্ন সৃষ্টি হবে এবং তারা বিরক্ত হবে। বরং তুমি এ সময় নীরব থাকবে। যদি তারা আগ্রহ নিয়ে তোমাকে নসিহত দিতে বলে তাহলে তুমি তাদের নসিহত দেবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩৩৭)

একটি হাদিসে এসেছে হযরত আয়েশা (রা.) মদিনার এক আলোচককে ওয়াজের আদব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘নিজের আওয়াজকে তাদের পর্যন্ত সীমিত রাখো যারা তোমার মজলিসে উপস্থিত। সেসময় পর্যন্ত কথা বলো যখন মানুষজনের দৃষ্টি তোমার দিকে থাকে, আগ্রহভরে কথা শুনে; বিরক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত...।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ১৯১)

প্রখ্যাত তাবেয়ি আতা ইবনে আবি রাবাহ (রহ.) বলেন, ‘আলেমের উচিত নিজের আওয়াজ মজলিস পর্যন্তই সীমিত রাখা।’ (আদাবুল ইমলা ওয়াল ইসতিমলা : পৃষ্ঠা : ০৫) 

কষ্ট দেওয়ার অনুমতে ইসলামে নেই

ওয়াজ-নসিহত ও দাওয়াতের এ আদব নবীজির আমল-আখলাক ও জীবনপদ্ধতি হতে গৃহীত। এ শিষ্টাচারই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। প্রসিদ্ধ ঘটনা। তিনি এক রাতে আবুবকর রা. এবং ওমর রা. এর বাড়ি যান। তাহাজ্জুদের নামাজে উমর (রা.) উচ্চৈঃস্বরে তেলাওয়াত করছিলেন। তাকে নির্দেশ দিলেন, আরেকটু আস্তে পড়। তদ্রূপ রাসুল (সা.) তাহাজ্জুদের জন্য শেষরাতে জাগ্রত হওয়ার সময় খুব সতর্কতার সাথে সজাগ হতেন, যেন স্ত্রীর কোনো কষ্ট না হয়। এ কারণেই ফুকাহায়ে কেরামের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হল, তাহাজ্জুদের নামাযে উঁচু আওয়াজে তেলাওয়াত করা নাজায়েজ— যদি মানুষের কষ্ট হয়। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া : খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ১০৩)

আরও পড়ুন : অফিসের কাজে অবহেলা করলে যে গুনাহ

বিশিষ্ট সাংবাদিক, সমাজচিন্তক ও ইসলামী গবেষক-আলোচক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী ‘ধর্মীয় কাজেও মাইক ব্যবহারে সংযম খুবই জরুরি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে লেখেন, মানুষের কষ্ট হয় এমন কোনো আয়োজন ইসলামি শরিয়ত কোনোদিন সমর্থন করেনি। ভবিষ্যতে কোনো দিন করবেও না। নবী করিম (সা.)-এর সুন্নত ও শরিয়তের জনকল্যাণমূলক নীতি এসব বিষয়ে পরিমিতি সংযম ও শান্তির পক্ষে। একজন হৃদরোগীর কষ্ট বিবেচনা করে, কয়েকজন পরীক্ষার্থীর অসুবিধা বিবেচনা করে সভা-অনুষ্ঠানে মাইকের নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার ইসলামের মৌলিক শিক্ষার মধ্যে পড়ে।

মাইক ব্যবহার নিয়ে শীর্ষ আলেমদের অসন্তোষ ও অভিমত

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী আরও লেখেন, ‘ইসলামে এমন বিধান রয়েছে, নামাজের জামাতে ইমাম সাহেব সবচেয়ে বয়স্ক ও দুর্বল ব্যক্তিটির প্রতি লক্ষ্য করে নামাজ আদায় করবেন। ইসলামে জোরে মাইক লাগিয়ে কোরআন শরিফ শবিনা পড়া আলেমরা সমর্থন করেন না। কারণ, কোরআন পড়ার সময় নীরবে মন লাগিয়ে তা শোনা শ্রোতাদের ওপর ওয়াজিব। নির্দিষ্ট জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে সমবেত মুসলমান ছাড়া দুনিয়ার নানা কাজে ব্যস্ত মুসলিমদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তাছাড়া সারারাত উচ্চশব্দে কোরআন পাঠ করলে তা কোনো রুগী, পরীক্ষার্থী, গবেষক, বৈধ সম্পর্কে লিপ্ত, বিষণ্ণ, নিদ্রামগ্ন, বৃদ্ধ, শিশু বা অন্য মানুষের জন্য ‘বিরক্তি বা বিব্রতকর’ হওয়া অসম্ভব নয়। ফলে তারা কেউ যদি কোরআনের বিরুদ্ধে কোনো অসতর্ক উক্তি করে বসে তাহলে তাদের যেমন গোনাহ হবে, ক্ষেত্রবিশেষ ইমানও নষ্ট হতে পারে। এমনিভাবে শরীয়তবিরোধী এমন উপস্থাপনার জন্য এর উদ্যোক্তারাও গুনাহের ভাগি হবেন।’

দেশের শীর্ষ আলেমদের প্রায় সবাই আমার সঙ্গে এপ্রসঙ্গে কথা বলার সময় ‘সারারাত মাহফিল’ ও ‘অতিরিক্ত মাইক’ নিয়ে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মসজিদ, হেফজখানা, মাদরাসা, স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকা বিবেচনা না করে গায়ের জোরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান-বাজনা, বিভিন্ন দিবস পালন করা এদেশে রেওয়াজ আছে বটে—তবে ধর্মের ব্যাপারে যেন এমন অসাবধানতা কেউ না করতে পারে, এ ব্যাপারে সমাজের সচেতন ব্যক্তি, ওলামায়ে কেরাম, ইমাম-খতিব সাহেবরা সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।’

বাংলাদেশে মাইকের ব্যবহার নিয়ে বহু আলেম যথেষ্ট আলোচনা করে থাকেন এবং কিতাবও লিখেছেন। এরপরও অনেক মানুষ ইলম-জ্ঞান না থাকার কারণে— মাইক ব্যবহারের ব্যাপারে শরিয়তের নির্দেশনা পালন করে না।