পাগলা মসজিদ যে কারণে বিখ্যাত

কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের হারুয়া এলাকা। নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। জনশ্রুতি আছে, মহাবীর ঈশা খানের অধস্তন পুরুষ দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিলকদর পাগলা দুনিয়াদারি ছেড়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় একাকী জীবনযাপন করতেন। ফলে তিনি মানুষের কাছে ‘পাগলা সাহেব’ বলে পরিচিত ছিলেন।

এই আধ্যাত্মিক পুরুষ খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে স্থিত হন এবং তাকে ঘিরে আশেপাশে অনেক ভক্তকূল সমবেত হন। তার ইবাদত-বন্দেগির জন্য দেওয়ান পরিবারের পক্ষ থেকে পাগলা সাহেবের নিজের পছন্দের স্থান নরসুন্দা নদীর মাঝখানে টিলার উপর একটি টিনের ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। ওই ঘরটি পরবর্তীতে ‘পাগলা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

পাগলা মসজিদ নামকরণের ব্যাপারে আরেকটি ঘটনা লোকমুখে প্রচলিত। সেটি হলো- হয়বতনগরের প্রতিষ্ঠাতাদের পরিবারের এক নিঃসন্তান বেগমকে জনগণ ‘পাগলা বিবি’ বলে ডাকত। দেওয়ানবাড়ির এ বেগম নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করলে ‘পাগলা বিবির মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়।

মসজিদের ইমরাত ও নির্মাণশৈলী খুবই সুন্দর এবং বেশ চমৎকার। 

আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদটির  বর্তমান জমির পরিমাণ ৩ একর ৮৮ শতাংশ। যা নির্মাণ কালে ছিলো কেবল ১০ শতাংশ জমির উপর। তিন তলা বিশিষ্ট পাগলা মসজিদের ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ এবং ৫ তলা ভবনের সমান একটি মিনার রয়েছে। প্রায় সহস্রাধিক মুসল্লির ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য রয়েছে পৃথক ব্যবস্থা।

পাগলা মসজিদের ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমৎকার। আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত পাগলা মসজিদটি নানা ধরণের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে খ্যাত।

বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাগলা মসজিদ সকল ধর্মের মানুষের কাছে এক সার্বজনীন পবিত্র ধর্মীয় কেন্দ্র। এই মসজিদে মানত কিংবা দান খয়রাত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়- এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন বয়সী হিন্দু-মুসলিমসহ নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ মানত নিয়ে এখানে আসেন । তারা নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ ও রুপার অলংকারের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি দান করেন। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার এ মসজিদে মানত নিয়ে আসা বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ঢল নামে। (প্রসঙ্গত এই ধরনের বিশ্বাস ও চিন্তা কুসংস্কারের অংশ ও শরিয়তবিরোধী।)

অধিক দান-খয়রাতের কারণে পাগলা মসজিদ ইতিমধ্যেই দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জানা যায় সাধারণত প্রতি চারমাস পরপর মসজিদের দানবাক্স খোলা হয়। নির্ভরযোগ্য তথ্যমতে প্রতিবার দানবাক্স খোলার পর অন্তত দেড়কোটি থেকে আড়াই কোটি টাকা পাওয়া যায়। এছাড়াও আরো পাওয়া যায় ডলার, ইউরো, সৌদি রিয়েল, ইয়েন, দিনারসহ ইত্যাদি বিদেশি মুদ্রা। এমনকি বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে এমনটাও হয়েছে।

এই মসজিদের আয়ের একটা অংশ  আশেপাশের অন্যান্য  মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা সহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামূলক খাতে ব্যয় করা হয়। এছাড়া ২০০২ সালে মসজিদের পাশে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ক্যান্সার, কিডনি রোগে আক্রান্ত দরিদ্র ব্যক্তিদেরও এই তহবিল থেকে সাহায্য দেয়া হয়। গতবছর করোনা চলাকালীন এই তহবিল থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক, যারা করোনা রোগীদের সেবায় কাজ করেছেন, তাদের অনুদান দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে লেকসিটি প্রকল্পের আওতায় পাগলা মসজিদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নরসুন্দা নদী খনন, দৃষ্টিনন্দন সেতু নির্মাণ, মসজিদের শোভাবর্ধন এবং রঙিন আলোকসজ্জার জন্য দিনে ও রাতে মসজিদটি দেখতে চমৎকার লাগে। দেশের দূরদূরান্ত থেকে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ মসজিদটি দেখতে ভিড় জমান। বিশেষত জুমার নামাজের সময় অত্যাধিক মানুষের সমাগমে মসজিদ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। মুসল্লিদের সুবিধার্থে মসজিদের পরিসর আরও বিস্তৃত করতে  মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্সের জন্য ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যা বাস্তবায়ন হলে ৫০ সহস্রাধিক মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারবেন।