সময়টা ৫ জানুয়ারি, ১৯৯২।

গোলগাল এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছেন এসসিজির মাঝখানে। সামনে বাইশ গজের একটা ক্রিজ, তার থেকে হাত দুয়েক দূরে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, জিঙ্ক ক্রিমে নাক ঢাকা, হাতে তার বল। এক হাত থেকে নিজের অন্য হাতে বল নিচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে- বিয়ারের বোতল  অথবা সিগারেটের প্যাকেটের সঙ্গে একটা পিজ্জা হাতেই তাকে বেশি মানাতো। অ্যাথলেট হিসেবে, জন ডলির সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক মাস আগেই এফজিএ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে এসেছেন যিনি।

ডিপ কাভারে তখন দাঁড়িয়ে আছেন ওই ছেলেটার রাজ্য ভিক্টোরিয়ানের আরেক ক্রিকেটার। তিনি ফিট ও অভিজ্ঞ। তরুণ বোলারটার কেবল অভিষেক, অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের জন্য সেটাই হয়ে থেকেছে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শেষ টেস্ট সিরিজ। ম্যাচেও তখন সময়টা ভালো যাচ্ছে না অস্ট্রেলিয়ার। ৪ উইকেট হারিয়ে ভারত ৩৯৭ রান করে ফেলেছে। সেঞ্চুরিকে ডালভাত বানিয়ে ফেলা শচীন টেন্ডুলকার আরও একবার সেই পথে। অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রবি শাস্ত্রী তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন বাউন্ডারির বন্যা বইয়ে দিয়ে।

তরুণ সেই লিগ স্পিনার এলেন। বলটা ভেতরে ঢুকালেন, শাস্ত্রীর জন্য স্পিনটা করল বাইরে বেড়িয়ে যাওয়ার দিকে। বলটা উড়িয়ে মারতে চাইলেন তিনি, কিন্তু ধরা পড়লেন ডিপ কাভারে। ভিক্টোরিয়ার অভিজ্ঞ ক্রিকেটারটি দৌড়ে গিয়ে ধরলেন ক্যাচ। তরুণ লেগ স্পিনার পেলেন নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম উইকেট। 

৩০ বছর পর। ডিন জোন্স ও শেন ওয়ার্ন দুজনেই মারা গেছেন দেশের বাইরে। বয়সটা পঞ্চাশের কাছাকাছি থাকতে। অপ্রত্যাশিতভাবে, বিস্মিত করে ও অকালে। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্ব যখন ওয়ার্নকে হারানোর শোকে মূহ্যমান- তখন তার খেলাটার প্রতি অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতাও জানানো উচিত সমানভাবে। 

সেই সময়টায়, রবি শাস্ত্রী যখন ২০৬ রান করে ওয়ার্নের বলে জোন্সের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন। তখন শুরু হয়েছিল অসাধারণ এক যাত্রার। একদম আলাদা কিছুরও। ওই উইকেট ছিল টেস্টে ৭০৮ জন ব্যাটসম্যানকে ফেরানোর প্রথম। যে চূড়া ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন কেবল মুত্তিয়া মুরালিধরণ। আর কারো এমন করে ছাড়িয়ে যেতে পারার সম্ভাবনাও ভীষণ কম। 

প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ৭০০ উইকেট নিয়েছিলেন ওয়ার্ন। একটা সময় যেটাকে মনে হতো অথই জল পাড়ি দিয়ে তলদেশ খুঁজে পাওয়ার মতো। কিন্তু তাও; শেক্সপিয়ারের বইয়ের সংখ্যা দিয়ে তাকে বিবেচনা করা ও ওয়ার্নকে পরিসংখ্যান দিয়ে, দুটো ব্যাপার একই রকম। ওয়ার্ন হচ্ছেন অল্প কয়েকজন মানুষের একজন, যারা নিজেদের বেছে নেওয়া শিল্পটাকে বদলে দিয়েছেন। যখন তিনি ক্রিকেটে আসেন, লেগ স্পিন মৃতপ্রায়। একা হাতে ওয়ার্ন বিপ্লব ঘটিয়েছেন এরপর, জনপ্রিয় করেছেন ও লেগ স্পিনকে বানিয়েছেন অস্ত্র। 

ওয়ার্নের হাতে লেগ স্পিন এমন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল, যেটা আগে দেখা যায়নি কখনো। যখন তিনি দাঁড়াতেন বল ছোঁড়ার আগে, ফিল্ডিংটা সাজিয়ে নিতেন, এক হাত থেকে বলটা ঘুরিয়ে নিয়ে যেতেন অন্য হাতে, নিজের ক্ষমতা দিয়ে ভয় ধরিয়ে দিতেন ব্যাটসম্যানের মনে; তখন সম্ভব ছিল যেকোনো কিছু। বিশ্বের সেরা ব্যাটারকেও বোল্ড করে সাজঘরের পথ দেখাতে পারতেন পায়ের অনেক দূরে বল ফেলে। 

তিনি যখন বল করবেন, আপনি শুধুই দেখতে পারবেন। হয়তো কখনোই ক্রিকেট দেখেননি, কোনো একটা কাজে ক্রিকেটটা আপনার দেখা দরকার। ওয়ার্ন বল করছেন, অবশ্যই উদ্দেশ্যে নিয়ে। আপনাকেও দেখতে হবে একইভাবে। ক্রিকেটের বাজিকর স্পিন বোলাররা। তাদের হাতে লুকিয়ে থাকে শিল্প। কিন্তু আপনি যত গভীরভাবেই ওয়ার্নকে দেখুন, তাতে কিছু যায়-আসে না। ওয়ার্ন যা কিছুই করেন, কীভাবে করেন কখনো খুঁজে বের করতে পারবেন না আপনি। আপনি শুধু আরাম করে ওয়ার্নকে উপভোগ করতে পারেন। এর চেয়ে বেশি কিচ্ছু না। 

অপরিমেয় স্কিলের সঙ্গে ওয়ার্নের মধ্যে ছিল কারিশমা ও অটুট আত্মবিশ্বাস। প্রতি বলেই উইকেট নিতে পারেন, এমন বিশ্বাস ছাড়া ওয়ার্ন কখনো বল ছুঁড়েননি। নিজের ওই বিশ্বাস তিনি সমর্থক ও প্রতিপক্ষের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারতেন। বিশ্বাস হচ্ছে না? ড্যারল কোলনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসুন। 

ওয়ার্ন বিশ্বাস করতেন, যেকোন জায়গায় থেকে ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারতেন। যখন কেউ বিশ্বাস করতো না সম্ভব, ওয়ার্ন করতেন। উদাহরণ দরকার? ২০০৬ অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টের পঞ্চম দিন। ১ উইকেট হারিয়ে ৯৭ রানে এগিয়ে ইংল্যান্ড; সেখান থেকে ম্যাচ জিতিয়ে দিতে ওয়ার্ন ছাড়া আর কে পারবেন?

অ্যাডিলেডের ওই জয়টা ওয়ার্নের বিশেষ মুহূর্তের লম্বা তালিকার একটা মাত্র। অবশ্যই, সবার তার বল অব দ্য সেঞ্চুরির কথা মনে আছে। ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্টে সেটাই ছিল ওয়ার্নের প্রথম বল, এটাও নিশ্চয়ই মনে আছে? ওয়ার্নের চেয়ে তাড়াতাড়ি কেউ নিজের পতাকা তুলে ধরতে পারেননি ক্রিকেট বিশ্বে। গ্যাটিংকে আউট করে ওয়ার্ন পেরেছিলেন সেটি। 

এরপর ১৯৯৪ সালে এমসিজিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক। ১২ বছর পর টেস্টে ৭০০তম উইকেট। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে আধিপত্য, ওই টুর্নামেন্টে টানা তিন বিশ্বকাপের সূচনা করেছিল অস্ট্রেলিয়া। অথবা ২০০৫ অ্যাশেজে হেরে যাওয়া দলে থেকেও ৪০ উইকেট নিয়ে নায়ক বনে যাওয়া। কীভাবে? ওই সিরিজে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট ছিল অ্যান্ড্র ফ্লিনটপের ২৪টি। 

ওয়ার্নের প্রভাবটা আরও অনেক বড়। তিনি ক্রিকেটটা শুরু করার পর, সব স্পিন বোলার তার ছায়া হতে চেয়েছেন। কিন্তু ওয়ার্নি তাদের জন্য লড়ে গেছেন সবসময়। ধারাভাষ্য দেওয়ার সময়, আবেগের সঙ্গে লড়েছেন স্পিনারদের পক্ষে। তাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার যেন করা হয়, এর পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। যদিও কোনো স্পিনারই ওয়ার্নের সমান প্রতিভাবান ছিলেন না- সত্যিকারার্থে সেটা সম্ভবও না। কিন্তু ওয়ার্ন বিশ্বাস করতেন, তাদের পক্ষেও প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলা সম্ভব। 

ক্রিকেটের বিশ্লেষক হিসেবে, ওয়ার্ন ছিলেন দুর্দান্ত। অস্ট্রেলিয়াকে ১১ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, টেস্টে পারেননি। তবে কখনো নেতৃত্ব না দেওয়া সেরা অজি অধিনায়ক হয়ে থেকেছেন এই ফরম্যাটে। ধারাভাষ্য দেওয়ার সময়, বারবার অনুমান করতে পেরেছেন এরপর কী হবে, টেকটিক বলেছেন, সবসময় খেলাটাকে পড়েছেন সঠিকভাবে। সবসময়ই এক পা এগিয়ে থেকেছেন। তিনি এসব করেছেন মাইক্রোফোন হাতে অথবা বিগ ব্যাশে বল করার সময়টাতেও। 

খেলাটাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে, এক পা এগিয়ে ভেবেছেন। নতুন ভাবনা নিয়ে এসেছেন। টি-টোয়েন্টির ভাবনাকে প্রমোট করেছেন। বছর দুয়েক আগে, জলবায়ু পরিবর্তনে পরিস্থিতি ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে হবে কীভাবে, সেই পরিকল্পনা বলেছেন। ফ্যাক্ট মেনেছেন, নিজের মাথাকে পুরোনো দিনের ভাবনায় কখনো নস্টালজিক করে রাখেননি। 

অবশ্যই, ওয়ার্ন পারফেক্ট হওয়া থেকে দূরে ছিলেন। অনেক অনেক দূরে। বিতর্ক সবসময় তার পেছনে লেগে ছিল। যখন প্রকাশ পেয়েছে ‘৯৮তে তিনি ও মার্ক ওয়াহ ভারতীয় বুকিকে পিচ ও আবহাওয়ার ধারণা দিয়েছিলেন; তখন তার সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। এরপর ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হয়ে পাওয়া এক বছরের নিষেধাজ্ঞা। 

যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন, ট্যাবলয়েডের হেডলাইন হয়েছেন, নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘোরের মধ্যে থেকেছেন। কেন? কারণ ওয়ার্ন শুধু ক্রিকেট তারকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন মহাতারকা। আমরা ভাবি পপ সংস্কৃতি মানে কেবল মিউজিক, সিনেমা ও টেলিভিশন, কিন্তু স্পোর্টসও তাই। আর ওয়ার্নি যেকোনো দিক থেকে পপ সংস্কৃতির আইকন। 

ওয়ার্নকে নিয়ে গান লেখা হয়েছে। লিজ হার্লির সঙ্গে তিনি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় টিভি শোতে উপস্থাপনা করেছেন। কমেডি শোতে ছদ্মবেশী হয়েছেন। প্রতিবেশীদের নিজেকে চিনিয়েছেন। মিক জ্যাগার, এলটন জন এবং এড শিরান জানিয়েছেন, ওয়ার্নের মৃত্যু তাদের কতটা বিস্মিত করেছে।

এর মধ্যেই, সমর্থকরা এমসিজিতে আসছেন। তার ভাস্কর্যের কাছে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। কেউ কেউ বিয়ারের বোতল ও সিগারেটের প্যাকেট রেখে যাচ্ছেন। ওয়ার্নের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ানদের সম্পর্কটা কেমন, এসবেই প্রমাণ মেলে। তার ভুলভান্তি অনেক। তিনি মেগাস্টারদের মতো। কিন্তু জাদুকরের চেহারাটা এখনও শহরতলির শিশুটার মতোই। অস্ট্রেলিয়ানরা তাকে উড়তে দেখছে, দেখেছে মাটিতেও। 

মিস্টার ক্রিকেট মাইক হাসি তার বইয়ে লিখেছেন, ২০০৫ সালে অভিষেক টেস্টে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। ভয়ে আছেন স্বাভাবিকভাবেই। শেন ওয়ার্ন ডেকে পাঠালেন তাকে, মুখে তার সিগারেট, বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিকে বললেন, ‘নিজের মতো থাকো।’

ওয়ার্ন ছিলেন অপ্রচলিত, রাতের রাস্তার মাস্তান। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, স্যার জক হবস, স্যার গ্যারি সোবার্স, স্যার ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে উইজডেন শতাব্দী সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের তালিকায় জায়গা পেয়েছেন তিনি। মনে রাখা দরকার, তিনিই এই তালিকার একমাত্র শুধুই বোলার। ক্রিকেট অনেকটাই ব্যাটারদের খেলা। এমনকি ওয়ার্ন আসার আগে থেকেই। প্রজন্মে একবার আসা ক্রিকেটার ওয়ার্ন নন, ওয়ার্ন ইতিহাসেই একবার আসেন। 

ওয়ার্নকে ছাড়া ক্রিকেট কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু জন লেননকে ছাড়া মিউজিক, প্রিন্সেস ডায়ানাকে ছাড়া রাজ পরিবার অথবা কোবি ব্রায়ান্টকে ছাড়া বাস্কেটবলকে কল্পনা করাও কঠিন ছিল। সত্যিকারের আইকনরা ক্ষত রেখে যান তাদের সমান পরিমাণ। তবুও পৃথিবীকে চলতে হয়। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট এগিয়ে যাচ্ছে রাউলপিণ্ডিতে। ওয়ার্ন আসার আগে ক্রিকেট ছিল, চলে যাওয়ার পরও থাকবে। কিন্তু কেউ কেউ আসেন এমন, নিজেদের অমোচনীয় ছাপ রেখে যান তারা। 

ওয়ার্ন ছিলেন ক্রিকেট জিনিয়াস। শব্দে ব্যাখা করে তার প্রতি সুবিচার করা সম্ভব না। ব্যাপারটা এমন, নেচে-গেয়ে উল্লাস করে বিজ্ঞানে আলবার্ট আইনস্টাইনের অবদান বুঝানো। আপনি যেটা করতে পারেন, বসে বসে একজন বিস্ময়কর মানুষের চলে যাওয়ার আফসোস। সৃষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানাতে পারেন চাইলে, একজন জিনিয়াসের কাজ দেখতে পারায়।

ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে ব্রাইডন কোভারডেলের লেখা থেকে অনূদিত

এমএইচ/এটি