রহস্য, রোমাঞ্চে নতুন মাত্রায় টেস্ট ক্রিকেট

ক্রিকেট, সাদা পোশাক, টেস্ট। বয়স ১৪৪ বছর। ডব্লিউ জি গ্রেস, ডন ব্র্যাডম্যান, শচীন টেন্ডুলকার কিংবা স্টিভেন স্মিথ। জেমস অ্যান্ডারসন অথবা প্যাট কামিন্স। আপনি কি রোমাঞ্চ অনুভব করছেন কোনো?

ব্যস্ততার সময়ে, দম ফেলার ফুসরত নেই যেখানে। এত এত বিনোদনের হাতছানি চারপাশে। মুভি, ওয়েব সিরিজ ও ইত্যাদি। অথবা আপনার প্রিয় খেলা ক্রিকেটও। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি অথবা হালের টি-টেন। অল্প সময়, বেশি চার-ছক্কার আনন্দ। তবুও আপনি কেন টেস্ট দেখবেন?

চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ, ২০২১

কাইল মেয়ার্স ভুগছিলেন বছর দুয়েক আগেও। সিপিএলে দল পাননি। জাতীয় দল তখনো বহুদূরের স্বপ্ন। কাইল মেয়ার্স খেলতে গেলেন ভিন্ন এক দেশে। সেটা যেতেই পারেন। অনেকেই যান। তবে কোন দেশে গেছেন, সেটা জানলে আপনাকে একটু চমকে যেতে হতে পারে।

মেয়ার্স গিয়েছিলে নরওয়েতে। নরওয়েজীয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলতে। ফাইনালে ম্যান অফ দা ম্যাচ হয়েছিলেন ওই টুর্নামেন্টে। এরপর ফিরে এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরোয়া ২০১৯-২০ মৌসুমে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেছেন। ৮ ম্যাচে ১৫ ইনিংসে ২ সেঞ্চুরি, ৫ ফিফটিতে ৫০.৩০ গড়ে করেছেন ৬৫৪ রান।

এরপর তাকে দলে নেয় বার্বাডোস ট্রাইডেন্টস। খুব একটা খারাপ করেননি। ৯ ম্যাচে করেছেন ২২২ রান। টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় নিউজিল্যান্ডে। বাংলাদেশে ওয়ানডেতে, টেস্টেও।

এরপর কী করলেন? সেটা জানে পুরো বিশ্ব। যে ব্যাটসম্যান দুই বছর আগেও সুযোগ পাচ্ছিলেন না নিজেদের লিগে, খেলতে গিয়েছিলেন নরওয়েতে। সেই তিনিই খেলে ফেলেছিলেন টেস্ট ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলোর একটি।

তাও বাংলাদেশের মাটিতে, পঞ্চম দিনে এসে। হঠাৎ লো হয়ে যাওয়া, বাউন্স করা অথবা টার্নিং একটা পিচে। মেয়ার্স মুগ্ধতা ছড়ান সাদা পোশাকের ক্রিকেটে। সঙ্গে কি ফিরিয়ে আনেন ট্স্টে ক্রিকেটের পুরোনো রোমাঞ্চটাকে?

ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া, ২০২১

ঋশভ পান্তের উইকেট কিপিংটা চোখে লাগার মতো। বাজে অবশ্যই। ক্যাচ ছাড়েন, স্ট্যাম্পিংও মিস করেন। তবুও তিনি থাকেন দলে। সমালোচনাকে সঙ্গী করে। ঋদ্ধিমান সাহার মতো উইকেট কিপারকে বেঞ্চে বসিয়ে। কেন থাকেন?

৩৬এর দুঃস্বপ্ন সঙ্গী অস্ট্রেলিয়ায়, অ্যাডিলেডে। দিশেহারা পথিকের আলোটুকু নিভে আসে ধীরে ধীরে। সবচেয়ে উজ্জ্বল যে তারা, সেই অধিনায়ক বিরাট কোহলি ফিরে আসেন দেশে। তার স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা, কোহলিকে থাকতে হবে এখানে।

কোহলি চলে আসেন, ইনজুরিতে পড়তে পড়তে কোহলিদের একাদশ সাজানো দায় হয়ে পড়ে একটা সময়। শার্দুল খেলেন, খেলেন নেট বোলার হিসেবে থাকা থাসারাঙ্গা নাটরাজান। খেলেন ঋষভ পন্তও। সিডনির দুঃস্বপ্ন ভুলিয়ে দেন সেই সিডনিতে। তৃতীয় টেস্টে এসে।

সেঞ্চুরি ছুঁতে ছুঁতেও পারেন না। ৯৭তে আটকে যান। তবে দলকে জিতিয়ে দেন। ভারতকে স্বপ্ন দেখান মিরাকেলের। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দ্বিতীয়বার টেস্ট সিরিজ জয়ের, দ্বিতীয় সারির দল নিয়ে।

সেই স্বপ্ন সত্যি করেন ব্রিসবেনে। জশ হ্যাজলউডকে চার মেরে। ভারত উচ্ছ্বাসে ভাসে। পূজারা তার মন্দির মানে ক্রিকেট পিচকে পূজা করে সেটা করতে সহায়তা করেন। রাহানে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে।

মোহাম্মদ সিরাজ বাবাকে হারিয়ে দেশে ফেরেন না, একটু সুযোগের আশায়। সেটা পান এক পর্যায়ে, ফাইফার নিয়ে দলকে জেতান। দেশে এসে জেয়ারত করেন বাবার কবরে। তার আগে তারা গড়েন ফেলেন এক রূপকথা।

৩৬ রানে অলআউট হয়ে যে নিন্দা ছিল চারপাশে, সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সেসব উড়ান ২-১ এ সিরিজ জিতে। এই যে এত লড়াই আর ত্যাগ, নিশ্চয়ই সাদা পোশাকের ক্রিকেটের রোমাঞ্চ ফিরিয়ে আনতে?

হেডিংলি, ইংল্যান্ড, ২০১৯

প্যাটিনসনের বল গিয়ে লাগল স্টুয়ার্ড ব্রডের পায়ে। শূন্য রানে তিনি সাজঘরে ফিরছেন বিষণ্ন মুখে। ইংল্যান্ডের জিততে হলে তখনো ৭৩ রান লাগবে। উইকেটে বেন স্টোকস ছিলেন আগে থেকে, এসেছেন জেক লিচ। তার ব্যাটিং পজিশন এগারো নম্বর। ইংল্যান্ডের জিততে হলে বাকি থাকা রান করতে হবে এই ওভারেই।

বেন স্টোকস বিশ্বকাপ ফাইনালে অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলে এসেছেন কয়েক দিন আগেই, খেলেছেন আগেও। তবে তিনি জানেন পথ কত কঠিন, জানে সবাই-ই। সবাই হয়তো বিশ্বাস করে পারা যাবে না, স্টোকস সেটা করেন না, লিচও।

তিনি চাপে পড়ে যান, চশমার সঙ্গে মুছে ফেলতে চান সেটা। আদতে পারেন না। দৌড় দেন এক রানের জন্য, স্টোকস তাকে ফিরিয়ে দেন। লিচ সাদা দাগ ছোঁয়ার আগেই দেখতে পান বল পৌঁছেছে লায়ন অবধি। একটু পরই সাক্ষী হন অবিশ্বাস্য কিছুর। লায়ন স্টাম্পটা ভাঙতে পারেননি!

অবিশ্বাস্যে ভেসে যায় সবার চোখ, অস্ট্রেলিয়ানদের হয়তো একটু বেশিই। গোবেচারা ভাব ধরে বসে থাকেন লিচ। এরপর চশমা মুছেন তিনি, বল খেলেন, খেলতে খেলতে ১৭টা। বাকি কাজ করেন স্টোকস। ২১৯ বলে ১৩৫ তার স্কোর।

ঘটিয়ে ফেলেন অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেন। হেডিংলি রূপকথা। এই যে লিচ চশমা মুছেন চাপে, ঘাম ঝড়িয়ে লড়ে যান স্টোকস। টেস্ট রোমাঞ্চ ফিরিয়ে আনার তাগিদেই তো?

ডারবান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০১৯

দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা। সিরিজের প্রথম টেস্ট। শেষ ইনিংসে লঙ্কানদের লক্ষ্য ৩০৪ রানের। ২০৬ রানে দনঞ্জয়ার বিদায়ের পর পরের বলেই লাকমল আউট। আম্বুলদেনিয়া ও রাজিথার বিদায়ে দেখতে দেখতে তা হয়ে যায় ৯ উইকেটে ২২৬।

শেষ উইকেট। কুশল পেরেরা ও ভিশুয়া ফার্নান্দো। কুশল খেললেন জীবনের জন্য। দাবি রাখলেন নিজের ইনিংসটি টেস্ট ইতিহাসের সেরা হওয়ার। ২০০ বলে খেললেন ১৫৩ রানের ইনিংস। অবিশ্বাস্যভাবে জেতালেন দলকে।

শেষ উইকেটে ৭৮ রান যোগ করলেন। টেস্ট ক্রিকেট দূরে থাক, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও চতুর্থ ইনিংসে শেষ উইকেটে এত রান করে জেতার কীর্তি নেই কোনো দলের। এতকিছু কি টেস্ট রোমাঞ্চ ফিরিয়ে আনার নেশায়?


-------

চারটা ভিন্ন দেশ, চারটা আলাদা ভেন্যু। আলাদা গল্প, আলাদা বীরত্ব। মেঘে মেঘে কালো হয়ে আসা আকাশে হঠাৎ তারা হয়ে ওঠার কাহিনী। সময়ের ব্যবধান বছর দুয়েক। টেস্টের অন্যতম সেরা চার ইনিংস। একটাই মিল থাকা জিনিস।

সাদা পোশাক আর লাল বলের লড়াই। ডব্লিউ জি গ্রেসদের যুগে যে ফরম্যাটে গোড়াপত্তন, সত্যিকারের ক্রিকেট বলে যার রব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যার আনন্দে কাটাতেন অগণিত মানুষ। তা ফ্যাকাশে হওয়ার আভাস গত দশকের শেষে। তবে সেই শঙ্কায় যারা ভুগছিলেন খুব, তাদের স্বস্তি দিতেই নায়ক হয়ে উঠেন কেউ কেউ। পূজারা পূজা করেন টেস্ট ক্রিকেটকে। কামিন্সরা মুগ্ধতা ছড়ান তাদের বোলিংয়ে।

কখনো গল্প লেখেন বেন স্টোকস, কখনো অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়েন কুশাল পেরেরা। জানান দেন টেস্ট ক্রিকেট টিকে থাকার। ডুবান ‘টেস্ট রোমাঞ্চের চোরাবালিতে’।

এমএইচ/এটি