কেমন যেন একটা মফস্বল মফস্বল গন্ধ এখানে। শহর পেরোতেই শান্ত, নিরিবিলি এলাকা। এক-দুই তলা ছোট ছোট বাড়িঘর। রাত হতেই দ্রুত সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ঘুমও ভাঙে সেই সকালে। তারপর ছুটির দুটি দিন বাদে সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিন রাজ্যের ব্যস্ততা।

সিডনি কিংসফোর্ড স্মিথ বিমানবন্দর থেকে শহরের পাঞ্চবৌল রোডে আসার পথে হঠাৎ থমকে গেলাম। চারপাশে জড়ো হয়ে রাস্তার পাশে আড্ডা চলছে। দোকানের সাইনবোর্ডে চোখ পড়তে আরও বিস্ময়— এ যে দেখি সব বাংলা নাম! কোথাও কারওয়ান বাজার, বঙ্গবাজার; কোথাও আবার দেশি ফুড, ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্ট, বাংলা ভিলেজ!

ট্যাক্সি চালক গাজীপুরের ছেলে শহীদ আমাদের বিস্ময় বুঝতে পেরে বললেন, ‘ভাই, এটা বাঙালি এরিয়া, নাম লাকেম্বা। এখানে শত শত বাঙালির বসবাস, সময় পেলে অবশ্যই এখানে আসবেন।’

বাংলাদেশ দল তখনও সিডনিতে আসেনি, সময়টা তো মিললই। বিদেশ বিভুঁইয়ে এরইমধ্যে পরম আপনজন হয়ে ওঠা মশিউর রহমান তুহিন ভাইকে বলতেই এক কথায় রাজি। সঙ্গে দারুণ একটা ব্যাপার হয়ে গেল- ভার্চুয়াল জগতে যার সঙ্গে এক যুগেরও বেশি সময় আগে পরিচয় সেই ফয়সাল কবীর শুভর নিমন্ত্রণ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে সিডনিতে পাড়ি জমানো শুভ, তারও ইচ্ছে এখানে ডিনার করতে করতে একটু আড্ডা দেওয়া।

এলিজাবেথ স্ট্রিটের হাইড পার্ক থেকে পাঞ্চবৌল আসার পথে নেমে পড়লাম আমি আর তুহিন ভাই। পরের সময়টুকু শুধু আনন্দ আর গর্বের সঙ্গী হওয়া।

সেই গল্পের আগে চলুন লাকেম্বা নিয়ে টুকটাক একটু জেনে নিই। এটি নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের শহর সিডনির একটি অঞ্চল। একদম বইয়ের ভাষায় পরিচয়টা এমন- ক্যান্টারবেরি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত লাকেম্বা। যেখানে শুধু বাঙালিই নয়, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাটা বেশি।

কেন লাকেম্বায় আসেন বাঙালিরা

নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে সিডনিতে এত জায়গা থাকতে এখানে কেন সবচেয়ে বেশি বাঙালির বসবাস? উত্তরটা মিলল স্থানীয় এক ব্যবসায়ী আবদুল হামিদের কথায়। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলছিলেন, ‘দেখুন, বছর পাঁচেক আগে একটা জরিপে দেখেছি, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাভাষীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫.৯ শতাংশ থাকেন সিডনির লাকেম্বায়। এখন সেটা আরও বেড়েছে। অনেকেই বলেন সেটা ৭ হাজারও হতে পারে। আসলে অনেকেই পেশাগত কারণে পুরো সিডনিজুড়ে দৌড়ান। লাকেম্বার ভৌগোলিক অবস্থানটা এখানে বেশ ইতিবাচক হিসেবে কাজ করে। এটি মাঝামাঝি হওয়ায় লোকে খুব সহজেই এখানে-সেখানে দৌড়াতে পারেন।’

লাকেম্বায় বাংলাদেশি দোকান-পাট শুরুর গল্পটা আরও পুরোনো। সেই ৯০ এর দশকে। এখানে এখন প্রায় ৯০ ভাগ দোকানের মালিক বাংলাদেশি। যেখানে তারা রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি, বুচার শপ, অ্যাকাউন্টিং ফার্মসহ অনেক কিছুই গড়ে তুলেছেন।

বাড়ি ভাড়া কিছুটা কম

বাংলাদেশ থেকে কেউ এসে সবকিছু টাকায় হিসাব করতে গেলে বিপাকেই পড়বেন। কিংবা অঙ্কটা এতই বড় যে পাগলও হয়ে যেতে পারেন! এখানে আয় যেমন খরচাও তেমন। আর বাড়ি ভাড়া আমাদের মতো মাসে একবার নয়, প্রতি সপ্তাহ কিংবা ১৫ দিন করে নেওয়া হয়! যেখানে অন্য এলাকার চেয়ে ভাড়া কম। আর এজন্যই অন্য অঞ্চলের চেয়ে লাকেম্বাকে বেছে নিয়েছেন অনেক বাংলাদেশি। তার মধ্যে ছাত্রদের সংখ্যাটা বেশি।

মাহবুবুর রহমান শুভ নামে এক পড়ুয়া লাকেম্বার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার ফাঁকে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আসলে এখানে পড়তে এসে টাকা-পয়সার হিসাবটাও মেলাতে হয়। সেটা করতে গিয়ে এই এলাকাটা বেশ রিজেনবল মনে হয়। তাছাড়া অনেক আগে থেকেই এখানে বাংলাদেশির সংখ্যাটা বেশি। এ কারণে আমরাও দেশের একটা ফ্লেভার পাব বলে এখানে থেকে যাই।’

স্থানীয় কিছু প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে ১৫ দিনের বাড়ি ভাড়া গড়ে প্রতি ইউনিট ৭০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার। তবে এমনটাও বলা হয়, এই এলাকাকে বাংলাদেশিরা অনেকটা সাময়িক ঘাঁটি হিসেবে নেন, বিশেষ করে ছাত্ররা। একপর্যায়ে পড়াশোনা শেষে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি মিললে চলে যান অন্য কোনো অঞ্চলে।

ধর্মপ্রাণদের মিলনমেলা

লাকেম্বার আশপাশে অনেকটা জায়গাজুড়েই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বেশি দেখা মেলে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর বড় অংশই বাংলাদেশি আর মুসলিম। ২০১৬ সালের সেনসাস রিপোর্ট বলছে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৭৮.২ শতাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ১৬.৩ শতাংশ হিন্দু। তবে কোনো ধর্ম মানেন না এমনও আছেন অনেকে। বাংলাভাষীদের ৩ শতাংশ কোনো ধর্মের অনুসারী নন! আর সেই জরিপ বলছে, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাভাষী মোট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫৪,৫৬৭ জন।

জানা যায়, এখানে লেবানিজ মুসলমানরা প্রথম থাকা শুরু করেন। তারপর হালাল খাবারের সন্ধান পাওয়া যায় এ কারণে অনেক মুসলমান আসতে শুরু করেন। এরপর এখানে বাঙালি রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠতে থাকল। এখন পুরো এলাকাজুড়ে সবই হালাল খাবারের দোকান। আছে মসজিদও, যেখানে শুধু নামাজ নয়, কেউ মারা গেলে জানাজাও হয়। করোনায় যখন সব থমকে দাঁড়িয়েছিল তখন এই লাকেম্বার মসজিদে উচ্চস্বরে আজানের অনুমতি দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া সরকার। প্রতি রমজানে এখানে ইফতার আর হালাল খাবারের একটা মিলনমেলা বসে।

সর্ষে-ইলিশ থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি

লাকেম্বায় সব মেলে, বাংলাদেশি আর বাঙালিরা যা খেতে চান। সর্ষে-ইলিশ থেকে শুরু করে শুটকি ভর্তা, বেগুন ভর্তা, ডাল কিংবা কাচ্চি বিরিয়ানি, মজাদার চা— সবকিছুই লাকেম্বায় আছে। কবজি ডুবিয়ে খেতে রেস্টুরেন্টে লম্বা লাইন পড়ে যায় সন্ধ্যা হতেই। আছে গ্রোসারির দোকানও, যেখানে দেখা যায় নানারকম বাংলাদেশি সবজিও। তবে এখানে ভোজনরসিকরা বেশি আসেন খাবার চেখে দেখতেই।

কেমন চলছে লাকেম্বার রেস্টুরেন্ট? প্রশ্নটা রেখেছিলাম এই অঞ্চলের ব্যস্ত রেস্টুরেন্ট ধানসিঁড়ির কর্ণধার জামাল হোসেনের কাছে। তিনি বলছিলেন, ‘এই এলাকাটা বাংলা টাউন নামে পরিচিত। এখানে সবাই বাংলাদেশি। তারাই এখানকার প্রাণ। আলহামদুলিল্লাহ, এখন সবমিলিয়ে ভালো চলছে। আমরা সততা রেখে কাজ করি বলে ঠিকঠাক মতো এগিয়ে যেতে পারছি।’

খালেদ নামে আরেকজন বলছিলেন, ‘আমরা সবাই মিলে লাকেম্বায় আড্ডা মারি। আবার আড্ডা শেষে খাওয়া-দাওয়া করে বাসায় ফিরি। বন্ধুরা সবাই মিলে এখানকার বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল খাবার খাই। বাংলাদেশে থাকতে যে খাবার খেতাম সবই এখানে পেয়ে যাই।’

লাকেম্বা ছাড়তে চান না তারা

এ যেন বাংলাদেশের বাইরে আরেক বাংলাদেশ। প্রাণ খুলে বাংলা বলা তো যায়ই, সঙ্গে থাকা-খাওয়া আর নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগিটাও করা যায়। হোমসিক যারা হয়ে ওঠেন তাদের জন্য তো লাকেম্বা এক কথায় স্বর্গ। দুধের স্বাদ কিছুটা হলেও ঘোলে মেটে! এখানকার রাস্তায় হাঁটলে এক মুহূর্তের জন্য মনে হতে পারে বাংলাদেশেই আছেন!

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের যুবক মশিউর রহমান তুহিন। যিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আছেন লাকেম্বা কিংবা এর আশপাশে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি। এরপর এই লাকেম্বাতে ১৩ বছর ধরে আছি। এই এলাকাটায় বাংলাদেশি সব সুযোগ-সুবিধা আমরা পাই। এখানে এলে মনেই হয় না বাংলাদেশের বাইরে আছি। সব সুযোগ-সুবিধা আছে। বাঙালিরা যা চায়, তাই এখানে পায়। কেউ যদি বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে আসে, তখন যদি পান খেতে চায় সেটাও এখানে মেলে। আসলে এই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা আমরা ভাবতেও পারি না!’

এরই নাম আসলে বাঙালির আবেগ। সেই আবেগের ঢেউ বদ্বীপ ছাড়িয়ে এই তাসমান সাগর পাড়েও আছড়ে পড়েছে। যেখানে একটু ভালোবাসা মেলে সেখানেই হয়ে যায় মায়ার ঠিকানা! তাই তো পাড়ার আড্ডা, খেলা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে টুকটাক তর্ক আর জিভে জল আনা সব খাবার, মসজিদে নামাজ পড়া আর ফেরার পথে গল্প— এ সবকিছুই লাকেম্বাকে আলাদা করে চিনিয়েছে!

রাত ৯টা ছাড়িয়েছে। বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র ফয়সাল কবীর শুভ, যিনি এই শহরে স্থায়ী হয়েছেন, তার গাড়িতে যখন ফিরছিলাম তখন শরীর-মনে অন্যরকম এক সুখের আবেশ...। কে যেন বলেছিল— দেশকে ভালোবাসতে হলে আগে দেশের বাইরে যেতে হবে। লাকেম্বার বাঙালিদের দেখে বুঝতে পারলাম, দেশপ্রেম আর দেশের মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা সেটি ভৌগোলিক সীমারেখা কখনো আটকাতে পারে না।

এটি/এসএসএইচ/জেএস