তাসমান পাড়ের গল্প
জল ও জীবন যেখানে এক সুতোয় গাঁথা
উত্তরে তিমুর সাগর, আরাফুরা সাগর ও টরেস প্রণালী। দক্ষিণে ব্যাস প্রণালী আর ভারত মহাসাগর। পূর্বে প্রবাল সাগর আর তাসমান সাগর। পশ্চিমে ভারত মহাসাগর। এভাবেই বইয়ের পাতায় আমরা জেনেছি অস্ট্রেলিয়াকে। জেনেছি- অস্ট্রেলিয়া পুরোপুরি মহাসাগর দিয়ে ঘেরা একটি রাষ্ট্র! জল ও জীবন এখানে এক সুতোয় গাঁথা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাভার করতে এসে অস্ট্রেলিয়ায় পা দিয়ে ভূগোল বইয়ের সেই লেখার সত্যতারই দেখা মিলল।
সমুদ্রের নোনা জলের টান তো বদ্বীপের মানুষের পুরোনো। তাইতো অজিদের দেশে পা রাখার আগেই পরিকল্পনা ছিল সমুদ্র জলে পা ভেজাবোই। কিন্তু কেউ যদি ভাবেন অস্ট্রেলিয়ার সবগুলো সমুদ্র সৈকতেই যাবেন-তবে সেটা এক জীবনে মিশন ইসপসিবলই। আপনাকে সমুদ্র সৈকত করেই কাটিয়ে দিতে পুরোটা জীবন!
বিজ্ঞাপন
ভাবছেন এ কেমন কথা? তাহলে আপনার জন্য ছোট্ট একটা তথ্য- ২৯,৪৪,৩০০ বর্গমাইলের অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে প্রায় ১২ হাজার সমুদ্র সৈকত! এবার একটু গণিত নিয়ে বসুন। সেই ১২০০০ সৈকতের একটি যদি আপনি প্রতিদিন দেখতে যান তবে সবগুলো দেখতে আপনার লাগবে কমপক্ষে ৩২ বছর! আর অস্ট্রেলিয়ার এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যের ভৌগলিক দূরত্ব নিয়ে যাদের ন্যুনতম ধারণা থাকলে বুঝতে পারবেন, ৬৪ বছরেও সবগুলো সৈকতে পা পড়বে না!
বিজ্ঞাপন
তবে বিশ্বকাপের মতো বড় আয়োজনে এসে সৈকতের পেছনে ছোটা মানে চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া। যতোদিন বাংলাদেশ দল টুর্নামেন্টে টিকে ছিল ততোদিন তো মাঠের ব্যস্ততাটাও ছিল বেশি। শহর দেখা আর পর্যটকের মতো ঘুরে বেড়ানোটা তো রথ দেখতে গিয়ে কলা বেচার মতো ব্যাপার! তারপরও বন্ডাই বিচে যাওয়ার আমন্ত্রণটা হেলায় হারালে বড্ড মিস হয়ে যেতো।
একদিন পরই ব্রিসবেনের পথে সিডনি ছাড়বো। তার আগে দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সাংবাদিক শামীম হামিদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম! সিডনি হারবার ব্রিজের পাশ থেকে থার্টিন ক্যাবে সোজা বন্ডাই বিচ। ব্যস্ত রাস্তা থেকে সমুদ্র সৈকতে চোখ পড়তেই মুগ্ধতার পালা শুরু। কাছে যেতেই সাদা বালির উপর আছড়ে পড়ছে ঢেউ। কেমন যেন একটা উৎসব লেগে আছে চারপাশে।
অস্ট্রেলিয়ায় এখনো অফিসিয়ালি গ্রীষ্ম আসেনি। বসন্ত চলছে। রোদটা সহনীয়। তাইতো, সূর্যস্নানের দৃশ্যটাও চোখে পড়ল। ১ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতটিতে আমার সবচেয়ে যেটি ভাল লাগল সাদা ঝকঝকে বালি। যা কিছুতেই পায়ে আটকে থাকছে না। সেদিন আকাশটাও ছিল পরিস্কার। সামনে চোখ যেতেই মনে হলো আকাশের নীলের সঙ্গে পানির রঙটা যেন একেবারে মিশে গেছে। পর্যটকের জন্য সেখানে কী নেই সেটাই হলো প্রশ্ন। একেবারে পিকনিক করার সব ব্যবস্থাই হাজির।
ইলেক্ট্রিক চুল্লিতে বার বি কিউ করার ব্যবস্থা চোখে পড়ল। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায় শুধু সমুদ্রসৈকতে কেন-প্রায় প্রতিটি পার্কেই দেখেছি বার বি কিউ করার ব্যবস্থাটা রাখা আছে। কেউ নীল জলে না নামতে চাইলেও তার জন্য সৈকতের শেষ মাথায় চোখে পড়ল সুইমিংপুল।
বাহারি খাবারের একটা রেস্টুরেন্টের দেখা মিলল, যেখানে সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। আশপাশের দৃশ্য দেখে অবশ্য সেই বেওয়াচ সিরিয়ালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
এমন সব দৃশ্য দেখে ভাবছিলাম-এই বন্ডাই বিচের চেয়েও সৌন্দর্যে ছাড়িয়ে যেতে পারতো কক্সবাজার। গর্ব করে আমরা প্রায়ই বলি এটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। কিন্তু সেই ১২০ কিলোমিটারে কী এমনটা আছে? পর্যটকদের শুধু প্রতি পায়ে পায়ে হয়রানি আর কিছু না। প্রাইভেসি তো নেইই সঙ্গে গলা কাটা অর্থের ব্যাপারটা তো আছেই। অথচ এটি ঠিকঠাক মতো পরিকল্পনা করে সাজাতে পারলে ‘দীর্ঘতম সৈকত’ এই তকমাতেই কক্সবাজারের নাম আটকে থাকতো না, বিশ্বের অন্যতম সেরা সৈকতও হয়ে যেতে পারতো।
অস্ট্রেলিয়ার একেক সৈকতের একেক রকম সৌন্দর্য। ব্রিসবেনের গোলকোস্ট ঘুরে এসে শামীম হামিদের চোখে মুখে ছিল রাজ্যের সন্তুষ্টি। বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা সিনিয়র এই সাংবাদিক বলছিলেন, আমার জীবনের একটা স্বপ্নপূরণ হয়েছে, আসার আগেই গোল্ড কোস্ট যাওয়ার একটা পরিকল্পনা করেছিলাম! ছবিতে ভিডিওতে এত কিছু দেখেছি যে অন্য রকমের মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিল, সমুদ্র সৈকত যে এত সুন্দর করে সাজানো যায় জানাই ছিল না! পর্যটক দিনভর এখানে ব্যস্ত থাকতে পারবেন, রাতের সমুদ্র সৈকত একটা অনন্য রূপ পেয়ে যায়। দেখে দেখে ভাবছি আমাদের কক্সবাজার কবে যে এমন হবে? এটি হতে পারতো বাংলাদেশের সবচেয়ে কর আয়ের উৎস!'
এই অস্ট্রেলিয়াতেই আছে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত নাইনটি মাইল বিচ। ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের জিপসল্যান্ডের সেই সৈকতে সারা বছরই লেগে থাকে পর্যটকদের ভীড়। তাদের জন্য থাকে ক্যাম্পিং, সার্ফিং, তিমি মাছ দেখা। বিরল প্রজাতির তিমি মাছকে বাঁচিয়ে রাখতে এখানে চেষ্টার শেষ নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই সমুদ্র সৈকতের বালি সোনালী রঙের। শীতের চেয়ে গ্রীষ্মেই এখানে লেগে যায় ভীড়!
তবে কক্সবাজারের মতো অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রের জল নয়। সেটি বন্ডাই বিচে দাঁড়িয়েই বুঝতে পেরেছি। এখানে সমুদ্রে সাঁতার কাটা চারটি কথা নয়। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ছাড়া কোথাও পানিতে নেমে ঠিক থাকার উপায় নেই। কারণটা অনেকেরই জানা- ঠাণ্ডা অ্যান্টার্কটিক স্রোতের ধারা নেমে আসায় গ্রীষ্মেও এখানে পানি থাকে বেশ ঠাণ্ডা। তাইতো দেখতে পেলাম সঙ্গীসহ অনেকেই অবকাশ যাপন করতে আসা বেশিরভাগই সমুদ্রের পানিতে দাঁড়িয়ে আছেন। কোমর ধরে দাঁড়িয়ে থেকে কেউ শীতে কাবু হয়ে ছুটে আসছেন বালির বুকে। শুরুতে অবশ্য ধরেই নিয়েছিলাম-অজিরা হয়তো সাঁতার জানে না। কিন্তু পরক্ষণেই একজন ভুল ভাঙিয়ে দিলেন ব্যাপারটা এমন নয়।
অস্ট্রেলিয়ানরা জাতিগতভাবেই পানি বেশ পছন্দ করেন। তাইতো সুযোগ পেলেই তারা ছুটে যায় সমুদ্রের ডাকে। অবশ্য চারপাশে যেদিকেই চোখ গেল দেখা মিলল যুগলের। বালির উপর স্বল্প পোশাকে রোদ্রস্নান করছেন কেউ। নির্ভার এক জীবন! ছুটির দিনগুলো কিভাবে কাটাতে হয় সেটা তাদের চেয়ে বেশি কেউ জানে না। সমুদ্র পাড়ের মানুষরা বুঝি এমনই হয়!
এটি/এনইউ