একটা সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট ছিল নিভু নিভু প্রদীপের মতো। মাঝেমধ্যে আলোর আভা দেখিয়ে ক্রিকেটাররা চমক সৃষ্টি করতেন। বড় তারকা ক্রিকেটারের অভাব ও দলীয় পারফরম্যান্স না থাকায় অনেকবারই তীরে এসে ডুবে যায় তরী। সে সময় ফুরিয়েছে। সেই আলো স্থায়ী করার পেছনে বড় কারিগর সাকিব আল হাসান। দেশীয় ক্রিকেটের পান্ডব কিংবা নক্ষত্র যাই বলা হোক না কেন; আজ তার ৩৬তম জন্মদিন।

১৯৮৭ সালের এই দিনে (২৪ মার্চ) মাগুরায় জন্মগ্রহণ করেন বিশ্ব ক্রিকেটের এই তারকা ক্রিকেটার। মাগুরার আলোকদিয়া মাঠ থেকে বিকেএসপি হয়ে মিরপুর মাঠ কাঁপিয়ে সাকিব এখন রাজত্ব করে চলেছেন লর্ডস, ইডেন-গার্ডেনসেও। 

সাকিব আল হাসানকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটা বই বলা চলে। নিশ্চয়ই সাকিবকে বই বলার বিষয়কে অনেকেই আদিখ্যেতা বলতে পারেন। চলুন সেই কারণও ব্যাখা করা যাক। আমরা যখন পড়াশোনা কিংবা জ্ঞান চর্চার চেষ্টা করি, তখন কিন্তু কোনো না কোনো বই থেকেই শেখার চেষ্টা করি। তেমনি বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাম্প্রতিক সময় বা এক যুগ আগেও এমন কোন ক্রিকেটার নেই, যিনি সাকিবের থেকে শিখতে চাননি।

উঠতি বয়সী ক্রিকেটার কিংবা দলে যেসব ক্রিকেটার রয়েছেন, তারা সবসময়ই সাকিবের কাছে নতুন কিছু শিখতে অধীর আগ্রহে বসে থাকেন। সেসব তরুণ ক্রিকেটারদের মাথায় সবসময় থাকে সাকিবের মতো তারকা হওয়ার লক্ষ্য। সাকিবের এক জীবনে এখন পর্যন্ত যত পাওয়া, তা নিয়েই তিনি কিংবদন্তীর কাতারে পৌঁছে গেছেন!

বিশ্ব ক্রিকেটে অলরাউন্ডারের তালিকায় বছরের পর বছর শীর্ষে থাকা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি সাকিব আল হাসান বলেই হয়তো সম্ভব। শহীদ আফ্রিদি থেকে জ্যাক ক্যালিস কিংবা যুবরাজ সিং তারা বড় তারকা হলেও, দীর্ঘ সময় রাজত্ব ছিল না তাদের। সেক্ষেত্রে সাকিব অনেক দুর্দান্ত। অবশ্য সেই সুপার হিরো ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে গেছেন। বয়সের ভারটাও নেহায়েত কম নয়, জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় ক্রিকেটে ব্যয় করেছেন বাংলাদেশের এই সুপারস্টার। 

সব মিলিয়ে হয়তো আর ২-৩ বছর ২২ গজে দেখা যাবে টাইগার ক্রিকেটারের। তারপরই ক্রিকেটকে সাকিব বিদায় বলে দেবেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট যদি একটা বঙ্গপোসাগর হয়ে থাকে, তবে সাকিবকে সেই সাগরের নীল বলা যায়! সাকিবের মতো একজন খেলোয়াড় প্রতিটি দেশের চাহিদার কেন্দ্রে থাকে। লোকে বলে সাকিবের মাথা এদেশের ক্রিকেট ব্রেইনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেরা সাইকোলজির দিক থেকে সাকিব পৃথিবীর অন্যতম সেরা ক্রিকেটারও।

একথা বলার নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। কেননা মাঠের বাইরের শত শত সমালোচনা সাকিব কিভাবে পেছনে ঠেলে সামনে এগিয়ে চলেন, তা ভাবনার বিষয়। তিনিও যে রক্তমাংসে গড়া মানুষ। অন্য ক্রিকেটার থেকে সাকিব এখানেই অনন্য, মাঠের বাইরের গল্প সাকিব মাঠে আনতে পছন্দ করেন না। ২২ গজের সাকিব তাই নিশ্চয়ই কোটি ভক্তের আইডল। সব সমালোচনাকে পেছনে ফেলে সাকিবের ছুটে চলার গতিতে যেন উসাইন (বোল্ট) ঝড়!

সাকিব আল হাসান সেই প্রেম, যা বারবার ফিরে আসে দুর্বার গতিতে। মাঠের বাইরের কারণে সাকিবকে ঘৃণা আপনি করতেই পারেন, তবে ক্রিকেটের সাকিবকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসাতে আপনি বাধ্য। সাকিবের জন্মদিনে তার জীবনের প্রথম কোচ মাগুরার সাদ্দাম হোসাইন গোর্কী জানিয়েছেন কিছু অজানা কথা। তিনি কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।

ছোটবেলা থেকেই বদমেজাজী স্বভাবের সাকিবের কথা শোনা যায়। কিন্তু গোর্কী বলছেন ভিন্ন কথা, ‘আমি কখনোই তাকে বদমেজাজী পাইনি বা দেখিনি। অন্যরা পেয়েছে কিনা তা বলতে পারব না। আমাদের সঙ্গে সে বদরাগীও না, কখনো খারাপ ব্যবহারও করেনি।’

শৈশবের কোচ গোর্কীর সঙ্গে সাকিব

প্রথম যেদিন সাকিবকে দেখেছিলেন সেদিন কী ভেবেছিলেন সাকিব বিশ্বসেরা হবে? গোর্কীর সোজা উত্তর, ‘না না। প্রথম দেখাতে ওরকম কিছু মনে হয়নি। প্রথমে মনে হয়েছে অন্য আর কয়েকজন খেলোয়াড়ের মতো। তবে সত্যি কথা বলতে ওর মধ্যে আলাদা একটা বিশেষত্ব ছিল। সেটি হচ্ছে- অন্যান্য ছেলেদের যে জিনিস বুঝতে সময় লাগত, সাকিবের সেটা অল্প সময়েই বুঝে নিত। ওর মধ্যে দ্রুত সবকিছু ধরার চেষ্টা ছিল। এটাই আলাদা করেছে ওকে। তবে ভাবিনি সাকিব যে এত বড় খেলোয়াড় হবে।’

সাকিবের এই শৈশবের কোচ আরও বলেন, ‘দেশের বাইরে গেলেও সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কথাও হয়। দেশের যেখানেই থাকে সাকিব যোগাযোগ করে।’

জন্মদিনে সাকিবের প্রতি গোর্কীর চাওয়া, ‘কোচ হিসেবে আমি সাকিবকে জন্মদিনের শুভকামনা জানাই। তার সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করি। সে যেন সুস্থ থেকে বাংলাদেশকে আরও সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেয়, এটাই তার কাছে আমার চাওয়া।’

এদিকে সাকিব আল হাসানকে বিশ্বক্রিকেটে গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন আরেক দেশীয় কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। বিকেএসপিতে ক্লাস সেভেনে থাকাকালীন সময় থেকেই তিনি সাকিবকে খুব কাছ থেকে দেখে আসছেন। যে কারণে সাকিব-সালাউদ্দিনের সম্পর্ক নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। সাকিবের গড়ে ওঠার পেছনে তার গুরু সালাউদ্দিনের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সেটি অনেকটা ভারতের শচীন টেন্ডুলকার আর রমাকান্ত আচরেকারের মতোই বলা যায়।

দিশেহারা শিষ্যের পথ খোঁজার ভূমিকায় থাকেন কোচ সালাউদ্দিন

পৃথিবীর যত বড় কোচের অধীনেই সাকিব খেলুক না কেন, সমস্যায় পড়লে সবার আগেই সাকিবের কাজ সালাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করা। ব্যাট গেরো লাগলে তা ছোটাতে সাকিবের যেন প্রিয় ‘স্যার’কে ছাড়া চলেই না। 

প্রিয় শিষ্য সাকিবের ৩৬তম জন্মদিনে ঢাকা পোস্টকে কোচ সালাউদ্দিন বলছিলেন, ‘প্রথমে দেখে তো আর বড় (তারকা) কিছু হওয়ার চিন্তা করা যায় না। তবে ও যখন আন্ডার সেভেনটিনে ওঠে, তখন আমি একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। যেখানে রাবিদ ইমামকে বলেছিলাম আগামী কয়েক বছর বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করবে দু’জন ক্রিকেটার। তাদের মধ্যে একজন মোহাম্মদ আশরাফুল (তখন দলে ছিল), আরেকজন সাকিব আল হাসান। যা সেই সময় নিউজ হয়েছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে সবাইকে দেখে তো একই রকম মনে হয়েছিল। যারা সবচেয়ে মেধাবী তারাই তো এখানে ভর্তি হতো। তবে সাকিবের মধ্যে আলাদা কিছু তো ছিলই।'

মাঠ এবং মাঠের বাইরে সর্বত্র সাকিবকে আইকনিক দেখতে চান সালাউদ্দিন, ‘আমি চাইব, সাকিব যেন বাংলাদেশের প্রত্যেকটা যুব সমাজের কাছে আইকনিক হিসেবে নিজেকে আরও মেলে ধরতে পারে। সেটা হোক খেলা কিংবা খেলার বাইরে, সবজায়গায়। তার জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা থাকল।’
সাকিবের প্রথম অধিনায়ক বাশার এখন নির্বাচকের ভূমিকায়

২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে যেদিন জাতীয় দলে সাকিব আল হাসানের অভিষেক হয়, তখন টাইগারদের অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন। বিসিবির বর্তমান এই নির্বাচক ঢাকা পোস্টের মাধ্যমে সাকিবকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘প্রথম দেখায় সাকিব বিশ্বসেরা হবে বলে মনে হয়নি। যদি কেউ বলে প্রথম দেখাই বুঝেছিলাম সে বিশ্বসেরা হবে তাহলে সেটা ভুল কথা। তবে তখন অবশ্য মনে হয়েছিল, অন্যদের চেয়ে সে একটু আলাদা। তার স্বভাব এবং মানসিকতাও তুলনামূলক ভিন্ন ছিল।’

সাকিবের ক্ষুরধার অধিনায়কত্ব নিয়ে বাশার বলেন, ‘সাকিবের মধ্যে প্রথম ট্যুরেই যেটা দেখেছিলাম সেটি ছিল খেলা সহজে বুঝতে বা পড়তে পারার ভালো দক্ষতা। তখনই সাকিবের ব্যাটসম্যানদেরও ভালো বোঝার ক্ষমতা ছিল। তখন তার অধিনায়কত্বের কোয়ালিটি কেমন, তা বোঝা যায়নি। তবে ওই বয়সের তুলনায় খেলোয়াড় রিড করার ক্ষমতাও ভালো ছিল।’

নির্বাচক হিসেবে নয়, সাকিবের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে তার জন্মদিনে বাশারের দাবি, ‘যত দূর সম্ভব খেলে যাও সাকিব। একটাই চাওয়া সুস্থ-সবল থেকে এভাবেই আমাদের মাঝে যেন সে থাকতে পারে। আশা করি তার ক্যারিয়ার আরও বড় হবে। অনেক শুভকামনা থাকল সাকিবের জন্য।’

শুধু কোচ কিংবা সাবেক-বর্তমান সতীর্থই নন; সাকিবকে ভালোবাসেন দেশের আপামর জনগণও। দেশের নানা প্রান্তের মানুষ সাকিবকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। বার্তা পাচ্ছেন দেশের বাইরের ক্রিকেট ভক্তদেরও। তিনি তো এমন ভালোবাসারই যোগ্য। কারণ তিনি যে সাকিব আল হাসান, দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারা; জ্বলজ্বল করতে থাকা বড় নক্ষত্রও বটে!

এসএইচ/এএইচএস