করোনা মহামারির পর যখন তাসকিন আহমেদ মাঠে ফেরেন, তখন অন্য এক তাসকিনকে দেখা যায়। শরীরী ভাষা, মাইন্ড সেট-আপ সবকিছুতেই ছিল পরিবর্তনের ছোঁয়া। আর তার এই পরিবর্তনের পেছনে বড় অবদান মাইন্ড ট্রেনার সাবিত রায়হানের। এই ট্রেনার কাজ করেছেন সাব্বির রহমান, সৌম্য সরকার, এনামুল হক বিজয়ের সঙ্গেও। তাসকিনের পরিবর্তন দেখে পরবর্তীতে দেশের আরো বেশ কিছু তারকা ক্রিকেটারও এই মাইন্ড ট্রেনারের শরণাপন্ন হয়েছেন।

জানা গেছে, তাসকিন আহমেদ ২০১৮ সাল থেকে এই মাইন্ড ট্রেনারের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এরপর সাবিত রায়হানের অধীনে প্রশিক্ষণ শুরু করেন নুরুল হাসান সোহান, লিটন দাস, নাজমুল হোসেন শান্ত, মেহেদী হাসান মিরাজ ও মোস্তাফিজুর রহমান। মনে করা হচ্ছে, তার শিক্ষা ক্রিকেটারদের পরবর্তী পারফরম্যান্সে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। 

জাতীয় দলের বর্তমান ও বাইরে থাকা ক্রিকেটারদের মানসিক দিক বদলে দেওয়ার রূপকার সেই সাবিত রায়হানের মুখোমুখি হয়েছে ঢাকা পোস্ট। তিনি শুনিয়েছেন তাসকিনের সঙ্গে পথ চলার গল্প। বিসিবিতে সুযোগ আসলে তিনি কাজ করবেন কিনা সেই উত্তরও দিয়েছেন। পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হল...

তাসকিনের সঙ্গে আপনার শুরুর গল্পটা কেমন ছিল?
সাবিত রায়হান : শুরুটা ২০১৮ সালে। বিপিএলের আগে যখন তাসকিন দলে ছিল না, তখন তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় এবং কাজ করা শুরু। সেই ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। মাইন্ড-ট্রেনিং সে প্রতিনিয়ত নিয়ে থাকে। একইসঙ্গে ফিটনেস ট্রেনিং, স্কিল ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি মাইন্ড-ট্রেনিং চালু রাখে।

অন্য ক্রিকেটাররা কি তাসকিনের দেখাদেখি আপনার কাছে আসে?
সাবিত রায়হান : না, আসলে ক্রিকেটারদের সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল না। তাসকিন যখন ভালো পারফর্ম করে, তখন অন্যরাও আগ্রহী হয় আরকি। এভাবেই আসে এবং অনেক খেলোয়াড় আছে যাদের তাসকিনই রেফার করেছে। যেমন- শান্ত, লিটন, সোহান, সৌম্য সবাইকে তাসকিন রেফার করেছে যে, তোমরা কথা বলো কাজ করো।

অনেকের সাথে কাজ করেছেন, এর মধ্যে কাকে মানসিকভাবে শক্তিশালী মনে হয়েছে?
সাবিত রায়হান : মানসিকভাবে তারা যেহেতু জাতীয় দলের খেলোয়াড়; সবাই অবশ্যই ভালো এবং শক্তিশালী। যদি কেউ আলাদাভাবে নির্দিষ্ট করে সমস্যা ফেস করে, আমার কাজ সেখান থেকে শুরু। কোথাও কঠিন মনে হলে সেখানে কাজ করা, কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় ফোকাস বা কনফিডেন্ট বাড়ানো লাগবে। সেটিকে কেন্দ্র করে কাজ করা হয়। সবার ক্ষেত্রে কাজের ধরন আলাদা। তবে আলাদা করে কে শক্তিশালি এই কম্পেয়ার আমি করি না। প্রত্যেকের নিজস্ব জায়গায় নিজের একটা যোগ্যতা তো আছে। প্রত্যেকের নিজস্ব স্বকীয়তা থাকে, আইডেনটিটি থাকে যে যার মতো।

আপনার কাছে কী জাদুর কাঠি রয়েছে, যিনি আসেন তিনিই বদলে যান?
সাবিত রায়হান : আমি অবশ্য জাদুর কাঠি বিশ্বাস করি না, এমন কিছু থাকতে পারে। মানুষের যোগ্যতা ভেতরেই থাকে, কেউ নিজে নিজে সেটা বের করে আনতে পারে, আর কারোর সাপোর্ট দরকার হয়। পাশে থেকে সাপোর্ট করার ওই কাজটা আমি করি। খেলোয়াড়দের নিজেদের ভেতরই ভালো স্কিল আছে। আমি খেলোয়াড়দের খেলা শেখাই না। তাদের আরেকটু ভালো খেলার জন্য মানসিকভাবে সাহায্য করি। বিষয়টা এমন যে তারা শারীরিকভাবে ফিট ও ভালো, মানসিক দিকটা উন্নতির জন্য যা দরকার আমি  তাদের সঙ্গে তা শেয়ার করি।

মাইন্ড ট্রেইনিংয়ের পাশাপাশি আর কোন জিনিসটা তাসকিনের পারফর্ম করার ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে?
সাবিত রায়হান : আমার কাছে মনে হয় বোলিং স্কিল বাড়ানোর জন্য সে বোলিং কোচদের সঙ্গে আলাদা কাজ করেছে। শুরু থেকেই মাহবুব আলি জাকি স্যারের সঙ্গে কাজ করেছে। এরপর ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য দেবাশীষ দাদার সঙ্গে কাজ করেছে। তবে আমার কাছে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ কাছে মনে হয়, সেটি হচ্ছে তাসকিনের ধাবাহিকতা। দুয়েকদিন-মাস কাজ করে ছেড়ে দেয়নি, ২০১৮ থেকেই নিজের কাজে সেই ধারাবাহিক ছিল। তার মতো যদি ধারাবাহিক ও ডিসিপ্লিনড হওয়া যায়, তাহলে সফলতা আসবে। এই কারণে তাসকিনকে অন্য অনেকের জন্য উদাহরণ বলা যায়।

খারাপ সময়ে শান্ত-লিটনরা ট্রল ও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেটা থেকে ফেরার পথটা কেমন ছিল?
সাবিত রায়হান : অনবরত ট্রল, সমালোচনা ও গালি শুনে কেউ মানসিকভাবে ভালো থাকার কথা নয়। কেউ পরিবার ও যোগ্যতা নিয়ে কথা বলতে থাকলে যে কারও জন্য মেনে নেওয়া কঠিন। একজন মানুষ হিসেবে তাদের তখন কষ্ট পাওয়ারই কথা। এই জায়গায় মাইন্ড সেটআপ ঠিক রাখতে আমাদের ট্রেনিংয়ে কাজ করেছি। এজন্য বিভিন্ন টুলস-টেকনিক ও কৌশলের প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে এর চেয়েও বড় বিষয় হলো, যেখানে ফোকাস এনার্জিও সেখানেই কাজ করবে। কে কী বলছে সেটার থেকে খেলায় আমরা ফোকাস করেছি বেশি। সেগুলো বাদ দিয়ে আমরা খেলায় মন দিই। এই কাজেও বিভিন্ন রকমের স্ট্র্যাটেজি আছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করেছি। আমি পুরো ক্রেডিট অবশ্য শান্ত এবং লিটনকেই দিব। কারণ তারা এটা কাজে লাগিয়ে সবসময় সিরিয়াস ছিল। বাইরে থেকে অনেকে না জেনে অনেককিছু বললেও, তারা শক্ত ছিল। অনেক কষ্টের মধ্যেও কাজ করে গেছে দু’জনই। এখন তার রেজাল্টই পাচ্ছে, মাশা-আল্লাহ।

বিসিবি থেকে কখনও মাইন্ড ট্রেনিংয়ের প্রস্তাব পেলে আপনার অবস্থান কী হবে?
সাবিত রায়হান : দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে যদি আমার কনট্রিবিউশনের জায়গা থাকে, সেটা আমি এখনও করছি। বিসিবির পক্ষ হতে আমার জন্য বড় সাপোর্ট এটাই যে আমি সবার সঙ্গে কাজ করতে পারি। এজন্য তাদের পক্ষ থেকে আমার কোনো বাধা নেই। এমনও হয়েছে যে টুর্নামেন্ট চলাকালীন সময়েও কাজ করেছি। আমার মনে হয়না আর আলাদা করে বিসিবির কেউ হওয়া লাগবে। যদি দলের পক্ষ থেকেই করতাম সেটাও এভাবেই করতাম। তবে বিসিবির পক্ষ থেকে যদি আমাকে চাইলে অবশ্যই আমি চেষ্টা করব, ক্রিকেটের জন্য কিছু করতে।

এসএইচ/এএইচএস