ব্যাটে অনুজ্জ্বল সৌম্য, পথ বাতলে দিলেন দুই কোচ
সৌম্য সরকারের নামটা আসলে সবার আগেই মনে পড়ে মার-কাটারি ক্রিকেটের কথা। ব্যাটিং স্টাইল ও মোহনীয় শটে সহজেই তিনি ক্রিকেটভ্ক্তদের নজর কেড়েছিলেন। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই স্ট্রাইকরেটে বাড়তি নজর দিয়ে ব্যাট করেছেন বাঁ-হাতি এই ব্যাটার। ২০১৫ সালে ঘরের মাটিতে ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে সৌম্য নিজের সামর্থ্যের কথা জানান দিয়েছিলেন। সেই সৌম্যে নজরকাড়া শট আর চোখে পড়ে না। যেন নিজের ছায়া হয়েই ২২ গজে নামছেন এই টাইগার ক্রিকেটার।
২০১৫ সাল ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য একটি স্মরণীয় বছর। সেবার একের পর এক পরাশক্তির বিপক্ষে টাইগাররা সিরিজ জয় করে। ওই বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষের সিরিজ জয়ে বড় অবদান রাখেন সৌম্য। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ৯০ এবং অপরাজিত ৮৮ রানের ইনিংস দুটি তার ক্যারিয়ারের অন্যতম। অবশ্য তার এমন ফর্মের স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র কয়েক বছর। যদিও এরপর ২০১৭’র চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপেও জাতীয় দলে খেলেছিলেন সাতক্ষীরার এই ক্রিকেটার। তবে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে এসে পুরোদস্তুর ছন্নছাড়া হতে থাকে সৌম্যর ব্যাট। একপর্যায়ে তার ব্যাট যেন হাসতে ভুলে যায়!
বিজ্ঞাপন
গত দেড় বছরে সৌম্যের ব্যাটে ধারাবাহিকতা তো দূরে থাক, বলার মতো রান পেয়েছেন হাতেগোনা কয়েকবার। নিজের নামের প্রতি তিনি মোটেই সুবিচার করতে পারছেন না। বর্তমানে যেন সৌম্যর জন্য নিয়মিত রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্র্যাকটিস করা, মাঠে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে আবারও প্র্যাকটিসে নামা। তবুও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তার। ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর, ২০২২ আসরেও এই ওপেনার আটকে আছেন রানখরার বৃত্তে।
জাতীয় দলে সৌম্য সরকারের সর্বশেষ ব্যাটিং পরিসংখ্যান দেখলে কতটা অফফর্মে রয়েছেন তিনি, তার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ২০২১ সালে ২ টেস্ট খেলে মোটে ৩৮ রান করেন তিনি। একই বছর ৪টি ওয়ানডে খেলে করেছেন কেবল ৪০ রান। এরপর সেই ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টিতে ১৬ ম্যাচ খেলে করেছেন ২৫১ রান। গত বছর জাতীয় দলের হয়ে ৬টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন সৌম্য, সেখানেও তার পুঁজি মাত্র ৭৬। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এমন নিষ্প্রভ হয়েই যে মাঠ ছেড়েছেন, এরপর আর জাতীয় দলে সৌম্যের সুযোগ পাওয়া কঠিনই বটে!
বিজ্ঞাপন
সেই ব্যর্থতা চলছে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ বিপিএল কিংবা ডিপিএলেও। চলমান ডিপিএলে সৌম্য খেলছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। এখন পর্যন্ত দলটির হয়ে ১১ ম্যাচে তিনি মাঠে নেমেছেন। সেখানে ১০ ইনিংসে ব্যাট করে তার সংগ্রহ মোটে ১৯১ রান। ৭৯ স্ট্রাইকরেটের সঙ্গে ম্যাচপ্রতি তার গড় মাত্র ১৯। এর আগে চলতি বছরের শুরুতে বিপিএলেও সৌম্য মাঠে নামেন ঢাকা ডমিনেটরসের হয়ে। এই টুর্নামেন্টেজুড়ে ১২ ম্যাচে ক্রিজে নামলেও ১৪.৫০ গড়ে সৌম্য ১৭৪ রান করেন।
আরও পড়ুন >> অন্ধকার কাটছে না সৌম্যের ব্যাটে!
সৌম্যের ব্যাটে ঠিক কী কারণে এমন দুর্দশার চিত্র ধরা দিচ্ছে? দেশের নামী দুই কোচের কাছে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্ট। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের দুই পরিচিত কোচ মিজানুর রহমান বাবুল এবং রাজিন সালেহ সৌম্যের এমন হতশ্রী পারফরম্যান্স নিয়ে কথা বলেছেন। বাতলে দিয়েছেন তার প্রতিকারও।
সৌম্যের ধারাবাহিক হতশ্রী ব্যাটিংকে হতাশাজনক উল্লেখ করে বাবুল বলেন, ‘এটি অবশ্যই হাতাশাজনক! আমরা ধরে নিয়েছিলাম সে আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের খেলোয়াড়। লিটনদেরও আগের ব্যাচের সে। ওর এখন ডমিনেট করার কথা, সেখানে সে উল্টো পথে রয়েছে; অনেক নিচে নেমে গেছে। তার মতো ক্রিকেটারদের পেছনে ক্রিকেট বোর্ড কিংবা কোচদের অনেক ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে।’
শুরুতে কোচ বাবুল বলছেন, ‘অনেকদিন হয়ে গেলো সৌম্য পারফরম্যান্স করতে পারছে না। আমার কাছে মনে হয় হয়তো কিছুটা টেকনিক্যাল সমস্যা আছে। তবে তাকে এখন কাছ থেকে দেখি না অনেকদিন হলো, আসলে দেখাই হয়না। কিছু তো টেকনিক্যাল ইস্যু আছেই, নইলে রেগুলার রান করতে পারবে না এমন তো হয় না।’
চলতি ডিপিএলে ভিন্ন ভিন্ন পজিশনে খেলেছেন সৌম্য, কিন্তু কাজের কাজটা কিছু না হওয়ার বিষয়টিকে হতাশাজনক উল্লেখ করে বাবুল বলেন, ‘এটি অবশ্যই হাতাশাজনক! আমরা ধরে নিয়েছিলাম সে আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের খেলোয়াড়। লিটনদেরও আগের ব্যাচের সে। ওর এখন ডমিনেট করার কথা, সেখানে সে উল্টো পথে রয়েছে; অনেক নিচে নেমে গেছে। তার মতো ক্রিকেটারদের পেছনে ক্রিকেট বোর্ড কিংবা কোচদের অনেক ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে।’
বাবুল আরো বলেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৯ দলের একজন ক্রিকেটার বানাতে কিন্তু অনেক খরচ। সৌম্য তেমনই এক ক্রিকেটার, যার এখন নিয়মিত জাতীয় দলে খেলার কথা। তবে বিভিন্ন কারণে হোক সে পারফর্ম করছে না। এই জায়গায় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সাব্বিরের কথাও বলা যায়, এই টাইপের খেলোয়াড় জাতীয় দলে ডমিনেট করার কথা। কিন্তু নতুনরা এসে ওদের জায়গাটা নিয়ে নিচ্ছে।’
এই অবস্থা থেকে সৌম্যের ফিরে আসার উপায় সম্পর্কে এই কোচ জানান, ‘সৌম্য রান করতে চাচ্ছে, কিন্তু হচ্ছে না। পরিশ্রমের সঙ্গে অনেক কাজও করছে। যেহেতু এখন ডিপিএল চলছে, কিছু করার নেই। সে যদি অফ সিজনে যারা কোচ আছেন, ভালো বোঝেন তাদের সঙ্গে কাজ করে; আমার মনে হয়না তার বেশি সময় লাগবে। কারণ সে রান করতে জানে। আমার মনে হয়, তার মধ্যে কোনো অলসতা নেই। সে যথেষ্ট কাজ করে আমি দেখি। তবে কিছুটা টেকনিক্যাল ইস্যু আছে।’
রাজিন সালেহ’র মতে ওভার কোচিংয়ের কারণে ন্যাচারাল খেলা ভুলতে বসেছেন সৌম্য, ‘আমার মনে হয় এটা ওভার কোচিংয়ের কারণে এরকম হতে পারে। এটা না করে যদি তার স্বভাবজাত বা ন্যাচারাল খেলা নিয়ে টেকনিক্যালি কাজ করা হয়, তাহলে ওর জন্য ভালো হবে। একজন কোচ হিসেবে এটা আমার মতামত আরকি।’
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে সফল কোচদের একজন রাজিন সালেহ। সৌম্যকে নিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘সে পারফর্ম করছে না যে কয়েক বছর হলো, এর মধ্যে একটা কারণ হতে পারে ওভার কোচিং। তার প্রতি বিভিন্নভাবে কোচিংটা মনে হয় বেশি হয়ে যাচ্ছে। সে হয়তো কয়েকজন কোচের কথা অনুসরণ করছে। আমার মতে সে যদি যেকোনো একজনকে টেকনিক্যালি ফলো করে, তাহলে ভালো হবে। কেননা তাকে নিয়ে বিভিন্নভাবে ঘাটাঘাটি হচ্ছে। ওর ন্যাচারাল যে খেলা বিগত দিনে খেলেছিল, তা দেখা যাচ্ছে না; বন্ধ হয়ে গেছে।’
রাজিনের মতে ওভার কোচিংয়ের কারণে ন্যাচারাল খেলা ভুলতে বসেছেন সৌম্য, ‘আমার মনে হয় এটা ওভার কোচিংয়ের কারণে এরকম হতে পারে। এটা না করে যদি তার স্বভাবজাত বা ন্যাচারাল খেলা নিয়ে টেকনিক্যালি কাজ করা হয়, তাহলে ওর জন্য ভালো হবে। একজন কোচ হিসেবে এটা আমার মতামত আরকি।’
ম্যাচের বাইরে অনুশীলনে তো কমতি রাখছে না সৌম্য তাহলে কি বলবেন, ‘আমি বলতে চাচ্ছি যদি সে একা প্র্যাকটিস করে তাহলে....বলা যেতে পারে এটা বাবা-মা ছাড়া সন্তানদের মতো। সন্তানরা একা একা ভালোভাবে চলতে পারে কম। এজন্য কোনো গাইড ছাড়া যদি প্র্যাকটিস করেন, তাহলে কিন্তু ভুলটা কম বুঝবে। এ কারণে যেকোনো একজন কোচকে নিয়ে কাজ করা ভালো। তাহলে যাকে ওর পছন্দ হয় বা ভালো লাগে এবং মানসিক শান্তি পায় সেই কোচের সঙ্গেই কাজ করুক। এতে প্রতিকারটা তাড়াতাড়ি হবে। নইলে তার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
সাবেক এই টাইগার ব্যাটার আরও বলেন, ‘সৌম্যকেই বেছে নিতে হবে, কোন কোচ দ্বারা তার উপকার হবে। বিশেষ করে সিনিয়র ক্রিকেটাররা যেমনটা করে, এটাই বেটার হবে। ভারতের বড় বড় খেলোয়াড়রাও তাদের ছোটবেলার কোচের কাছে চলে যায়, ফর্মহীন হয়ে পড়লে। আমার মনে হয় সৌম্যের এটা বুঝে কাজ করলে ভালো হবে।’
এসএইচ/এএইচএস