ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব
বিকেএসপি : কোচরা অবহেলিত, তিন যুগেও নেই ট্রেইনার-অ্যানালিস্ট
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু। ৩৮ বছর পার হলেও বিকেএসপি কাঙ্ক্ষিত ‘এক্সিলেন্স ইন স্পোর্টস’ হতে পারেনি। ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের বিকেএসপির ‘ক্রীড়ায় শ্রেষ্ঠত্ব’ অর্জন করতে না পারার বিষয়ে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো আজ। যেখানে উঠে এসেছে কোচ ও কোচিংয়ের নানা সমস্যার কথা।
২০ বছরেও নেই পদোন্নতি
বিকেএসপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ছিলেন হকির কোচ কাওসার আলী। ২০১৭ সালে তিনি অবসরে যান। হকির কিংবদন্তী কোচ বিকেএসপির পদোন্নতি জট নিয়ে বলেন, ‘কোচ থেকে সিনিয়র কোচ হতে আমার ২০ বছর লেগেছে। দীর্ঘসময় আমি একই পদে ছিলাম। অবসরের কয়েক বছর আগে চীফ কোচ হতে পেরেছিলাম। অথচ সেটা হওয়ার কথা ছিল আমার দীর্ঘদিন আগেই। কোচদের পদোন্নতি জট বিকেএসপির সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এতে কোচরা আর্থিক ও পদমর্যাদায় বঞ্চিত হন।’
বিজ্ঞাপন
বিকেএসপির কোচরা পরিচালক প্রশিক্ষণের অধীনে। বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ফারুকুল ইসলাম বিকেএসপির পরিচালক প্রশিক্ষণ ছিলেন সবচেয়ে বেশি সময়। ১৯৯৭-২০০৭ পর্যন্ত পরিচালক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করা ফারুক কোচদের এই সমস্যা নিয়ে বলেন, ‘কোচদের সমস্যাটা বিকেএসপি প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই। যখন আমি ১৯৯৬ সালের পর যোগদান করি, তখন দেখি খালেক ভাই একমাত্র চীফ কোচ। ১৯৮৬ সালে ফুটবল, হকি দিয়ে বিকেএসপি যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তী দশ বছরে অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার ও ক্রিকেটসহ আরও কয়েকটি ডিসিপ্লিন শুরু হয়। অথচ সকল খেলার চীফ কোচ একজন। পরবর্তীতে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চীফ কোচ সংখ্যা বাড়ানো হয়।’
বিকেএসপিতে কোচরা নবম গ্রেডে যোগদানের পর পাঁচ বছর কাজ করেই সিনিয়র কোচ হওয়ার কথা বিকেএসপির চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী। দশ-পনেরো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেকে সিনিয়র কোচ হতে পারেননি। এমন সংখ্যা রয়েছে বেশ। এর পেছনে কারণ সিনিয়র কোচ পদ মাত্র নয়টি। সিনিয়র কোচরা পদোন্নতি পেয়ে চীফ কোচ কিংবা পদশূন্য না হলে জুনিয়র কোচদের সকল শর্ত পূরণ করেও সিনিয়র কোচ হওয়া যায় না। সিনিয়র কোচ থেকে পাঁচ বছর পর চীফ কোচ হওয়ার কথা। সেখানেও থাকে জট।
বিজ্ঞাপন
বিকেএসপির উপ-পরিচালক ছগীর হোসেন কোচদের এই সমস্যা নিয়ে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে সাধারণত সর্বত্র ৩০ বছর পর্যন্ত আবেদনের সময়সীমা। কোচ টেকনিক্যাল বিষয়, এজন্য আমরা বছর দশেক আগে সেটা সংশোধন করে কোচ ৪০ ও সিনিয়র কোচ ৪৫ বছর করা হয়েছে। আমরা অর্গানোগ্রামে সিনিয়র কোচ সংখ্যা বৃদ্ধি, পদসোপান নীতি পুর্নবিন্যাস করা হয়েছে। বিকেএসপি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হলেও আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোর অনুমোদন হতে হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। সেটা এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
স্বল্প বেতন, নেই পেনশন
বিকেএসপিতে একজন কোচ এখন নবম গ্রেডে যোগদান করেন। এতে সর্বসাকুল্যে মাসিক ৩৫-৪০ হাজার টাকা সম্মানী পান। পদোন্নতি না হওয়ায় দীর্ঘদিন এই বেতনেই থাকতে হয় তাদের। একে তো বেতন কম, পদোন্নতি জট এর মধ্যে আবার নেই পেনশন। জীবনের পুরো সময় বিকেএসপিতে দেওয়ার পরও কর্মজীবন শেষে শূন্য হাতে ফিরতে হয়।
বিকেএসপির পরিচালক প্রশিক্ষণ কর্নেল মোঃ গোলাম মাবুদ হাসান কোচদের বেতন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বলেন, ‘বিকেএসপি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফলে এখানে কোচরাই প্রতিষ্ঠানের বড় প্রাণ। ভালো মানের খেলোয়াড় তৈরির পূর্বশর্তই ভালো মানের কোচ। কোচদের ভালো সম্মানী ও সুযোগ সুবিধা আরও বেশি প্রদান করা প্রয়োজন। আমরা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে অনুরোধ করেছি, কোচদের বিষয়ে বাজেট বৃদ্ধির জন্য।’
বিকেএসপি ক্রীড়া শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে আগামীর খেলোয়াড় উঠে আসবে। সাবেক খেলোয়াড় কিংবা কোচদের বিকেএসপিতে কোচ হওয়ার জন্য হওয়ার কথা ছিল তীব্র লড়াই। সেখানে কোচের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয় না। এর কারণ সম্পর্কে বিকেএসপি ও জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ সারওয়ার ইমরান সাবেক ক্রীড়াবিদদের বিকেএসপি কোচ হতে না চাওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন,‘স্বল্প বেতন ও নানা পারিপাশ্বিকতায় অনেকে আগ্রহী হয় না। আবার ক্যারিয়ারের শুরুতে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতার জন্য কিছুদিন কাজ করলেও পরবর্তীতে অন্যত্র চলে যাচ্ছে ভালো সুযোগ পেয়ে। ফলে বিকেএসপির শিক্ষার্থীদের কোচ পরিবর্তন হচ্ছে, তাদের প্রশিক্ষণ মানে তারতম্য ঘটছে।’
সবচেয়ে অভিজ্ঞ কোচ হওয়ার পর ‘রুমবন্দি’
বিকেএসপিতে কোচ হিসেবে যোগদানের পর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র কোচ, চীফ কোচ এবং উপ-পরিচালক (প্রশিক্ষণ) পর্যন্ত হওয়া যায়। ২০-২৫ বছর পর কোচিংয়ের পর অনেকে উপ-পরিচালক হতে পারেন। যখন একজন কোচ অত্যন্ত অভিজ্ঞ হন তখন উপ-পরিচালক হয়ে তাকে কোচিংয়ের পরিবর্তে প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। যা সংশ্লিষ্ট খেলা এবং প্রতিষ্ঠানের ট্যাকনিক্যাল বিষয়ে প্রভাব পড়ে ব্যাপক। বিকেএসপির সাবেক উপ-পরিচালক প্রশিক্ষণ আখিনুর জামান রুশো এই বিষয়ে বলেন, ‘দুই যুগ কোচিং করার পর একজন কোচ তখন পরিপূর্ণ হয়। ওই সময় তার কাছ থেকে হাই-পারফরম্যান্স প্রত্যাশা করা যায় এবং তার মাধ্যমে জুনিয়র কোচরাও শিখবে। সেই সময় উপ-পরিচালক হয়ে কোচের মাঠের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তাকে প্রশাসনিক কাজেই ব্যস্ত থাকতে হয়, অথচ তিনি মাঠে থাকতে পারলে টেকনিক্যাল পর্যায়ে সবচেয়ে ভালো উপযোগীতা আসার সুযোগ ছিল।’ উপ-পরিচালক হওয়ার পর মাঠে সরাসরি কাজের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ না থাকায় রুশো উপ-পরিচালক পদে ছেড়ে স্বেচ্ছায় অবসরে যান।
বিকেএসপির ফুটবল ও ক্রিকেটের দুই জন সবচেয়ে ভালো কোচদের মধ্যে অন্যতম উজ্জল চক্রবর্তী শিবু ও মন্টু দত্ত। শিবু কয়েক বছর আগেই উপ-পরিচালক আর মন্টু হয়েছেন এই বছর। ফলে দুই শীর্ষ খেলার দুই কোচই এখন আর মাঠে সেভাবে সম্পৃক্ত হতে পারছেন না। যার প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে দুই খেলায়।
বিকেএসপি ছেড়েছেন ভালো কোচরা, ছাড়তে চান অনেকেই
ক্রীড়াঙ্গনের আতুড়ঘর বিকেএসপি। সেখানেই দেশসেরা কোচদের চারণভূমি হওয়ার কথা। অথচ সুযোগ-সুবিধার অভাব ও নানা কারণে ভালো কোচরা বিকেএসপি ছেড়ে যাচ্ছেন নিয়মিত বিরতিতে। দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেট কোচ সারওয়ার ইমরান, নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। তারা তিনজনই ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বিকেএসপির কোচ হিসেবে। পর্যায়ক্রমে তিনজনই বিকেএসপি ছেড়েছেন।
বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী দ্রুততম মানব আব্দুল্লাহ হেল কাফী। কোচ হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। দেশের আরেক দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার তারই শিষ্য। সেই কাফি নিজের প্রিয় প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগান করেছেন। কারণ তিনি এখানে ক্যারিয়ারের বাকি সময়ে থাকলেও উপ-পরিচালক হতে পারতেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এখনই শারীরিক শিক্ষা বিভাগে উপ পরিচালক পদে যোগদান করতে পেরেছেন। বিকেএসপি ছেড়ে যাওয়া নিয়ে কাফি বলেন, ‘যখন বিকেএসপিতে ভর্তি হই। তখন স্বপ্ন ছিল কোচ হবো। স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পরও মানুষ যখন তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসে তখন বোঝা যায় কত অনিশ্চয়তা বা সংকট। বছরের পর বছর কাজ করেও নেই পদোন্নতি, এর চেয়েও বড় সমস্যা পেনশন নেই। একজন কোচ পুরো জীবন এখানে দেওয়ার পরও পরিবারের জন্য শেষ বয়সে কোনো আর্থিক নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। এ রকম পিছু টান নিয়ে ভালোভাবে কাজ করা যায় না।’
গত বছর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কোচের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচের পদ দ্বিতীয় শ্রেণীর। বিকেএসপির প্রথম শ্রেণীতে কয়েক বছর কোচিং করানোর পরও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কোচ হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন অনেকে। এতেই স্পষ্ট বিকেএসপির কোচরা কতটা হতাশায় এবং সমস্যায়।
নেই স্পেশালিস্ট কোচ
খেলাধুলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর্যায় বেড়েছে অনেক। ক্রিকেটে ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে আলাদা আলাদা কোচ, ফুটবল কিংবা হকিতেও গোলরক্ষক আলাদা কোচ। অ্যাথলেটিক্সে তো স্প্রিন্ট, জাম্প ও থ্রো সব ইভেন্টেই রয়েছে ভিন্নতা। অথচ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েও বিকেএসপিতে নেই কোনো স্পেশালিস্ট। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। ফুটবলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশন গোলরক্ষক। আমিনুল-বিপ্লব পরবর্তী সময়ে গোলরক্ষক পজিশনে বাংলাদেশ অনেক ভুগেছে। বিকেএসপি তিন যুগের মধ্যে জাতীয় ফুটবল দলে একজন গোলরক্ষক সরবারহ করতে পারেনি। কারণ গোলরক্ষকে আলাদা প্রশিক্ষক সেভাবে নেই।
একজন কোচকেই সবই করতে হয়। এতে কাঙ্ক্ষিত পারফরম্যান্স ও উৎকর্ষতা আসে না। বিকেএসপির ক্রিকেট কোচ মন্টু দত্ত স্পেশালাইজড কোচ অত্যন্ত প্রয়োজন মনে করেন, ‘স্পেশালাইজড কোচ খুবই দরকার। বিশেষ করে ক্রিকেটের মতো টেকনিক্যাল খেলায় আলাদা ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং কোচ থাকলে বিকেএসপি থেকেই অত্যন্ত পরিশীলিত খেলোয়াড় উঠে আসবে। জাতীয় দলে তখন অ্যাপ্রোচ ও গেম প্ল্যানিং করলেই চলবে।’
খেলোয়াড়-কোচ অনুপাতে ফারাক
বিকেএসপিতে এখন প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫০০ জন। এর বিপরীতে কোচ ১০৭ জন। ১৫ জন খেলোয়াড়ের বিপরীতে একজন কোচ অনুপাত অনেকটা এই রকম। খেলোয়াড় ও কোচ অনুপাত যত কাছাকাছি হবে অনুশীলনের মান তত ভালো হবে। ত্রিকেটে এখন ২৬৬ জন প্রশিক্ষণার্থী। এর বিপরীতে কোচের সংখ্যা ১৭। হকিতে এই অনুপাত বেড়ে ২০। অন্যান্য খেলায় খানিকটা কম-বেশি। টেবিল টেনিস কোচ মোস্তফা বিল্লাহ বলেন,‘খেলোয়াড় ও কোচ অনুপাত কম হলে প্রশিক্ষণ মান আরও জোরালো ও সুন্দর হয়।’
নেই ট্রেইনার ও অ্যানালিস্ট
উন্নত ও আধুনিক প্রশিক্ষণে ট্রেইনারের কোনো বিকল্প নেই। তিনি মূলত খেলোয়াড়দের ফিটনেসের বিষয়টি দেখভাল করেন। ট্রেইনারের রিপোর্টের ভিত্তিতে কোচ পরিকল্পনা সাজান। বিকেএসপি তিন যুগ পার হলেও এখনো কোনো খেলায় নেই ট্রেইনার। বিকেএসপিতে ২১ ডিসিপ্লিন। ২১ ডিসিপ্লিনে যেখানে অন্তত ২১ জন ট্রেইনার প্রয়োজন সেখানে গোটা বিকেএসপিতে নেই একজন ট্রেইনারও। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি ট্রেইনার না থাকার প্রভাবটি জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপকভাবে দেখছেন,‘ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি তিনটি বড় দলীয় খেলা ফিটনেস নির্ভর। একজন কোচের পক্ষে সকল খেলোয়াড়ের ফিটনেস নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। বিকেএসপিতে ট্রেইনার না থাকায় বিকেএসপি শিক্ষার্থীরা ফিটনেস ঘাটতি নিয়েই বেড়ে উঠছে। বিকেএসপির মতো প্রতিষ্ঠানে ট্রেইনার না থাকাটা খুবই দুঃখজনক এবং এর প্রভাব ব্যাপক।’
বিকেএসপিতে ২১টি ডিসিপ্লিন রয়েছে। ২১ ডিসিপ্লিনে যেখানে অন্তত ২১ জন ট্রেইনার প্রয়োজন সেখানে গোটা বিকেএসপিতে নেই একজন ট্রেইনারও।
বিকেএসপির পরিচালক প্রশিক্ষণ ট্রেইনার প্রসঙ্গে বলেন,‘বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন এখন অনেক অগ্রসর। ট্রেইনারকে স্ট্রেন্থ এন্ড কন্ডিশনিং কোচ বলা হয়। আমাদের এখানে দীর্ঘদিন ধরেই ট্রেইনার অনুপস্থিত। আমরা এটির প্রয়োজনীতা তীব্রভাবে অনুভব করেছি। সম্প্রতি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আশা করি সামনে বিকেএসপিতে ট্রেইনার যাত্রা শুরু করতে পারবে।’ ১৯৮৬ সালে বিকেএসপি কার্যক্রম শুরু করলেও অনেক দিন ফিজিও ছিল না। কয়েক বছর আগে থেকে ফিজিও কাজ শুরু করেছে। সেটাও বিকেএসপির ডিসিপ্লিন ও খেলোয়াড় অনুপাতে খুবই কম।
খেলাধুলা পারফরম্যান্স নির্ভর। পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করতে প্রয়োজন অ্যানালিস্ট। সেই অ্যানালিস্টও নেই। ফলে কোচকেই সকল কাজের কাজীর মতো অ্যানালিস্টের কাজও করতে হয়। এ নিয়ে বিকেএসপির ক্রিকেট কোচ মন্টু দত্ত বলেন,‘একজন শিক্ষার্থীর মাসেল ডেভেলপমেন্ট বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ যা ট্রেইনার থাকলে সহজে পর্যবেক্ষণযোগ্য তেমনি একজন শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্স বিশ্লেষণও গুরুত্বপূর্ণ। অ্যানালিস্ট থাকলে পারফরম্যান্স বিশ্লেষণের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের আরো বেশি উন্নতি সম্ভব।’
কোচদের নেই স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন
সাম্প্রতিক সময়ে বিকেএসপি খেলোয়াড়দের ব্লু প্রদান করছে পারফরম্যান্সের জন্য। খেলোয়াড়দের সাফল্যের পেছনে কারিগর কোচ। সেই কোচদের নেই কোনো স্বীকৃতি। কোচদের যেমন স্বীকৃতি নেই আবার নেই তদারকি কিংবা মূল্যায়ন। সব কোচই একই রকম পারফরম্যান্স করেন না। বিকেএসপিতে কোচ হিসেবে একবার যোগদান করলে যেন আর চাকরি হারানোর ভয় নেই। বিকেএসপির সাবেক ক্রিকেট কোচ রুশো স্থায়ী চাকরির পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক হওয়া মনে করেন,‘বিকেএসপিতে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার উপলব্ধি। কোচরা চুক্তিভিত্তিক হলে তাদের বেতন-সম্মানী বেশি হতে পারে আবার তাদের পারফরম্যান্সও প্রতিষ্ঠান তদারকি করতে পারে।’ বিকেএসপির সাবেক কোচ কাওসার আলীও তাই মনে করেন,‘যোগদানের কয়েক বছর পর একটা মূল্যায়ন হওয়া দরকার কোচদের। যাদের পারফরম্যান্স ভালো তাদের বেতন ও অন্য সুযোগ-সুবিধা বেশি হওয়া উচিত। গতানুগতিক ধারায় চললে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায় না।’
কোচদের নেই মান্নোয়নের সুযোগ
৩০-৩৫ বছর বয়সে কোচরা বিকেএসপিতে যোগদান করেন। খেলোয়াড় হিসেবে অভিজ্ঞতা, কোচিং ডিপ্লোমা নিয়ে অধিকাংশের কোচিং ক্যারিয়ার শুরু হয়। কোচিং এমন একটি পেশা যুগের সঙ্গে সব সময় তাল মিলিয়ে চলতে হয়। প্রতিনিয়ত খেলার কৌশল, পরিকল্পনা বদল হচ্ছে। এজন্য কোচদের প্রশিক্ষণ ও মান উন্নয়ন প্রয়োজন। কোচদের উন্নত কোচিং কোর্স কিংবা ট্রেনিংয়ের জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। নানা প্রক্রিয়া শেষে ছুটি মিললেও আর্থিক সহায়তা দিতে পান না কোচরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ফলে বাধ্য হয়ে নিজের ক্যারিয়ারে মান উন্নয়নের জন্য নিজের পয়সা খরচ করে বিদেশে যেতে হয়। বিকেএসপির বর্তমান পরিচালক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত ক্রীড়ানুরাগী। তিনি এই বিষয়টি গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন, ‘কোচদের মান উন্নয়ন অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাদের এই খাতে কোনো বাজেট নেই। ফলে অনেক ভালো কোর্সে কোচরা সুযোগ পেয়েও আর্থিক কারণে পিছিয়ে পড়ে। আমরা এই বিষয়ে কোচদের সহায়তা করার চেষ্টা করছি। খানিকটা ব্যয় হলেও এটা প্রতিষ্ঠান ও ক্রীড়াঙ্গনের জন্য টেকসই বিনিয়োগের অংশ।’
বিক্ষিপ্তভাবে বিদেশি কোচ
বিকেএসপি শিক্ষার্থীদের ভালো ও উন্নত মানের প্রশিক্ষণের জন্য অনেক সময় বিদেশি কোচ আনা হয়। বিদেশি কোচদের বেশ ভালো পারিশ্রমিকই প্রদান করা হয়। বিদেশি কোচদের স্থায়ীত্ব ৩-৪ বছরের বেশি সময় হয় না। ফলে দুই-তিনটি ব্যাচের বেশি ঐ কোচদের কাছ থেকে উপকৃত হতে পারে না।
বিদেশি কোচরা অনেক অর্থ পেলেও দেশি কোচরা অবহেলিতই থাকেন। অনেক সময় দেশি কোচদের সমান যোগ্যতা-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিদেশি কোচ অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছেন। তাই বিকেএসপির সাবেক অ্যাথলেটিক্স কোচ কাফির পর্যবেক্ষণ,‘বিদেশি কোচ অবশ্যই দেশি কোচদের চেয়ে ভালো মানের হওয়া প্রয়োজন। আরেকটি বিষয় বিদেশি কোচ বেসিক না পারফরম্যান্স কোনটার জন্য আনা দরকার সেটাও নির্ধারণ জরুরি। বেসিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেশি কোচরাই দিতে পারে,পারফরম্যান্সের জন্য আনলে সেটার ধারাবাহিকতা রাখা উচিত।’ বিদেশি কোচ আনার ক্ষেত্রে তিনি নীতিমালাও প্রয়োজন মনে করেন তিনি,‘কিছু খেলায় বারবার বিদেশি কোচ আসছে, আবার কিছু খেলায় একেবারেই নেই। আবার অনেক সময় বিদেশি কোচ আসার মধ্যে বিরতি হচ্ছে অনেক ফলে একটি ব্যাচ উন্নত কোচ পাচ্ছে আবার অন্য ব্যাচগুলো পাচ্ছে না। একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও লক্ষ্য নিয়ে বিদেশি কোচ আনা প্রয়োজন।’
কোচরা আবার ফেডারেশনেও
বিকেএসপিতে কোচদের অনেক কাজ করতে হয়। এরপর আবার অনেক কোচ জাতীয় ফেডারেশনের কমিটিতেও থাকেন। ফলে সেখানেও সময় দিতে হয়। সকল ফেডারেশনেরই প্রধান কার্যালয় জাতীয় স্টেডিয়াম এলাকা। বিকেএসপি থেকে এই ফেডারেশনে আসা যাওয়ায় সময় ব্যয় হয় কোচদের। আবার বিভিন্ন খেলা বা প্রতিযোগিতায় বাড়তি দায়িত্ব থাকে। কমিটিতে থাকায় কোচরা সংগঠক হিসেবেও কাজ করেন। এ নিয়ে বিকেএসপির অবসরপ্রাপ্ত কোচ কাওসার আলী বলেন, ‘কোচরা ফেডারেশনের কোচিং বা টেকনিক্যাল কমিটিতে থাকলে ভালো। এতে কোচ ও ফেডারেশন দুই পক্ষই উপকৃত হয়। নির্বাহী কমিটিতে থাকলে কোচদের সাংগঠনিক কাজও করতে হয়। যা বাড়তি চ্যালেঞ্জও।’
এজেড/এফআই