গল্পটা একটা ছিমছাম গ্রামের। মানুষের হই-হুল্লোড় আছে। ঝগড়া-ঝাঁটি, নানা টানাপোড়নও নিত্যসঙ্গী। আছে সবুজে ঘেরা বিরাট বিল, বর্ষায় বিলভর্তি মাছ আর শীতে কুয়াশায় ঢেকে যাওয়ার রোমাঞ্চও। গাঁ ভর্তি ছেলেপুলে। ক্রিকেট তাই আছে স্বাভাবিকভাবেই।

তখনও অবশ্য রঙিন টিভি পৌঁছায়নি। অ্যান্টেনা ঘোরানোর যুগও শেষ হয়নি ততদিনে। ডিশ লাইন বিলাসিতা তখনও। তবুও ক্রিকেট নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ আছে, সাদা-কালো টিভিতে স্বপ্নের নায়ক ক্রিকেটারদের দেখার ইচ্ছেও।

জিম্বাবুয়ে হোক কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার ভেতর কিংবা ‘বিটিভির বিরক্তির সংবাদের সময়’টুকু পেরিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটতো উৎকণ্ঠায়। রেডিও হোক বা টেলিভেশন, শেষ খবরটা চাই। বেশিরভাগ সময়ই দিনশেষে সঙ্গী হতো হার, তাতে কিইবা যায়-আসে আদতে!

ক্রিকেটটা ওই গ্রামজুড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। শর্ট বাউন্ডারি খেলা-কিশোরদের তখনও হয়তো ঠিকঠাক জানা হয়নি ব্যাট-প্যাড-হেলমেটের নাম কিংবা বিশ্বকাপটার মানে। তবুও সেখানে বিশ্বকাপ মানে ভিন্ন আবহ। কালে-ভদ্রে দেখা পাওয়া ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের বিপক্ষে নিজেদের দেশের খেলার সুযোগ।

বিশ্বকাপ তাই হয়ে আসে আশীর্বাদ। পড়া ফাঁকি দেওয়ার আরও একটা অযুহাত। বন্ধুর সঙ্গে কোনো ক্রিকেটারকে নিয়ে তুমুল তর্কের একটু বাড়তি রসদ। হিসাব কষা হয়, ভারত নাকি পাকিস্তান? বন্ধুদের আড্ডার একজন মাঝখানে উঠে দাঁড়ান। বলেন, ‘আরে না, না এদের কেউ না। শ্রীলঙ্কা...’

কুমার সাঙ্গাকার খুব প্রিয় তার। মহেলা জয়বার্ধানে, তিলকারাত্নে দিলশানরাও। এরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু বিশ্বকাপটা তো জেতা হচ্ছে না। ছেলেটার তাই দৃঢ় বিশ্বাস, এবারের বিশ্বকাপটা শ্রীলঙ্কার। তাদের একজন অবশ্য এসবের কিছুরই ধার ধারেন না। ক্রিকেট তেমন বুঝেন না। কিন্তু একজন ক্রিকেটারকে চেনেন। রিকি পন্টিং। 

হলুদ জার্সির একজন ক্রিকেটার তিনি। খুব ভালো ফিল্ডিং করেন। ছেলেটার ক্রিকেটজ্ঞানের এতটুকুতেই ইতি। এর বেশি জেনে হবেইটা বা কী? মেলবোর্ন, সিডনির বড় মাঠে, ক্রিকেট বলে পন্টিংয়ের ফিল্ডিংয়ের দরকার আছে নাকি! বলটা কোনো মতো হাতে রাখতে পারলেই, ‘আই অ্যাম রিকি পন্টিং’ বলাতেই তার বিশ্বকাপ দেখার শখটুকুর সমাপ্তি।

অথবা সেই দাদুটা। যিনি ক্রিকেট ঠিকঠাক বুঝেন না। বুঝতে তেমন চানও না। তবে বিশ্বকাপ এলে চায়ের দোকানে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনেন খেলাটার গল্প। কিংবা গালগল্প করা ওই মানুষটা, যিনি কয়েকজন ক্রিকেটারের নাম মুখস্ত করেছেন বহু কষ্টে। তাদের নিয়ে হরেক রকমের গল্প সাজান সন্ধ্যায়।

বিশ্বকাপ তো আমাদের সাক্ষী করে কত কত ছোটগল্পের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আশরাফুল বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন। প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই চমকে দেয় বাংলাদেশ। এরপর আর খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের।

বিশ্বকাপ আবার আমাদের দেশে চলে আসে কখনো কখনো। সাকিব আল হাসান রিকশায় চড়েন, শহিদ আফ্রিদি কিংবা মহেন্দ্র সিং ধোনিও। গ্রামে গল্প হয়, এই যে রিকশাওয়ালা, তাদের বেতন কত? কয়েক লাখ? তারা কি মাস্টার্স পাশ? একদিনের রিকশা চালক?

অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা হয় না। মিরপুরের মাঠের আয়তন নিয়ে যে গল্পটা বলা হয়, সেটার সত্যতাও। অথবা গেইলের ব্যাটের ওজন বা বিশ্বকাপে সত্যিই সোনা থাকে কি না, এসব জানা যায় না কোনোভাবেই। যে যা বলেন, তাই বিশ্বাস করতে হয়। স্বপ্ন দেখতে হয় বড় বড়।

প্রত্যাশার পারদ ছোট হয়ে যায় বাংলাদেশ হংকংয়ের কাছে হেরে গেলে। মন খারাপ হয় ভীষণ। ক্রিকেটকে বরং মনে হয় বিরক্তিকর। দিন দুয়েক পরই আবার বসতে হয় খেলা দেখতে, টানটা থেকে যায় বলে। নিজের দেশে জয়বার্ধানে-সাঙ্গাকারাদের উৎসবে মাততে দেখে আনন্দ হয় সেই শ্রীলঙ্কান সমর্থকটির।

অথবা বিষাদ পুড়িয়ে দিয়ে যায় বেঙ্গালুরু। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ তিন বলে দুই রান করতে পারে না যে ম্যাচে। রাতের নিস্তব্ধ গ্রামে নেমে আসে বিষণ্নতা। ঝিঁঝিঁপোকার ডাক স্পষ্ট শোনা যায় তখন। রাতের আঁধারে একটু চাঁদের আলোর খোঁজ চলে। থই থই জলে জোছনার আলো দেখতে দেখতে চেষ্টা চলে ক্রিকেটের দুঃখ ভোলার। 

ইয়ান বিশপ কোনো একজনকে মনে রাখতে বলেন কাঁপা কাঁপা গলায়। নিজের দেশের বিশ্বজয়ের আনন্দে তার বলা, ‘রিমেম্বার দ্য নেইম, কার্লোস ব্র্যাথওয়েট’ মনে ঢুকে যায় গ্রামের কোনো এক কিশোরের।

ছেলেটা আর কোনোদিন ভুলতে পারেন না ব্রাথওয়েটেরর নাম। আরেকটি বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর আগেও মনে পড়ে ইয়ান বিশপকে। আরও একবার তার গলায় কোনো একটা বাক্যকে মনে রাখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে মন।

তবে ওই গ্রামের খবরটা আর ঠিকঠাক জানা যায় না। আধুনিকতার ছোঁয়া বহু আগেই লেগেছে। এখন আর বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যা নেই, রঙিন টিভি আর ডিশ লাইনে গ্রাম অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছে; সেটাও বহু আগে। ক্রিকেটটা কি আগের মতোই আছে?

অন্তত কিশোরদের মনে নায়ক হিসেবে নিশ্চয়ই কোনো এক ক্রিকেটারের থাকার কথা। এতটুকু জায়গায় শট পিচ খেলতে খেলতে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার বড় ছক্কা হাঁকাচ্ছেন, এমন স্বপ্ন হয়তো এখনো দেখেন কেউ কেউ। গ্রামের বড় বিলটার এক কোণে ধানের কাজ করতে করতে নিশ্চয়ই ক্রিকেটের আড্ডা এখনও হয়।

অথবা স্কুলের পথটা, বন্ধুর সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে তর্ক করার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত জায়গা আর কোনটা? ক্রিকেটের জন্য হয়তো এখনো স্কুল পালানো হয় গ্রামের কোনো এক বাউণ্ডুলে ছেলের। ক্রিকেট নয়তো এভাবে টিকে আছে কী করে!

শহুরে আড্ডায় এখন প্রায়ই ঘুরেফিরে আসে গ্রাম্য গল্প। কেউ কেউ বলেন, ‘একটা বয়স পর্যন্ত শিশুদের গ্রামে অবশ্যই থাকা উচিত নানা কারণে।’ আপনি ক্রিকেটপ্রেমি হলে এটা চাইলে বলতেই পারেন, ‘একটি গ্রাম্য বিশ্বকাপও কাটানো উচিত সব কিশোরের...’ তা না হলে সে বিশ্বকাপের দেখলোটা কী!