ছয় বলে দরকার ৭ রান। জিসেন গিলেস্পি মাথায় হেড ব্যান্ড বেঁধে দৌড়ে এলেন তখন। বল করলেন, আফতাব সেটাকে আঁচড়ে ফেললেন সীমানার ওপারে, উড়িয়ে। পরের বলটা কিপারের হাতে। দৌড় দিয়ে ফেললেন মোহাম্মদ রফিক। দৌড়ালেন আফতাব আহমেদও। স্টাম্পটা ভাঙতে পারলেন না অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। 

দৌড় যেন শুরু হলো তখন। আফতাব কোনদিকে দৌড়াবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। এক হাতে ব্যাট রেখে নিজের দুই হাত মেলে উড়তে চাইলেন আকাশে। পারেননি অবশ্যই। তবে একটা ছবি তৈরি করলেন। কার্ডিফ জয়ের, ‘অজেয়’ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেওয়ার। কিছু স্মৃতি আটকে থাকে মগজে, মননে। চাইলেও ভোলা যায় না সহজে, আফতাবরা তৈরি করলেন তেমন এক স্মৃতি। কার্ডিফে, অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে।

ফ্রেমবন্দি হলো এমন কিছু, যেটা পুরোনো হয় না কখনো। ঠাঁই করে ইতিহাসে, দেশের সেরা সব অর্জনের খাতায়। মাশরাফি শুরু করেছিলেন যে রূপকথা, আফতাবের শেষ ওভারে ছক্কার পর সিঙ্গেলে নিশ্চিত হয়েছিল সেটা।

ফোনের ওপাড়ে থেকে ‘অলস’ ক্রিকেটার থেকে ‘পরিশ্রমী’ কোচ হওয়া আফতাব আহমেদ ফিরে গেলেন কার্ডিফে। এত এত বছর পর, যখন তার ভূঁড়িটা বড় হয়েছে আরও, মুখে দাঁড়ি লম্বা হয়েছে অনেক, শরীরের মতো বদলে গেছে তার মানসিকতাও। তখন তার কাছে পুরানো মনে হয় ২০০৫ সালের সেই কার্ডিফ।

‘অবশ্যই পুরোনো মনে হয়। ১৫-১৬ বছর হয়ে গেছে ওই ঘটনার। স্বাভাবিকভাবেই পুরানো মনে হয়। এরপর বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেক কিছু অর্জন করেছে। আমাদের জীবনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এমনিতে স্মৃতিতে তো সবসময়ই উজ্জ্বল। ওই সময়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো অনেক বিশাল ব্যাপার। সব কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা ছিল ওই দলে।’ 

ওই জায়টাই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে দিয়েছে এক ধাপ, মনে করেন আফতাব, ‘ওই জয়টা আমাদের ক্রিকেটকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে অবশ্যই। শুধু অস্ট্রেলিয়া না, ওই সময় আমরা ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ অনেক বড় কিছু জয় পেয়েছি। তখন আমরা জিততে শুরু করেছিলাম কেবল।’

১০১ বলে ঠিক একশ করে ড্রেসিং রুমের পথে হাঁটছেন মোহাম্মদ আশরাফুল, দেশের সবচেয়ে কম বয়সী টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান। এই ম্যাচেই যিনি গড়েছেন নতুন কীর্তি। মেহরাব হোসেন অপি সেঞ্চুরি করেছিলেন। এরপর আর সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি।

১০৮তম ম্যাচে এসে সে আক্ষেপ ঘুঁচিয়েছেন মোহাম্মদ আশরাফুল, গ্লেন ম্যাকগ্রার বলে, যার বলেই ডাউন দ্য উইকেটে এসে করেছিলেন ফিফটি। মাঝে জ্যাসন গিলেস্পি ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন তার। আশরাফুল সেঞ্চুরি করে কাজে লাগিয়েছিলেন সেই সুযোগ। 

সেঞ্চুরি করে তাই সাজঘরে ফেরার পথে গিলক্রিস্ট এসে অভিনন্দন জানান। আফতাবের মতো তাই আশরাফুলের কাছে কার্ডিফ পুরোনো হয়নি এখনো, কারণটাও বললেন তিনি, ওই জয়টাই যে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একমাত্র!

‘পুরানো মনে হয় না, নতুনই আছে। কারণ আর তো জেতা হয়নি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। একটাই তো জয়। তাই এখনো নতুনই আছে। আগে তো একেকটা জয় আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য প্রমাণস্বরূপ ছিল। অবশ্যই ওই জয়টা আমাদের ক্রিকেটের জন্য একটু হলেও সাহায্য করেছে।’

আশরাফুল মনে করেন, ওই জয়টা অন্যরকম, ‘অস্ট্রেলিয়াকে হারানো তো যেকোনো দলের জন্যই অন্যরকম ছিল। ওই সময় তো তাদের কেউ হারাতেই পারত না। আমরা হারিয়েছি নিজেদের তাই ভাগ্যবানই মনে হয়েছে। ওই জায়গার বাঙালিরাও অনেক খুশি হয়েছে।’

আশরাফুল বরাবরই দৃষ্টিনন্দন, সাহসী। তবে একই সঙ্গে অধারাবাহিকও। ওই সিরিজের প্রথম ম্যাচেও ডাক মেরেছিলেন, অবনতি হয়েছিল ব্যাটিং অর্ডারের। ওপেনিং থেকে নেমে গিয়েছিলেন চারে। আশরাফুল কি পরিকল্পনা করেই নেমেছিলেন সেঞ্চুরির?

‘ওই রকম ছিল না, যখন ২০-২৫ রান হয়েছে। তখনই মাথায় চিন্তাটা আসে। যত বেশি রান করা যায়। হয়তো ভালোভাবে খেললে সেঞ্চুরিও তো সম্ভব।’

আশরাফুল আর আফতাব, দুজনেই ওই ম্যাচে নায়ক হয়ে ওঠেছিলেন দেশের। আশরাফুল সেঞ্চুরি করে, আফতাব সেই ছক্কায়। এরপর দুজনের ক্যারিয়ারই থেমেছে ‘অসময়ে’। আশরাফুল অবশ্য এখনো থামেননি, তার ‘জাতীয় দলে ফেরার’ লড়াইটা এখনো চলছে। আফতাব থেমে গিয়েছেন অনেক আগে, যোগ দিয়েছেন কোচিংয়ে।

আফতাবের ‘অসময়ে’ থেমে যাওয়ার দায়টা তিনি দিচ্ছেন চিন্তাধারাকে, ‘অবশ্যই। চিন্তাধারা তখন হয়তো ভালো করা দরকার ছিল। কোনো কিছু ওভারকাম করা দরকার ছিল, আমি হয়তো পারিনি।’

আশরাফুল মনে করেন ওই জয়ের পর এক ধাপ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। তিনি তার প্রমাণ দিলেন ‘এখন আর খেলোয়াড়রা বিশ্রাম নেয় না’ বলে। বললেন আমাদের ক্রিকেট এগিয়েছে, কিন্তু বদলে যায়নি স্ট্রাকচার, ‘আগে যেমন অনেক খেলোয়াড় বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্রাম নিতো। এখন আর সেই সুযোগটা নেই। অবশ্যই বাংলাদেশ ক্রিকেট সামনের দিকে এগিয়েছে। আমাদের ক্রিকেট এগিয়েছে কিন্তু স্ট্রাকচার ওভাবে উন্নত হয় নাই। আরও একটু আগালে ভালো হতো।’

২০ জুন, কার্ডিফ, ২০০৫। আশরাফুল-আফতাব চাইলে মেলাতে পারেন কিছু টুকরো টুকরো ছবি। আপনার ছোটবেলায় খেলা ‘মেলানো বক্সটার’ মতো। সব উল্টা-পাল্টা ছিল যে বক্সটা। মাথাটা এক পাশে, পা টা মধ্যখানে। আপনাকে একটা স্পাইডার ম্যান বা কিছু মেলাতে হতো।

ওই বক্সটা মেলাতে শুরু করেছিলেন মাশরাফি, অ্যাডাম গিলক্রিস্টের প্যাডে বল লাগিয়ে, বিলি বাউডনের সেই বিশেষ অঙ্গভঙ্গির আউট ঘোষণার মধ্য দিয়ে। পারেননি তাপস বৈশ্য। ম্যাথু হেইডেনকে রফিকের ক্যাচ বানানো বলটা ‘নো’ করে ফেলেছিলেন তিনি।

আপনার ছোটবেলার দুষ্ট বন্ধুটার মতো মেলাতে দিতে চাননি মাইক হাসি ও সাইমন ক্যাটিচ। ৪৩ ওভার ৩ বলে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ১৮৩ ছিল অস্ট্রেলিয়ার রান। ৩৯ বল পর ওই পাঁচ উইকেটে হাসি ও ক্যাটিচ যেটাকে করে ফেলেছিলেন ২৪৯।

শুরুতে গুবলেট পাকানো জাভেদ ওমর বেলিম-নাফিস ইকবাল-তুষার ইমরানরাও অনিচ্ছায় হয়ে পড়লেন দুষ্ট বন্ধুদের সাথী, তারা মেলাতে পারেননি না বক্সটা। মেলাতে পারলেন মোহাম্মদ আশরাফুলও। সবকিছুই যেন তার ঠিকঠাক হলো সেদিন।

আউট করার ‘বোলার কেউ ছিল না’ বলে বোধ হয় তিনি রান আউট হয়ে গেলেন! ১১ চারে ১০১ বলে ঠিক ১০০ রান করে। যখন তিনি সাজঘরের পথ ধরলেন, মেলানো প্রায় অন্তিম লগ্নে। বক্সের দশটা পার্টের একটা এদিক-ওদিক করে দিলেই হিসাবটা মিলে যাবে, এমন।

জিসেন গিলেস্পিকে লং অন দিয়ে উড়িয়ে মেরে সেটা ঠিকঠাক করলেন আফতাব আহমেদও। বাংলাদেশ ‘বক্স মেলানোর’ খেলায় সফলভাবে উতরে গেল সেদিন। রিকি পন্টিং নক খুঁটতে শুরু করলেন। আফতাবরা রাতে মেতে উঠলেন ‘ইনজয়’ করা পার্টিতে।

‘ড্রেসিং রুমের পরিবেশটা দুর্দান্ত ছিল। তার চেয়ে বেশি ইনজয় করেছি রাতে আমাদের এক পার্টি ছিল। ওখানে আমরা অনেক আনন্দ করেছি।এখনো আমরা একসঙ্গে হলে এসব নিয়ে গল্প করি। আমরা ক্রিকেটার, টপিকটাও থাকে ক্রিকেটের।’

ওই জয়ের সময় আপনি কোথায় ছিলেন? আপনার কাছে কার্ডিফ কাব্য আফতাবের মতো ‘পুরোনো’ নাকি আশরাফুলের মতো ‘নতুন’?

এমএইচ/এটি