স্টিভ স্মিথ অধিনায়কত্ব করতে ভালোবাসেন। নামের পাশে অধিনায়কত্বের ট্যাগ লাগানো থাকলে কিংবা না থাকলেও। অধিনায়ক না হয়েও তার ফিল্ডারদের দেওয়া দিকনিদের্শনার জন্য সমালোচনাও সহ্য করতে হয়েছে একটা সময়। স্মিথের অধিনায়কত্বের অধ্যায়ের সমাপ্তি এঁকে দিয়েছিল কেপটাউনের একদিন। সেই বল টেম্পারিং কাণ্ডের পর আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিই স্মিথের গল্পে যুক্ত করলো নতুন অধ্যায়। 

স্যান্ডপেপার দিয়ে ক্যামেরন ব্যানক্রফটের বল টেম্পারিং কাণ্ডে জড়িত থেকে বারো মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে স্মিথ ফিরেছিলেন আবার। তবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অধিনায়কত্বের পথ, চিরদিনের জন্য! কিন্ত সেই পথটা খুলে গেল আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বদৌলতেই। এক সহযোগীর সঙ্গে অশ্লীল বার্তালাপের জেরে অ্যাশেজের পূর্বেই অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে দেন টিম পেইন। 

ফাস্ট বোলাররা তুলনামুলক বেশি ইনজুরিপ্রবণ হওয়ায় ফাস্ট বোলারদের কাঁধে অধিনায়কত্বের ভার তুলে দেয়া হয় না খুব একটা। অস্ট্রেলিয়ার কাছে সেই ভার সামলানোর মতো মানুষ ছিল অবশ্য। কিন্ত স্মিথ ও ওয়ার্নারকে তো নেতৃত্ব থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে দিয়েছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। টিম পেইনের চলে যাওয়াতে এবার ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাই একজন পেসারের দিকেই ঝুঁকলো। প্যাট কামিন্সের ডেপুটি করা যেত মার্নাস লাবুশেনকে। কিন্ত দুই নতুনের কাঁধে অধিনায়কত্বের এই ভার তুলে দিতে চায়নি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। 

প্যাট কামিন্সের অধিনায়কত্ব মানে সহ-অধিনায়কেরও সরব উপস্থিতি। কামিন্স ইনজুরিতে পড়লেই যে সহ-অধিনায়ককে বনে যেতে হবে অধিনায়ক! সেজন্য অভিজ্ঞ স্টিভ স্মিথের কাছেই সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। যার মানে আরও একবার অস্ট্রেলিয়ান ব্লেজারে টস করতে দেখা যাবে স্টিভ স্মিথকে! কিন্ত সেটা এত তাড়াতাড়ি? ভাবেননি স্মিথ নিজেও!

দ্বিতীয় টেস্টের সকালে প্যাট কামিন্সের দুটি কল এলো স্মিথের কাছে। স্মিথ ধরতে পারেননি। পরে অস্ট্রেলিয়ান কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারের মেসেজ দেখতে পেলেন, ‘তুমি কি সজাগ হয়েছ?’ টেস্ট শুরুর ঘণ্টা তিনেক আগেই জানতে পেলেন, কোভিড আক্রান্তের সংস্পর্শে থাকায় দ্বিতীয় টেস্টে নেই কামিন্স, অর্থাৎ অধিনায়কের নাম স্টিভ স্মিথ! 

সব ফরম্যাট মিলিয়ে এর আগেও ৯৩ ম্যাচে টস করতে নেমেছেন স্মিথ, তবে অ্যাডিলেড টেস্টে নামার সময়ের অনুভূতির সঙ্গে মেলানো যাবে না তার কোনটিকেই। যেন স্মিথের অধিনায়কত্ব জীবনের পুনর্জাগরণই ঘটলো! ৩৪তমবারের মতো স্মিথ অধিনায়কত্ব করতে যে টেস্টে নেমেছেন, সে টেস্টে তো হয়েছে কতকিছুই! মাঠে এবং মাঠের বাইরে, দুইখানেই!

দারুণ এক টেস্ট ম্যাচেরই দেখা মিলেছে মাঠে। সেটিকে দারুণ করে তোলার কৃতিত্ব আসলে জস বাটলারেরই। বলের হিসাবে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় দীর্ঘতম ইনিংস খেলেছেন বাটলার। শেষদিনে ছয় উইকেট হাতে নিয়ে টেস্ট বাঁচানোর আশায়ই মাঠে নামে, সেই আশার প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে যায় পঞ্চম দিনের প্রথম ঘণ্টায়ই দেওয়াল হয়ে দাঁড়ানো স্টোকসের পর ইংল্যান্ড পোপকেও হারালে।

তারপরও সেই আশা লড়াকু বাটলার লড়ে গিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তবে ২০৭ বলে ২৬ রানের তার সেই ইনিংসের সমাপ্তিও ঘটেছে নাটকীয়ভাবে! ঝাই রিচার্ডসনের বল অফসাইডে ঠেলে দিয়ে রানের জন্যেও বাইরে বেরিয়েছিলেন বাটলার, এরপর অজিদের উদযাপন দেখে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছেন জিং বেল জ্বলছে জ্বলজ্বল করে।

বাটলারের এই টেস্টটাও কেটেছে বড্ড নাটকীয়ভাবে! ডানদিকে ঝাপিয়ে পড়ে দারুণ এক ক্যাচে করেছিলেন সূচনা, এরপর আরও দুটি দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়েছেন। তবে সেই তিন ক্যাচের ফাঁকে ছেড়েছেন আরও তিনটি ক্যাচ। যেটির দুটি লাবুশেনের, একটি ২১ রানে আরেকটি ৯৫ রানে, লাবুশেন থেমেছেন এরপর ১০৩ রানে। 

অন্য আরেক ক্যাচটা স্মিথের শূন্য রানেই। প্রথম ইনিংসে বাটলার নিজেও ফিরেছিলেন শূন্য রানেই। ‘পেয়ার’ পাওয়ার সম্ভাবনাও জেগেছিল, দ্বিতীয় ইনিংসে সপ্তম বলেই শূন্য রানে স্টার্কের বলে তার ব্যাটের কানায় লেগে ক্যাচ উঠেছিল, স্লিপে থাকা ওয়ার্নার সরে গিয়েছিলেন ক্যারির জন্য, ক্যারি অনঢ় হয়েই ছিলেন। যেমন দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে বাটলারকে দেখে মনে হচ্ছিল। শেষমেশ হিট উইকেটে সমাপ্তি ঘটা তার ২০৭ বলে ২৬ রানের ইনিংসের প্রশংসায় রুট বলেছেন, এই টেস্টে অনুপস্থিত থাকা এমন লড়াকু মনোভাবই তিনি চান সামনের সময়ে। 

ব্যাট হাতে অসাধারণ সময় পার করলেও অধিনায়ক রুট পার করছেন বেশ কঠিন সময়। হারের বৃত্তে ঘোরপাক খাওয়া ইংল্যান্ড প্রথম টেস্টে স্লো ওভাররেটের কারণে হারিয়েছে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট। প্রথমে জেনেছিল সেটি পাঁচ পয়েন্ট, দ্বিতীয় টেস্টের সময়েই জানতে পারলেন, আরও তিনটি পয়েন্ট মিলিয়ে প্রথম টেস্টের কারণে তাঁরা খুইয়েছে আটটি পয়েন্ট। 

রুটের সঙ্গে আরও একটি ঘটনাও ঘটেছিল, সেটাকে আসলে দুর্ঘটনাই বলতে হয়। চতুর্থ দিনে খেলার আগে ওয়ার্মআপে রুটের গোপন জায়গায় পড়ে গিয়েছিলো বল, তখন তার পরনে ছিল না কোন গার্ড। এরপর স্ক্যান সেরে শেষ পর্যন্ত সেদিন তিনি মাঠে নামতে পেরেছেন প্রায় ওভার বিশেক শেষে। 

সেদিনই আবার তাকে ব্যাট করতে হলে, একেবারে দিনশেষের মিনিট কয়েক বাকি থাকতেই আবার তার সেই জায়গায়ই লেগে গেল বল। তবে সেটির চাইতেও তাঁর দুঃখের বিষয় হয়ে থাকবে হয়তো এরপর স্টার্কের বলে আউট হয়ে যাওয়াটা। যে আউটে হয়তো প্রভাব থেকে থাকবে সে দুর্ঘটনার।

প্যাট কামিন্সের কোভিড সংস্পর্শে থাকার ঘটনায় স্মিথের অধিনায়কত্বের পাশাপাশি ঘটেছিল আরও একটি পরিবর্তন। অপেক্ষার পালা শেষে অবশেষে মাঠে নেমেছিলেন মাইকেল নেসার। ১৬ ম্যাচ ধরে একাদশের বাইরে থাকার পর অপ্রত্যাশিতভাবেই তিনি পেয়েছিলেন ব্যাগি গ্রিন। হেজলউডের ইনজুরির সুযোগে দুবছর পর আবার একাদশে ফিরেছিলেন ঝাই রিচার্ডসনও। ফিরে আসার গল্পটাও দারুণভাবে লিখেছেন দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়ে। 

ঘটনাবহুল এই টেস্টের এতসব ঘটনা ছাপিয়ে অধিনায়ক স্মিথের ফিরে আসার গল্পটাই আলাদা হয়ে থাকবে। নানা মোড়ে বাঁক নেওয়া স্মিথের জীবনের গল্পে সংযোজন হলো ভিন্নধর্মী নতুন এক অধ্যায়ের। যেখানে স্মিথকে দেখা যাবে অধিনায়ক হিসেবে, তবে সেটি মাঝে মাঝেই শুধু!

এমএইচ