‘আই মুভড অন ফ্রম বাংলাদেশ’- মুঠোফোনে সাক্ষাৎকার নিতে চাওয়ার পর তাঁর ফিরতি বার্তা ছিল এটি। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশ থেকে চলে গেছেন। তার মানে কী, কথা বলতে চান না? বিষয়টা হয়তো এমনই.., তবে অনুরোধের পর কথা বলেছেন বাংলাদেশের সাবেক বোলিং কোচ। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পেসারদের। সাবেক হয়ে যাওয়া বেলিং কোচ ওটিস গিবসন মনে করেন, এটিই প্রমাণ করে তার অধীনে পেসারদের উন্নতি হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্রিকেট সঠিক পথে আছে কি না, এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি ওটিস গিবসন। বলেছেন, গত দুই বছর তিনি কোচিংটা উপভোগ করেছেন। আলাদা করে তার নজর কেড়েছেন হাসান মাহমুদ; এবাদত-তাসকিনদের কঠোর পরিশ্রম মুগ্ধ করেছে তাকে। উন্নতির জন্য বিসিবি ও অন্যদের কাছ থেকে পেসারদের আরও সম্মান দরকার বলে বিশ্বাস তার।

ঘরোয়া থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, দেশ ও দেশের বাইরে পেসারদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত- এ বিষয়ে ওটিস গিবসন কথা বলেছেন মাহমুদুল হাসান বাপ্পির সঙ্গে...

প্রায় দুই বছর এখানে কাজ করলেন, অভিজ্ঞতাটা কেমন?

ওটিস : অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে বলব, এখানে ভিন্নতা আছে। আমার মনে হয় সব পেসাররা মাউন্ট মঙ্গানুইতে (কিছুদিন আগে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতে হারিয়েছিল এই ভেন্যুতে) দেখিয়েছে তারা কী করতে পারে। বাংলাদেশের পেসাররা উন্নতি করেছে। বেশ কয়েকজন বিশেষ পেস বোলার পেয়েছি যারা বাংলাদেশকে ম্যাচ জিতিয়েছে। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে যেটা অনেক লম্বা সময় পর ঘটল।

আপনি দুই বছরে এই উন্নতি করলেন। এখন আপনার চলে যাওয়াটা কি আবার তাদের পেছনে ঠেলে দেবে?

ওটিস : না, আমি এমন মনে করি না। খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার অনেক লম্বা। কোচ আসবে, কিছু ইম্প্যাক্ট রাখবে, তারপর আবার চলে যাবে। আমার মনে হয় পরের কোচ যিনি আসবেন, তিনি দলটাকে সামনে নিয়ে যাবেন। আমরা দু বছর ধরে কাজ করেছি। তারা জানে, কী কাজ হয়েছে; জানে নিজেদের কী করতে হবে সেটাও।

আমি প্রতিদিন ব্যক্তিগতভাবে কাজ করেছি, চলে আসার আগ পর্যন্ত। আমার মনে হয় তারা এখন জানে, তাদের কোন কাজটা করতে হবে, কোনটা চালিয়ে যেতে হবে। আমার বিশ্বাস এরপর যে কোচ আসবেন, তিনি তাদের যাত্রার পরের গন্তব্যে নিয়ে যাবেন। আমার অংশ ছিল তাদের এই যাত্রাটার সঙ্গী হওয়া, হয়েছি। এখন আবার নতুন কেউ এসে তাদের পরের গন্তব্যে নিয়ে যাবেন।

এতদিনের অভিজ্ঞতায় যতটুকু দেখলেন, বাংলাদেশের পেসারদের উন্নতির জন্য কী দরকার?

ওটিস : উন্নতির জন্য তাদের বিসিবি ও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে সম্মান পাওয়া দরকার। সতীর্থদের কাছ থেকেও সম্মান দরকার। আমি বিসিবির সঙ্গে কথা বলেছিলাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পেসাররা যত বল করে, ঘরোয়া ক্রিকেটে তার ধারেকাছেও করতে দেওয়া হয় না। তাই তাদের ওখানে আরও বেশি বল করতে দিতে হবে, স্কিলের উন্নতির জন্য।

যখন বাংলাদেশ ঘরের মাঠে খেলে, তারা সাধারণত মাত্র একজন পেসার খেলায় অথবা কখনো দুজন। এমনকি কখনো কখনো পেস বোলাররা নতুন বলটাই পায় না। কিন্তু যখন দেশের বাইরে যায়, তখন তিনজন পেসার খেলায়। এরপর আবার তাদের কাছে প্রত্যাশা করা হয় ম্যাচ জেতাবে।

তাদের খুব বেশি করার কিছু থাকে না ম্যাচ জেতানোর জন্য। তাই আমার মনে হয় মাউন্ট মঙ্গানুইতে যেটা হয়েছে, সেটা ছিল অবিশ্বাস্য। আমার মনে হয়, এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যদি বিসিবি তাদের পেসারদের ওপর বিশ্বাস রাখে তাহলে কী করা সম্ভব। তাদের অনেক পেস বোলার আছে। আমার মনে হয় এখন বিসিবি ও তাদের সতীর্থদের পেসারদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।

আপনি তাহলে মনে করছেন পেসারদের প্রতি সম্মানে ঘাটতি আছে?

ওটিস : আমি জানি না এটা সম্মানের অভাব কি না। কিন্তু আপনি যদি অন্য দেশগুলোর দিকে দেখেন- অস্ট্রেলিয়ায় ডেনিস লিলি-জ্যাক থম্পসনের মতো কোচ ছিল; ওয়েস্ট ইন্ডিজে মার্শাল জুয়েল গার্নার। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও শক্ত পেস বোলিং কোচ আছে।

বাংলাদেশে আমার মনে হয় ভালো পেস বোলার আছে। কিন্তু পেস বোলারদের ভালো কোচ নেই। আমার মনে হয় এই জায়গায় উন্নতি দরকার। এটা আসলে সম্মানের ঘাটতি নয়, বোঝাপড়ার সমস্যা; পেসারদের কী দরকার।

একটু মুস্তাফিজ প্রসঙ্গে আসি। সাদা বলের ক্রিকেটে তিনি দুর্দান্ত। কিন্তু লাল বলে তার কী সমস্যা?

ওটিস : লাল বলের ক্রিকেটে আলাদা মানসিকতা দরকার। অনেক বেশি ধৈর্য দরকার। একটা কাজই আপনাকে দিনের পর দিন করে যেতে হবে; ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখতে হবে। সে খুব ভালো লাল বলের ক্রিকেটার হতে পারে। যদিও আমি জানি না তার শরীর সেটা নিতে পারবে কি না।

কিন্তু সে হতেই পারে। একটা বিষয়ে আমরা অনেক দিন আগে কাজ করেছিলাম, সে সেটা করেছে। আমার মনে হয় লাল বলেও সে ভালো করতে পারে। কিন্তু সেটা তার নিজেকে চাইতে হবে। এটাই আসলে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সে চায় কি না। আমার মনে হয় অন্য ছেলেরাও ভালোই করছে।

তাসকিন উন্নতি করেছে, সে এখন দারুণ বোলার। এবাদত- নিউজিল্যান্ডে যে দুই ইনিংসে ভালো বল করেছে... এমনকি চট্টগ্রামে পাকিস্তানের বিপক্ষেও খুব ভালো করেছে, যদিও উইকেট পায়নি। কিন্তু নিজের লাইন ও লেন্থের নিয়ন্ত্রণ করেছে দারুণভাবে।

আমি বুঝতে পারছিলাম সে একটা ভালো স্পেল করার খুব কাছাকাছি আছে, যেটা সে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে করল। আমি তার জন্য খুব খুব খুশি ছিলাম। কারণ সে অনেক কষ্ট করছিল ভালো কিছুর জন্য।

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিটটা নিয়ে আপনার ভাবনা কী...

ওটিস : আপনি যদি পেস বোলিং বিভাগের দিকে তাকান। নিউজিল্যান্ডে যারা বল করল- আপনার হাতে তাসকিন-এবাদত-শরিফুল আছে। শরিফুল অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে এসেছে। আর খুব দ্রুত জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে। পরে টেস্ট দলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। সে অনেক উন্নতি করেছে।

খালেদ, আমি তাকে খুব পছন্দ করি। তার অ্যাটিচিউড ভালো, অনেক পরিশ্রম করছে। সবসময়ই শিখতে চায়। রাহী- আমার মনে হয় এখনো সে স্কিলের দিক থেকে দেশের সেরা বোলার। খুব ভালো সুইং আছে। শহিদুল আছে, সে আমাদের সঙ্গে একটা সিরিজে ছিল।

ছয়টা ছেলে আছে। যারা টেস্ট দলকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার মতো সক্ষমতা রাখে যদি তাদের সুযোগ দেওয়া হয়।

আপনি বললেন টেস্ট দলকে পেসাররা সামনের ধাপে নিয়ে যেতে পারে। তাদের গুরুত্বটা যদি একটু ব্যাখ্যা করে বলতেন...

ওটিস : এটা আসলে নির্ভর করে, আগেই যেমন বললাম, আপনার দলের সেট-আপের ওপর। সাধারণত বাংলাদেশ যখন ঘরের মাঠে খেলে-তাদের ছয়জন ভালো পেসার থাকলেও তারা এক বা দুজনের বেশি খেলায় না। অনেক ভালো পেসাররা বেঞ্চে বসে থাকে। এর মানে হচ্ছে বাংলাদেশকে তাদের ঘরের মাঠের পরিকল্পনা বদলাতে হবে। আমার মনে হয় না এটা করতে তারা খুব বেশি উৎসাহী!

এই কথাতেই আসছিলাম...। ঘরের মাঠে যখন নিয়মিত আপনি স্পিনিং উইকেটে খেলাবেন। এরপর হুট করে বিদেশে গিয়ে কি ভালো কিছু সম্ভব?

ওটিস : আমার মনে হয় যদি আপনি নিউজিল্যান্ডের ম্যাচটাই দেখেন, সেখানে তারা দেখিয়েছে, ঘরের বাইরেও সফল হতে পারে। কিন্তু আবারও বলছি, তাদের বিসিবির সমর্থন দরকার। তাদের ভালো উইকেট দিতে হবে খেলার জন্য। আমাদের সবার তাদের ওই সমর্থনটা দেওয়া দরকার।

কোনো তরুণ পেসার আলাদাভাবে আপনার নজর কেড়েছে?

ওটিস : আমি হাসান মাহমুদ ছেলেটার বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়েছি। যখন তাকে দেখেছি- তখনই ভেবেছি, এই ছেলেটাই মূল ভরসা হতে পারে। কিন্তু তার খুব মারাত্মক একটা ইনজুরি হলো। এক বছর ধরে এখন খেলার বাইরে। যেটা তাকে পিছিয়ে দিয়েছে।

আমি খুব হতাশ হয়েছি। তার বলে গতি ছিল, ছেলেটা লম্বাও ছিল অনেক। খুব দ্রুত শিখছিল। যদি তার ইনজুরি না হতো, তাহলে সে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সম্পদ হতে পারত। আমার মনে হয়েছে সে বাংলাদেশের পেস বোলিং বিভাগের হৃদপিণ্ড হতে পারে।

তাসকিনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ওটিস : এক কথায় বললে দুর্দান্ত। খুব ভালো ছেলে। তার সঙ্গে কাজ করা উপভোগ করেছি। তার শেখার তাড়না অনেক, কঠোর পরিশ্রম করতে পারে। আমি তাকে ফিটনেসের দিকে নজর দিতে বলেছি। সে এটা মাথায় নিয়েছে এবং অনেক পরিশ্রম করেছে নিজেকে ফিট রাখতে। আমি তার সম্পর্কে ‘দুর্দান্ত’র বাইরে খুব বেশি কিছু বলছি না।
 
দু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট কি সঠিক পথে চলছে?

ওটিস : এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

তাহলে এটা অন্তত বলুন, আপনার আর বাংলাদেশে ফেরার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না...

ওটিস : আমি একজন ক্রিকেট কোচ। কখনোই কোনো কিছুর শেষ নেই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ অন্য কোথাও লেখা আছে। আমি বাংলাদেশে নিজের সময়টা উপভোগ করেছি। কিন্তু যেটা বলেছি আগেই- নতুন কেউ এসে বাংলাদেশের পেসারদের পরের ধাপে নিয়ে যাবে। আমার কোচিংয়ের যাত্রাটাও আলাদা। আর এটাই শেষ কথা।

এটা কি সত্যি, বিসিবি আপনাকে চুক্তি নবায়নের ব্যাপারে কিছু বলেনি?

ওটিস : বিসিবির কেউ আমার চুক্তি নবায়ন করার ব্যাপারে বলেনি, আমি চলে যাচ্ছি বলার আগ পর্যন্ত। এই ব্যাপারে এর বেশি কিছু বলতে চাই না।

নতুন কিছু দায়িত্ব পেয়েছেন। সেগুলোর জন্য শুভ কামনা রইল...

ওটিস : আপনাকে ধন্যবাদ।

এমএইচ/এটি/এনইউ/জেএস