গল্পটা একজন স্বপ্নবাজের। ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার’ মতো আপাত অবাস্তব এক স্বপ্নবাজ তিনি। লোকটা বিশ্বাস করেন, ‘ভালো হতে হবে সব জায়গায়।’ বিশ্বাসের থলিতে তিনি আরও যোগ করেন, ‘স্বপ্ন ও স্বপ্ন; আর করে দেখানোর স্পৃহা।’

‘লিভ দ্য ন্যাশনাল এনথম: জাস্ট বি গুড’ এমন শিরোনামে একটা ভিডিও পাওয়া যায় ইউটিউবে। শুরুতে দেখে আপনার মনে হতে পারে বক্তা কোনো মোটিভেশনাল স্পিকার। আদতে তিনি তা নন, তার পেশা ফুটবল কোচিং। ভদ্রলোক সম্পর্কে আরেকটু খোঁজ-খবর নিলে জানতে পারবেন তিনি তার দলকে ‘৩৬ বছর পর বিশ্বকাপে নিয়ে গেছেন। এরপর বলেছেন, ‘ভক্তরা আমাকে বিশ্বাস করেনি।’

আপনি ভাবছেন বক্তা অর্থাৎ জন হার্ডম্যান নামক ভদ্রলোকও তাহলে বিশ্বাস করতেন না? আপনার ভাবনার ভুলটা তাহলে বেশ বড়সড়ই। তবে এটুকু প্রশ্ন তোলা যায় তার দল অর্থাৎ কানাডার খেলোয়াড়রা বিশ্বাস করতেন কি না, উত্তরটা আসলে না। ওই প্রসঙ্গ পরে। হার্ডম্যানের সম্পর্কে আগে টুকটাক জেনে নেওয়া যাক।

ইংল্যান্ডে জন্ম। বেড়ে উঠা ডারহামে। ঘরের পাশের নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের পাড় সমর্থক। পরের তথ্যটার জন্য আপনি নিশ্চয়ই প্রস্তুত থাকবেন না- হার্ডম্যান কোচিং শুরু করেছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। যেন জন্ম থেকে কোচই হতে চেয়েছিলেন তিনি। এক বছর পর প্রথমবারের মতো উত্তীর্ণ হন এফএ কোচিংয়ে। সান্ডারল্যান্ডেই কাটে কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুটা। 

স্নাতোকত্তোর শেষ করে ২০০১ সালে তিনি পাড়ি জমান নিউজিল্যান্ডে, একটা রাজ্য দলের দায়িত্ব নিতে। পরিবার নিয়ে ভিন দেশে যাত্রা-জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত নিতে দুবার ভাবেননি তিনি, হার্ডম্যানদের আসলে ভাবলে চলেও না। তাসমান সাগড় পাড়ের দেশে আসার পাঁচ বছর পর পান দেশটির নারী দলের দায়িত্ব। হার্ডম্যানের ম্যাজিকের শুরু হয় সেখানে। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক, ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের মেয়েরা খেলে তার অধীনে।

হার্ডম্যানের সামনে তখন আরও এক ‘হার্ড ডিসিশন’। প্রস্তাব এল কানাডার নারীদের দায়িত্ব নেওয়ার। এই প্রস্তাবের অপেক্ষা অবশ্য চলছিল তিন বছর ধরেই। ২০০৮ সালেই তার চাকরিটা পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পাননি। কানাডা ফুটবল ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা কথা দিয়েছিলেন, যোগাযোগ রাখবেন। সত্যিই রেখেছিলেন তিনি, তিন বছর ধরে।

এরপর ২০১১ তে হার্ডম্যানের কাছে ফোন গেল তার, ‘আমাদের এখন লাগবে তোমাকে।’ হার্ডম্যান জানতেন, দেশটিতে নারীদের ফুটবলের পাত্তা আছে। তিনি রাজি হলেন। ২০১১ বিশ্বকাপে সবার শেষে থাকা কানাডার মেয়েদের পরের অলিম্পিকে জেতালেন ব্রোঞ্জ! ঘটে গেল ম্যাজিক!

কীভাবে ঘটল? একদম শুরুতে বলা ভিডিওতে তার ব্যাখ্যাই করেছেন হার্ডম্যান। এক কথায় বলতে গেলে কেবল ‘ভালো’ হওয়ার বার্তা দিয়ে। মাঠে, মাঠের বাইরে; প্রকাশ্যে-আড়ালে সব জায়গায় তিনি ভালো হতে বলতেন মেয়েদের। দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলেছিলেন, বলতেন ‘জাতীয় সংগীতটাকে ধারণ করো’।

আপনি ভাবছেন হার্ডম্যানের জাদুর পর্ব শেষ হয়ে গেছে? আরও একবার ভুল করে ফেললেন তাহলে! হার্ডম্যানের হাতে তুলে দেওয়া হলো এবার ছেলেদের দায়িত্ব। যে ভিডিওর কথা বারবার বলা হচ্ছে, তার মন্তব্যের ঘরে একজনের সংশয় দেখতে পাবেন স্ক্রল করে গেলে; হার্ডম্যান আসলেই পারবেন কি না ছেলেদের দল সামলাতে!

কিন্তু দায়িত্ব সামলানো তো কাছের পথ, হার্ডম্যান বললেন ‘আমরা বিশ্বকাপ খেলবো’। এমন কথা তো অনেক কোচই বলেন, তাহলে তারটা আলাদা কেন? কারণ হার্ডম্যানই কানাডায় থাকা ‘একমাত্র লোক হিসেবে বিশ্বাস করতেন এই কথা।’

ছেলেদের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দিনই হার্ডম্যান হাজির হলেন একটা ভিডিও নিয়ে। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ সালের ভিডিও। ওই বারই প্রথম ও শেষবারের মতো বিশ্বকাপ খেলেছিল কানাডা। 

দলের সবচেয়ে বয়স্ক ফুটবলার ও অধিনায়ক আটিবা হাটচিনসনের বয়স ৩৯- তখন কেবল দুই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বুড়ো খেলোয়াড় স্টিভেন ভিটোরিয়া ও মিলান বুরজানের জন্মই হয়েছে বিশ্বকাপের এক বছর পর। কোচের নিজের বয়স অবশ্য তখন দশ।

হার্ডম্যান বহু পুরোনো সেই ভিডিও প্লে করলেন। বললেন, ‘দেখো আমরা কত দূর গিয়েছিলাম আর কত কাছাকাছি আছি।’ লক্ষ্যটা দলের সঙ্গে স্পেনে নিজের প্রথম দেখাতেই পরিষ্কার করেছিলেন হার্ডম্যান। তিনি সেরা হতে চাইতেন, জানতেন তাহলে কানাডাকে তুলে ধরা যাবে ফুটবলের দেশ হিসেবে। 

আপনার হয়তো এতক্ষণে জানা হয়ে গেছে, কানাডা বিশ্বকাপে খেলবে। হার্ডম্যান কী করেছেন এতে? তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে কানাডা ছিল ৯৪ নম্বরে, এখন? ৩৩। 

হার্ডম্যান থামতে চান না এখানেই। থামাটা যে তার ডিএনএতেই নেই। ইংল্যান্ডে থাকতে জাতীয় দলের এক ফুটবলারের ছেলেকে কোচিং করাতেন। একদিন ওই ফুটবলার এসে হার্ডম্যানকে থামিয়ে দিলেন এই বলে, ‘দেখো জন, তুমি খুব ভালো শিক্ষক। কিন্তু ৬০ হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে খেলার অভিজ্ঞতা তোমার নেই। এজন্য কখনও তুমি শীর্ষ পর্যায়ে যেতে পারবে না।’

হার্ডম্যানের মাথায় সবসময় আটকে থাকে কথাটা। তিনি তাই নিজেকে প্রমাণ করতে চান বারবার। বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়ার পর কানাডার মানুষকে প্রতিশ্রুতি দেন আরও বড় কিছু করার। সঙ্গে দিয়ে দেন একটা বার্তাও, ‘কানাডিয়ান...তোমাদের ছেলে আলফানসো ডেভিস বায়ার্ন মিউনিখে খেলে, তোমাদের অনেক ছেলেরা ইউরোপের শীর্ষস্তরে আছে। এখন তোমাদের এমন কানাডিয়ান আছে, যারা বিশ্বকাপ খেলতে যাবে।’

কানাডিয়ানরা চাইলে হার্ডম্যানের স্বরেই বলতে পারেন, ‘বিশ্ববাসী...আমরা ৩৬ বছর বিশ্বকাপ খেলিনি। কিন্তু তখন আমাদের হার্ডম্যান ছিল না। এখন আছে। আমরা লড়াই করতে জানি, করব।’ হার্ডম্যান স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন দেখেন। বিশ্বাস করেন। করে দেখান। আর প্রমাণ করেন- স্বপ্নরা কখনও মিথ্যে হয় না। তাই- স্বপ্ন দেখতে হয়, স্বপ্ন দেখার কোনো বিকল্প নেই।