চোখের পলকেই যেন কেটে গেল এক মাস। মনে হয় এইতো সেদিন সকালে ফিফা মিডিয়া অ্যাক্রিডিটেশন সংগ্রহ করলাম। এরপর ১৫ নভেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর, কেটে গেল ৩৫ দিন। 

২০ নভেম্বর আল খোরের আল বায়াত স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছিল কাতার বিশ্বকাপ। ইকুয়েডর মিনিট দশেকের মধ্যেই গোল করে উৎসব করছিল। এর এক মিনিট পরেই ভিএআরের মাধ্যমে সেই গোল বাতিল হয়। মুহুর্তের মধ্যেই বদলে গিয়েছিল স্টেডিয়ামের আবহ। সেই থেকে যে শুরু প্রায় প্রতি ম্যাচেই বিশ্বকাপের রং ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে।
 
বিশ্বকাপ যেমন আনন্দের আবার বেদনারও। চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি গ্রুপ থেকেই বিদায় নিয়েছে। এশিয়ার দল জাপান দুই বিশ্ব সেরার গ্রুপ থেকে সেরা হয়েও পরের পর্বে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হোঁচট খেয়েছে। যে ক্রোয়েশিয়া পাঁচ বারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে ছক এঁকে আটকে দিয়েছিল ১২০ মিনিট। সেই ক্রোয়েশিয়া আবার আর্জেন্টিনার কাছে ০-৩ গোলে হেরে ছন্নছাড়া।

এই বিশ্বকাপ দেখেছে প্রত্যাবর্তনের গল্পও। সৌদির বিপক্ষে হারা আর্জেন্টিনা গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদের শঙ্কায় ছিল। সেখান থেকে বাকি ছয় ম্যাচ তারা অপরাজিত। কোয়ার্টার ফাইনাল ও ফাইনালে টাইব্রেকার পাড়ি দিতে হয়েছে মেসিদের।
 
ম্যারাডোনা মৃত্যুর পর এটাই প্রথম বিশ্বকাপ। ম্যারাডোনার শিষ্য লিওনেল মেসির পারফরম্যান্স ’৮৬ বিশ্বকাপের ম্যারাডোনাকেই স্মরণ করিয়েছে। ৩৫ বছর বয়সে নিজে করেছেন ৭ গোল, অন্যদের দিয়েও করিয়েছেন। বিশ্বকাপ ইতিহাসে একমাত্র ফুটবলার হিসেবে দু’টি গোল্ডেন বল জেতার কৃত্তিত্বও তার।

মেসি যখন আরাধ্য বিশ্বকাপে চুমু খাচ্ছেন, তখন তার সমকালীন প্রতিদ্বন্দ্বি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো পুরনো ক্লাব মাদ্রিদে অনুশীলন করছেন। এক সময় মেসির সঙ্গে পাল্লা দেয়া রোনালদোর এবার বিশ্বকাপ কেটেছে খুব করুণভাবে। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে ঝামেলা ছিল। নক আউটের আগেই ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন। এরপর দুই ম্যাচ রোনালদোকে একাদশেই রাখেননি কোচ। কাতার বিশ্বকাপে ফিট রোনালদো সাইড বেঞ্চে এমন দৃশ্যও দেখেছে।

রোনালদোর পর্তুগালের বিশ্বকাপ যাত্রা থামিয়েছে মরক্কো। এই মরক্কো এবার বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়াকে পেছনে ফেলে গ্রুপে সেরা। পরের পর্বে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনকে বিদায় করেছে আফ্রিকার দেশটি। সেমিফাইনালে দারুন লড়লেও এমবাপ্পের ফ্রান্সের বিপক্ষে আর পেরে উঠেনি।
 
কাতার বিশ্বকাপ মেসিকে ট্রফি যেমন দিয়েছে তেমনি দেখিয়েছে ট্র্যাজিক হিরো। ১৯৬৬ সালের পর বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে হ্যাটট্রিক দেখেছে বিশ্ব। জিওফ হার্স্ট হ্যাটট্রিক করে ইংল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। এমবাপেও হ্যাটট্রিক করেছেন। টাইব্রেকারে প্রথম শটও গোল করেছেন। এরপরও ফ্রান্স না জেতায় ট্র্যাজিক হিরোই থেকেছেন। চার বছর আগে এমবাপ্পে হাসলেও গতকাল কেঁদেছেন। এর উল্টোটা হয়েছে মেসির। আট বছর আগে মারাকানায় কাদলেও লুসাইলে হাসলেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা।

মেসিদের আগে এশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল। তাই পুনরায় এশিয়ার বিশ্বকাপে তিতের দলই ছিল অন্যতম ফেভারিট। ক্যামেরুনের বিপক্ষে পরীক্ষা-নিরীক্ষার হার ছাড়া অসাধারণ ফুটবলই খেলেছিল দলটি। গোলের পর সাম্বা নৃত্য দারুণ মাত্রা এনেছিল বিশ্বকাপে। সেই নেইমরারা ক্রোয়েশিয়ার জালে আটকে পড়লেন শেষ আটে। নিজেদের ফিনিশিং ব্যর্থতা আর কোচ তিতের খানিকটা ভুল কৌশলেই বিদায় ঘন্টা বাজল সর্বোচ্চ বার চ্যাম্পিয়নদের।
 
সারা বিশ্ব ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সেমিফাইনাল হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। ব্রাজিল হারায় সেটি আর হয়নি। কিন্তু বিধাতা যে লিখে রেখেছেন আরও বিশেষ কিছু। আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ফাইনাল যে বিশ্বকাপের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ম্যাচ। ২-০ গোলে মেসির আর্জেন্টিনা ৭৯ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে ছিল। ২ মিনিটে দুই গোল করে সমতা আনেন এমবাপে। অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে আবার মেসির গোল। লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের গর্জন। সেটা তৃতীয় বারের মতো নিস্তব্ধ করলেন এমবাপে। খেলা গড়াল টাইব্রেকারে। এই অঙ্কে শেষ হাসি হাসলেন মেসি। বিধাতা এটাই লিখদেছে

এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা শিরোপা জিতলেও প্রকৃত চ্যাম্পিয়ন ফুটবল। সারা বিশ্ব গত এক মাস বুঁদ হয়ে ফুটবল দেখেছে। কেউ কখনো হেসেছে আবার কখনো কেঁদেছে। দিন শেষে জয়টা হয়েছে ফুটবলেরই। ফুটবলের মতো চ্যাম্পিয়নটা স্বাগতিক কাতারও। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম স্বাগতিক হিসেবে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়া এবং কোনো ম্যাচ না জেতার নেতিবাচক রেকর্ড গড়লেও আয়োজনের দিক থেকে তারা সর্বকালের সেরা হওয়ার কাছাকাছি। পশ্চিমা মিডিয়া ছোট্ট এই দেশে বিশ্বকাপ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা করেছে অনেক। মিডিয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা নাগরিকরা মদ্যপান, সমকামীতা ইস্যুতে যথেষ্ট কাতার বিরোধী ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাতারে আয়োজন মুগ্ধ করেছে তাদেরও। শত সমালোচনা সত্ত্বেও তারা ইসলামী মূল্যবোধ সাথে নিয়ে ফুটবল উৎসব করেছেন। মাঠের কাতার গ্রুপ পর্বে বিদায় নিলেও মাঠের বাইরে কাতার ঠিকই চ্যাম্পিয়ন !

এজেড/এনইআর