আর্থিক অসঙ্গতি নিয়ে অনেকদিন ধরেই নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে)। যার ফল দেশীয় ফুটবলের অভিভাবক সংস্থাটি বেশ বড়সড়ভাবেই পেয়েছে। বাফুফের আর্থিক লেনদেনে বড় অসঙ্গতির প্রমাণ পেয়েছে ফিফা। ৬ কোটি ৩৫ লাখ ৮৮ হাজারেরও অধিক টাকার লেনদেন নিয়ে মোটাদাগে অভিযুক্ত হয়েছে বাফুফে এবং সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ। দায়িত্বশীল জায়গা থেকে প্রায় প্রতিটি লেনদেনের নথিতে স্বাক্ষর করায় ফিফা সোহাগকে ফুটবল থেকে দুই বছর নিষিদ্ধ ও প্রায় ১২ লাখ টাকা (১০ হাজার সুইস ফ্রা) জরিমানা করেছে।

শুরু থেকে চারটি ধারায় আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি তদন্তের পর মোটাদাগে প্রমাণিত হয়েছে তিনটি অনিয়ম। অনিয়মগুলো হচ্ছে- ফিফার তহবিলের জন্য নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে নগদে টাকা উত্তোলন করা, ফিফা সম্পর্কিত প্রকল্প বা প্রোগ্রামে অন্য অ্যাকাউন্টের টাকা ব্যবহার এবং ফিফা তহবিলের টাকা ভিন্ন খাতে ব্যয় করা। নিয়মানুযায়ী ফরোয়ার্ড ফান্ডের অর্থ খরচের নির্দিষ্ট কিছু খাত আছে। এই অর্থ নির্দিষ্ট একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখাটা ফিফার নিয়মে বাধ্যতামূলক। লেনদেনও শুধু সেখান থেকেই করার নিয়ম। কিন্তু সেটি বারবারই লঙ্ঘন করেছে বাফুফে।

সোহাগ ও বাফুফের অর্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মোট ৪টি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে- ধারা ১৫ (সাধারণ কর্তব্য), ধারা ১৩ (আনুগত্যের দায়িত্ব), ধারা ২৪ (জালিয়াতি ও মিথ্যাচার) ও ধারা ২৮ (তহবিল তছরুপ ও অপব্যবহার)। এসব ধারার অধীনে ফিফার দেওয়া অনুদানে যথেচ্ছ ব্যবহার এবং কেনাকাটায় বড় ধরনের গলদ পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন : ‘ফিফার প্রতিবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পক্ষপাতদুষ্ট’

  • ফিফার তহবিলের জন্য নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে নগদে টাকা উত্তোলন করা
  • ফিফা সম্পর্কিত প্রকল্প বা প্রোগ্রামে অন্য অ্যাকাউন্টের টাকা ব্যবহার
  • ফিফা তহবিলের টাকা ভিন্ন খাতে ব্যয় করা

শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) ফিফার স্বাধীন এথিকস কমিটির বিচারিক চেম্বার এ বিষয়ে মোট ৫১ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে লেনদেন নিয়েই এই অভিযোগের তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত শুরু হয় ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর। পরবর্তীতে ফিফার সদর দফতরে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত শুনানিতে সোহাগ ও তার আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

তদন্ত চলাকালে ফিফার বিচারিক চেম্বার বাফুফের বেশ কয়েকটি লেনদেনের বিশ্লেষণ করেছে। এর ভেতর চারটি খাতের লেনদেন নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে ওই কমিটি। ওই বিশ্লেষণে তারা ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪ মার্কিন ডলার লেনদেনে আর্থিক অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ ৮৮ হাজারেরও অধিক। তবে এটি যাচাইকৃত লেনদেনের ১৭.৭৩ শতাংশ।  তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি কোনোভাবেই তুচ্ছ বিবেচনা করা যায় না।

আরও পড়ুন : সোহাগ নিষিদ্ধ, জরুরি সভাও বাতিল

বাফুফের চারটি খাতে কেনাকাটা নিয়ে বড় অসঙ্গতি পেয়েছে ফিফা
ক্রীড়া সরঞ্জাম (পরিধেয় সামগ্রী) ক্রয়, ফুটবল কেনা, বিমানের টিকিট এবং ঘাস কাটার যন্ত্র বাবদ বড় লেনদেনের কথা জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে। এসব খাতে কেনাকাটায় যথাযথ তথ্য ও লেনদেনে স্বচ্ছতার ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে দরপত্র আহবানকারী প্রতিষ্ঠান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তাদের সঙ্গে লেনদেনপূর্ব নিয়ম-কানুনও সঠিকভাবে মানা হয়নি বলে জানায় বিচারিক কমিটি।

ক্রীড়া সরঞ্জাম (পরিধেয় সামগ্রী) ক্রয়, ফুটবল কেনা, বিমানের টিকিট এবং ঘাস কাটার যন্ত্র বাবদ বড় লেনদেনের কথা জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে। এসব খাতে কেনাকাটায় যথাযথ তথ্য ও লেনদেনে স্বচ্ছতার ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে দরপত্র আহবানকারী প্রতিষ্ঠান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তাদের সঙ্গে লেনদেনপূর্ব নিয়ম-কানুনও সঠিকভাবে মানা হয়নি বলে জানায় বিচারিক কমিটি।

ক্রীড়া সরঞ্জাম (পরিধেয় সামগ্রী) ক্রয়
আবাসিক ক্যাম্প ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ম্যাচের জন্য ২০২০ সালে ক্রীড়া সরঞ্জাম (পরিধেয় সামগ্রী) ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানে তিনটি প্রতিষ্ঠান স্পোর্টস লিংক, স্পোর্টস কর্নার ও রবিন এন্টারপ্রাইজ দরপত্র জমা দেয়। পরবর্তীতে সেই কাজ পায় স্পোর্টস লিংক। কিন্তু সেখানে তিনটি প্রতিষ্ঠানই একে অপরের সঙ্গে ‍যুক্ত বলে কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপের তদন্তে উঠে আসে। এছাড়া রবিন এন্টারপ্রাইজের দরপত্রে যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেটি ভুয়া। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান স্পোর্টস কর্নার আর স্পোর্টস লিংক পাশাপাশি ঠিকানায় অবস্থিত এবং ধারণা করা হচ্ছে রবিনই উভয় প্রতিষ্ঠানেরই মালিক। যার কারণে তিন প্রতিষ্ঠানের একই উৎস থেকে দরপত্র আহবান করেছে বলে ধরে নিয়েছে তদন্ত কমিটি।

ফুটবল কেনা
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ফুটবল ক্রয়ের জন্য বাফুফের আহবানে দরপ্রস্তাব দেয় তিনটি প্রতিষ্ঠান—মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এইচ ইউ জামান ট্রেডিং ও ওফেলিয়াস ক্লোজেট। পরবর্তীতে দরপ্রস্তাবে জেতে ওফেলিয়াস। সোহাগের সরবরাহ করা সেই কাগজে লেখা হয়, ‘ফিফা অনুমোদিত বাফুফের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ২০১৯–২০ মৌসুমের ম্যাচ পরিচালনার জন্য এই কেনাকাটা জরুরি।’ ব্যাখ্যায় বলা হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ক্রীড়াপণ্য সরবরাহ করে থাকে।

তার সেই দাবির বিপরীতে প্রতিবেদন দেয় কন্ট্রোল রিস্ক। যেখানে তারা বলছে, ওফেলিয়াস ক্লোজেটের ব্যবহৃত ঠিকানায় তাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তারা নারীদের পোশাক বানায়। এটি বাফুফেকে ফুটবল সরবরাহের প্রতিষ্ঠান নয়। মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের দরপ্রস্তাবে তাদের খুঁজে পাওয়ার মতো তথ্য নেই। কোনো সিলও নেই দরপ্রস্তাবে। প্রতিষ্ঠান তিনটির দরপত্র বানানো বলে উল্লেখ করেছে তদন্ত কমিটি। একইসঙ্গে মারিয়া ও জামান ট্রেডিংয়ের কাগজও ফটোকপি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিমানের টিকিট
২০১৯ সালের জাতীয় দলের ওমান সফরের জন্য বিমানের টিকিট আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনালকে ১৯ হাজার ৯২৫ ডলার (প্রায় সোয়া ২১ লাখ টাকা) দেয় বাফুফে। ওই কাজে মারওয়া ছাড়াও পূরবী ইন্টারন্যাশনাল ও মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস দরপ্রস্তাব দিয়েছিল। তিনটি দরপ্রস্তাবই শুরু হয়েছে একই কথা দিয়ে, যেখানে রুট শব্দটি একই বানানে লেখা ‘rout’। সব কটিতে সংখ্যার ভুল একই রকম (১, ৩, ৪), একই তারিখে জমা দেওয়া এবং দেখতে একই রকম। পূরবী জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিমানের টিকিট কেনায় দরপ্রস্তাব দেওয়ার কথা নয় বলে উল্লেখ করে কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপ। পূরবী ও মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, তারা দরপ্রস্তাব দেয়নি। বাফুফের সঙ্গে কোনো কাজও করেনি।

ঘাস কাটার যন্ত্র
২০২০ সালের ১ হাজার ৪১২ মার্কিন ডলারে (প্রায় দেড় লাখ টাকা) ঘাস কাটার যন্ত্র কেনে বাফুফে। যার জন্য বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার, আরেকটি শোভা এন্টারপ্রাইজ দরপ্রস্তাব দেয়। তবে কাজ পায় বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার। এখানে পাওয়া অনিয়মের মধ্যে আছে বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার প্রতিষ্ঠানের নামের বানানে ভুল। শোভা এন্টারপ্রাইজ আর শারমিন এন্টারপ্রাইজের দরপ্রস্তাব দেখতে এক রকম। শারমিন এন্টারপ্রাইজে যোগাযোগ করলে তারা নিজেদের শোভা এন্টারপ্রাইজ হিসেবে পরিচয় দেয়। বাংলাদেশ হার্ডওয়্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

এএইচএস