ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সবই ছিল সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ছিলেন সোহাগের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা, মিডিয়া কিংবা ফুটবল সংশ্লিষ্ট কারো কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে সালাউদ্দিন প্রায়ই বলতেন, 'টক টু সোহাগ।' অথচ তিন দিনেই বদলে গেল দৃশ্যপট। ফেডারেশনের এত আস্থাভাজন ব্যক্তিকে এখন অনেক কর্তাই যেন চেনেন না!

ফিফার ৫১ পাতার রিপোর্টে বাফুফের আর্থিক নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি ওঠে এসেছে। ফিফা ফরোয়ার্ড প্রোগ্রাম থেকে প্রাপ্ত অর্থ অন্য খাতে ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ফিফার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফরোয়ার্ড প্রোগ্রামের অর্থ ক্লাবগুলোকে প্রদান করা হয়েছে। যা এই প্রোগ্রামের পরিপন্থি।

বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী একই সঙ্গে ফিন্যান্স ও লিগ কমিটির চেয়ারম্যান (এই মৌসুমে কাজী সালাউদ্দিন নিজেই লিগ কমিটির চেয়ারম্যান) ছিলেন। এক খাতের অর্থ অন্য খাতে ব্যয়ের পেছনে তার সম্মতি বা নির্দেশনা ছাড়া ব্যয় হওয়ার কথা নয়। এরপরও তিনি নিজের ও ফিন্যান্স কমিটির ভুল দেখছেন না। সালাম মুর্শেদী বলেন, 'আমাদের কমিটির কোনো ভুল নেই। আমরা তার কাজের দায় নেব না। সে প্রক্রিয়াগত ভুল করেছে।’

প্রক্রিয়াগত ভুলের ক্ষেত্রেও সোহাগ এককভাবে দায়ী নয়। বাফুফের অর্থ বিভাগের দায় রয়েছে। তারা আর্থিক বিষয়ে জড়িত। বাফুফের অর্থ বিভাগের এক্সিকিউটিভদের অযোগ্যতা ফুটবলাঙ্গনে সবারই জানা। সাম্প্রতিক সময়ে বাফুফের এক্সিকিউটিভদের মাসিক বেতনের হিসাবে গড়মিল হয়েছে। বেতনের হিসাবে গড়মিল হলে ফিফা-এএফসির আর্থিক কমপ্ল্যায়েন্স এরা কিভাবে পালন করে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

সোহাগের আর্থিক অনিয়ম ও কেনাকাটার অসঙ্গতির চিঠি পেয়েছিলেন প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আবু হোসেন ও ফিন্যান্স এক্সকিউটিভ অনুপম সরকার। এই দুই জনের উপর আর্থিক অভিযোগ গুরুতর। এদেরকে চাকরিচ্যুত করার প্রস্তাব দিয়েছেন বাফুফের এক প্রভাবশালী সহ-সভাপতি। ফিফা সোহাগের ওপর শাস্তি দিয়েছে, তবে তাদের ব্যাপারে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। ফলে এখনও শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন এই দুই এক্সিকিউটিভ।

ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীও চিঠি পেয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তার ওপর দায় বর্তালেও তিনি কোনোভাবেই এই দায় নিতে রাজি নন। তিনি বলেন, 'ফিফা-এএফসির অনেক চিঠিই আসে। আমার চিঠিতে ওমন কিছু নেই।'

সালাম মুর্শেদীর চিঠি অবশ্য খুব বেশি গুরুতর নয় হিসেবেই ধরা যায়, কারণ তাকে জুরিখ গিয়ে সাক্ষ্য দিতে হয়নি। সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগের কর্মকান্ড এবং অতিমাত্রায় ক্ষমতার ব্যবহারে ঢাল হিসেবে ছিলেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। জুরিখে গিয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার পরও তিনি সোহাগের পক্ষেই সাফাই গেয়েছিলেন। সালাউদ্দিন বলেছিলেন, 'আমি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। আমাকে কিছুই জানায়নি ফিফা।' অথচ ফিফার নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসার পর পালটে গেছে তার সুর। সোহাগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর তিনি বলেছেন, 'যখন জুরিখ গিয়েছিল, তখনই আঁচ করেছিলাম এরকম কিছু হতে পারে।'

সোহাগ ও অভিযুক্তরা জুরিখ থেকে আসার পর এক সহ-সভাপতি তাদেরকে কর্ম থেকে সাময়িক অব্যাহতি প্রদানের কথা বলেছিলেন। বাফুফে সভাপতি সেই পরামর্শ গ্রহণ করেননি, উল্টো সোহাগের প্রতি নির্ভরতা আরো বাড়িয়েছেন। ২০১২-২০২৩ পর্যন্ত বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন সাবেক জাতীয় অধিনায়ক আরিফ হোসেন মুন। ফিফার এই নিষেধাজ্ঞায় সোহাগ অনেকটা বলির পাঠাই হয়েছেন বলে তার ধারণা, 'সোহাগ বেতনভুক্ত সাধারণ সম্পাদক। তিনি উর্ধ্বতনদের নির্দেশনাতেই চলেন। উর্ধ্বতনদের বাঁচাতে হয়তো তিনি নিজের কাঁধেই সব দোষ নিয়েছেন।’ 

আরও পড়ুন>>> সোহাগ ইস্যুতে ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি

তবে ফিফার ৫১ পাতার রিপোর্টে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কিছুটা তদারকির অভাব থাকলেও সোহাগের দায় স্পষ্ট। সোহাগের অবস্থান ছিল বাফুফে ও ফিফার সেতুবন্ধনকারী হিসেবে। বাফুফে সোহাগকে নিয়োগ দিলেও ফিফার অর্থায়নে তার সম্মানী হতো। ফিফার কমপ্ল্যায়েন্স রক্ষা করা ছিল তার দায়িত্ব। এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি এএফসি ম্যাচ কমিশনার, ফিফার সাব কমিটির সদস্য, বাফুফের সাধারণ সম্পাদক। এত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি হয়েও ফিফার কম্পল্যায়েন্স রক্ষা করতে না পারায় তার ওপর এই খড়গ।

বাফুফের স্টাফদের একটা অংশ কমিশনের সঙ্গে জড়িত এমন গুঞ্জন দীর্ঘদিন থেকেই। বাফুফের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সোহাগের ওপরই সকল কিছু ছেড়ে নিজেরা নির্ভার ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক বাফুফের দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি শীর্ষ কর্তাদের ব্যক্তিগত অনেক কাজও করতেন। অনেক কর্মকর্তা তাদের ব্যবসায়িক কাজেও সোহাগকে দিয়ে চিঠি-পত্র লিখিয়েছেন এবং সশরীরেও অনেক অফিস-আদালতে পাঠিয়েছেন। সেই তারাই ফিফার নিষেধাজ্ঞা আসার পর ৩৬০ ডিগ্রি মোড় নিয়েছেন।

বাফুফে সোহাগকে নিয়োগ দিলেও ফিফার অর্থায়নে তার সম্মানী হতো। ফিফার কমপ্ল্যায়েন্স রক্ষা করা ছিল তার দায়িত্ব। এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি এএফসি ম্যাচ কমিশনার, ফিফার সাব কমিটির সদস্য, বাফুফের সাধারণ সম্পাদক। এত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি হয়েও ফিফার কম্পল্যায়েন্স রক্ষা করতে না পারায় তার ওপর এই খড়গ।

গতকালের সভায় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিয়োগের পাশাপাশি আবু নাইম সোহাগকে বাফুফে থেকে আজীবনের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাফুফে। মজার ব্যাপার হল, আজীবন বহিষ্কারের পর আবার তার বিষয় তদন্ত করার কথা জানিয়েছে ফেডারেশন। বাফুফের এমন সিদ্ধান্তকে এক অর্থে অযৌক্তিক মনে করছেন নির্বাহী কমিটির একজন, 'বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে আর সে থাকতে পারবে না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আবার তাকে নিয়ে তদন্ত করার কিছু নেই। এই তদন্তে যদি তার দোষ না প্রমাণিত হয় তখন কি হবে?'

আরও পড়ুন>>> বাফুফেতে আজীবন নিষিদ্ধ সোহাগ

সোহাগের নিষেধাজ্ঞায় ফুটবলাঙ্গনে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার লোকের সংখ্যাও কম নয়। গত এক দশকে অনেক কর্মকর্তা, ক্লাব বাফুফের নিষেধাজ্ঞা, জরিমানার খড়গে পড়েছিল। ভুক্তভোগী সবার আঙুলই সোহাগের দিকে। সোহাগ এতটাই ক্ষমতার ব্যবহার করতেন যে, কথায়-কথায় ফেডারেশনের অন্য এক্সিকিউটিভদের শোকজ, বেতন কাটার নির্দেশ দিতেন। এমনকি নির্বাহী কমিটির অনেকে শোকজ পেলেও তিনি ছিলেন ধরা-ছোয়ার বাইরে। ফিফার দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা বাফুফের আজীবনে রুপান্তরিত হওয়ার পেছনে পুঞ্জিভূত ক্ষোভও বড় কারণ।

বাংলাদেশ ফুটবল দলের কোচদের বিদায় যেমন সুখকর হয় না, তেমনি বাফুফে স্টাফদের বিদায়ের ইতিহাসও করুণ। সাবেক মিডিয়া ম্যানেজার আহমেদ সাঈদ আল ফাতাহ, রেফারিজ বিভাগের এক্সিকিউটিভ শহিদুল ইসলাম লিমন, সালাউদ্দিনের সাবেক সহকারী মনি বেগমের বিদায় সুখকর ছিল না। মনি বেগম বাফুফে থেকে চলে যাওয়ার পর ফেডারেশনে ঢুকতে পর্যন্ত পারেননি। আবু নাইম সোহাগের নির্দেশনায় এমন হয়েছিল, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তিনিই এখন ভবনে আজীবনের জন্য প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন।

এজেড/এইচজেএস/এফআই