সারা বিশ্বের ফুটবল ভক্তদের কাছে পিটার ড্রুরির পরিচয় ‘দ্য পোয়েট অব ফুটবল’ বা ফুটবলের কবি হিসেবে। ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বরের রাতে সেই পিটার ড্রুরির কণ্ঠে উচ্চারিত কিছু কথা হয়ত সব আর্জেন্টাইন ভক্তদের হৃদয়ে এখনও গেঁথে আছে। গঞ্জালো মন্তিয়েল পেনাল্টি নিলেন, বল জালে জড়ালো। ভরাট কণ্ঠে, নিখুঁত ব্রিটিশ উচ্চারণে ড্রুরি শোনালেন অনন্য কিছু শব্দ। ঠিক যেন কবিতার মতো… 

ট্যানগো নাচটা আর্জেন্টিনার রক্তে মিশে আছে। ছোট ছোট পদক্ষেপে একজন সঙ্গীকে নিয়ে নেচে যেতে হয় অবিরাম। ১৮৮০ সালের দিকে উরুগুয়ে আর আর্জেন্টিনায় এর শুরু। এরপর নানা বিবর্তনে ট্যানগো হয়ে গেল শুধুই আর্জেন্টিনার। ব্রিটিশদের কাছ থেকে শেখা লম্বা পাসের ফুটবলটাও আর্জেন্টিনা বদলে নিলো ট্যানগোতে। ছোট ছোট পাসের ফুটবলটাই আর্জেন্টিনা খেলেছে। সিজার মেনোত্তি আর কার্লোস বিলার্দো, দুই বিশ্বকাপ জেতানো কোচ ট্যাকটিক্সে যেমনই হোন, খেলিয়েছেন সেই ট্যানগো ধারার ফুটবলটাই। 

৮৬ সালের ম্যারাডোনা, ২২ এর মেসি

৮৬’ সালে ম্যারাডোনা মহানায়ক হয়েছিলেন। হবেন না কেন। একা হাতে বিশ্বকাপ জেতানো যায়, সেটা যে তিনিই করে দেখিয়েছিলেন। ৩ বছরে ২ বিশ্বকাপ পেয়ে আর্জেন্টিনা উড়ছে। ৯০’এ অবশ্য হয়নি বিতর্কিত ফাইনালের কারণে। ৯৪’ এ ম্যারাডোনার ডোপ কেলেঙ্কারি আর ৯৮ সালে ডেনিস বার্গক্যাম্পের অনবদ্য গোল। ২০০২ সালে ক্ষ্যাপাটে মার্সেলো বিয়েলসাও পারেননি আর্জেন্টাইন ট্যানগো ফুটবলটাকে বিশ্বকাপ পর্যন্ত টেনে নিতে। 

আর্জেন্টিনা তখন খুঁজছে আরও একজন ম্যারাডোনা। যে ছেলেটা বিশ্বকাপ জেতাবে। অ্যারিয়েল ওর্তেগা, হুয়ান রিকুয়েলমে, স্যাভিওলাসহ আরও অনেকের নামের পাশেই ‘নতুন ম্যারাডোনা’ শব্দটা জুড়ে বসেছিল। এদের সবাই প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সোনালি ট্রফি ঘরে আনতে পারেনি কেউই। 

২০০৬ সাল। কিছুদিন আগেই আর্জেন্টিনা জানতে পেরেছে তাদের নতুন দৈবশিশুকে নিয়ে। নাম লিওনেল আন্দ্রেস কুচেত্তিনো মেসি। এই ছেলেটা কেমন করে যেন খেলে। ঝাঁকড়া চুল। ডানপ্রান্তে দারুণ। সেই ছেলেটা বিশ্বকাপে অভিষেক করলো। গ্যালারি থেকে ম্যারাডোনা নিজেও উচ্ছ্বাস জানালেন সার্বিয়া এন্ড মন্টেনিগ্রোর বিপক্ষে ম্যাচের দিন। অভিষেকে এক গোল, এক অ্যাসিস্ট। তবে কোয়ার্টারের পর আর যাওয়াই হয়নি তাদের। ৯০ বিশ্বকাপের পর স্বাগতিক জার্মানি আরও একবার আর্জেন্টিনার পথ আটকালো। 

২০১০ সালে মেসি-ম্যারাডোনার জুটি পারেনি বিশ্বকাপের কাছে যেতে 

এরপর পেরুলো আরও চারটা বছর। সেই মেসি তখন বিশ্বসেরা খেলোয়াড়। আর্জেন্টিনার কোচ তখন স্বয়ং ম্যারাডোনা। মেসি তখন আর নতুন ম্যারাডোনা নেই। নিজের নামেই তিনি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বিশ্বকাপে মেসি গোল পেলেন না। আর্জেন্টিনারও যাওয়া হলো না বিশ্বকাপের কাছে। উল্টো আফ্রিকা মহাদেশেও সেই জার্মানির কাছেই ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া। মেসি ড্রেসিংরুমে বললেন, আমি আবার ফিরব। 

মেসি ফিরেছিলেন ২০১৪ সালে। নিজ মহাদেশে খেলা। আলেসান্দ্রো সাবেলা ঠিক ট্যানগো ধারার কোচ নন। ডিফেন্স শক্ত রেখে আক্রমণ করাই তার মূল শক্তি। মেসি ততদিনে বিশ্বসেরা হয়েছেন, প্রজন্মের সেরা হয়েছেন। সর্বকালের সেরার কথাও বলতে শুরু করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু সেজন্য চাই বিশ্বকাপ। সেই পথে অনেকটাই দলকে টেনে নিলেন মেসি। 

কিন্তু ফাইনালের আগে জানা গেল দুটো দুঃসংবাদ। দীর্ঘদিনের বন্ধু ডি মারিয়া খেলতে পারছেন না। ইনজুরিতে আক্রান্ত তিনি। থাকবেন না আরেক বিশ্বস্ত অস্ত্র ল্যাভেজ্জি। তবু হতে পারতো। মেসির শট অবিশ্বস্যভাবে সেদিন বাইরে চলে যায়, গঞ্জালো হিগুয়েইন মিস করে বসেন সবচেয়ে সহজ সুযোগটা। মারাকানায় জার্মানি আরও একবার স্বপ্ন কেড়ে নেয় লিওনেল মেসির। 

এত কাছে, তবু অনেক দূরে

ফাইনাল হারের সেই যন্ত্রণা ভুলতে মেসির লেগেছে ৮ বছর। মাঝে তিন ফাইনাল হেরে অবসর নিয়েছেন। পরে দেশের মানুষের ভালোবাসায় ফিরেও এসেছেন। পেয়েছেন নতুন প্রজন্মের অনেককে। রদ্রিগো ডি পল, অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার, এঞ্জো ফার্নান্দেজ, এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, হুলিয়ান আলভারেজ, এরা সবাই মেসির জন্যই খেলতে ভালোবাসে। মার্টিনেজ জানিয়ে দেন, মেসির জন্য যুদ্ধে যেতেও রাজি তিনি। 

যুদ্ধে তাকে যেতে হয়নি বটে। তবে পুরো দলটা যা করেছে তা মহাকাব্যের যেয়ে কম কিছু নয়। মেসি খেলেছেন, দলকে খেলিয়েছেন। কিন্তু এবার তিনি একা নন। অস্ট্রেলিয়া কিংবা নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে নায়ক বনে যান এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। মাঠে প্রতিপক্ষকে ছেড়ে কথা বলতে রাজি নন ডি পলরা। ৩৫ বছরের মেসি নিজেও অনেক বেশিই পরিণত। শান্ত স্বভাবের মেসি তখন বেশ খুনে মেজাজের। 

প্রতীক্ষার অবসান কাতারের মঞ্চে

১৮ ডিসেম্বর, ২০২২। আরও একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল। এদিন অবশ্য ভুল হয়না। ডি মারিয়া খেলতে নামেন। পেনাল্টি উপহার দেন দলকে। ২০১৬ তে মেসি পেনাল্টি মিস করে কোপা আমেরিকা খুইয়েছিলেন। সেই ভুল কাতারে আর হয়না। ডি মারিয়া আক্ষেপ মেটান গোল করে। কিন্তু ফ্রান্স যে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। কিলিয়ান এমবাপের জোড়া গোল, তাদের স্বপ্ন দেখায় টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপের। জিওফ হার্স্টের পর মাত্র দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করে বসেন তিনি। 

তবে কাতারের সেই রাতটা যেন শুধুই ট্যানগো ধাঁচের ফুটবলের। নয়ত র‍্যানডাল কোলো মুয়ানি ১২৩ মিনিটে অমন শট মিস করবেন কেন। মার্টিনেজই বা কী করে ঠেকিয়ে দিলেন সেই শট। মেসির দুই গোল, এমবাপের তিন। পেনাল্টিতে স্নায়ুযুদ্ধ চলে এমির আর প্রতিপক্ষের। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা জেতে আর্জেন্টিনা আর এমি মার্টিনেজই। 

পিটার ড্রুরির কণ্ঠে বারবার মানুষ মোহিত হয় তারপর থেকে। কেউ কেউ মুখস্থই করে রেখেছেন সেই শব্দগুলো। Lionel Messi has shaken hands with paradise. The little boy from rosario santa fe, has just pitched up in heaven. 

ড্রুরি কথা বাড়িয়ে বলেননি মোটেই। মেসি সেদিন হয়ত সত্যিই স্বর্গের দুয়ারে হাত রেখেছিলেন। সাত ব্যালন ডি’ অর, ছয়বার গোল্ডেন বুট, চারবারের প্লে-মেকার অ্যাওয়ার্ড, ফিফার বর্ষসেরা খেতাব কিংবা সর্বকালের সেরার খ্যাতি, সবটাই যে আটকে ছিল সেই সোনালী ট্রফির জন্যই। মেসির সেই অবিশ্বাস্য অর্জনের রাতটা নেমেছিল নিজ দেশ থেকে অনেকটা দূরে। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে। 

জেএ