গল্পেরা আঁকিবুঁকি খেলে সাদা কাগজে। গল্প তৈরি হয় আড্ডায়, রূপকথায়, শিশুকে মায়ের ঘুম পাড়ানিতে, ভালোবাসায়। কিছু গল্প তৈরি হয় মাঠেও, ফুটবল পায়ে। বিষণ্নতায়, হতাশায়, না পাওয়ার বেদনায় গল্প জমা হয়ে থাকে হৃদয়ে। স্মৃতির যন্ত্রণায়ও জমে থাকে সেসব।

গল্প লেখেন কে? কথা বলতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করা প্রিয় বন্ধুটি। অবুঝ শিশুর মায়েরা। ভালোবাসার নিষ্ঠুর প্রেমিক বা প্রেমিকাটি। গল্প তৈরি করেন মারিও গোৎজে, লিওনেল মেসিও। ১১৩ মিনিটে গোল করে নিজের দেশের বিশ্বকাপ জেতান মারিও, মেসি ভুলে যান পেনাল্টি শটে গোল করতে।

গল্পেরা তবুও জমা হয়ে থাকে। লিওনেল মেসির বেলায় কেবলই বিষণ্নতায়। তিনি ট্রফি ছুঁয়ে ফেলতে ফেলতে ফেলতেও পারেন না। নিজের করতে পারেন না একটা আন্তর্জাতিক শিরোপা। মারাকানায় তিনি কাঁদেন। ফটোগ্রাফারের ক্যামেরার ল্যান্স খুঁজে পায় একটা মুখ। চোখ ছলছল করা চেহারা। একটা ছবি বন্দি করেন তিনি। ছবিটা আটকে থাকে বোকাবাক্সে- ট্র্যাজেডি? তার বাস্তব উদাহরণ হয়ে।

মঞ্চটা আবারও এক। ব্রাজিল, রিও ডি জেনেইরো, ঐতিহাসিক মারাকানা। সব তৈরি। আগের বার অবশ্য গ্যালারি ভরা চিৎকার ছিল। থাকবে এবারও। তবে আর্জেন্টিনার হয়ে গলা ফাটাবেন কেবল ২, ২০০ সমর্থক। তবে মেসির জন্য গলা ফাটাবেন কোটি কোটি মানুষ, এমনকি তিনি যাদের বিপক্ষে মাঠে নামবেন; সেই ব্রাজিলের অনেক মানুষও মনের কোণায় জমা হওয়া প্রার্থনায় জায়গা দেবেন তাকে। মেসি নিশ্চয়ই সেটা জানেন?

সমর্থন না হয় পাওয়া গেল। কিন্তু মেসি যদি খুঁজে দেখেন ইতিহাস। আকাশি-সাদা জার্সিতে এখন অবধি চারবার ফাইনাল খেলেও যে জালের দেখা তিনি পাননি! এমন ইতিহাসে যদি সংখ্যাটা বাড়ে আরও এক ম্যাচ। মেসি কি বুঝেন না সেটা তার জন্য কতটা বেদনার হবে?

কারণটাও তো স্পষ্ট। এত বেশিবার তিনি গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়েছেন, খুঁজে পেয়েছেন জাল। তার চেয়ে বেশি আর ক'জনই বা গোল করেছেন এত বেশি, এমন সব ভঙ্গিতে। এমনকি বার্সেলোনার জার্সি গায়েও যখন মেজর টুর্নামেন্টের ফাইনালে মাঠে নেমেছেন। ১৬ ম্যাচের ১৩ টিতেই গোল করেছেন।

মেসি আর দেশের হয়ে ফাইনাল খেলতে পারবেন কি না, সংশয় অনেক এনিয়ে। আপাতত মেসি নিশ্চয়ই এবারের কোপা আমেরিকার ফাইনালটিকে বেছে নিতে চাইবেন পরিসংখ্যান বদলে দিতে? কিন্তু সেই পথে যে অনেক বড় বাধা।ক্যাসেমিরো-থিয়েগো সিলভার দেওয়াল। 

তবে মেসি যে বাধা টপকাতে কতটা পারদর্শী। বারবার তিনি সেটা দেখান বলেই তো উজ্জ্বল তারা হয়ে জ্বলজ্বল করেন ফুটবল আকাশে। ক্যাসেমিরোকে কীভাবে ফাঁকি দিতে হয়, সেটা ফুটবল বিশ্বে খুব কম লোকেরই জানার কথা। কী করে খুঁজে নিতে হবে সেলেসাওদের জাল, সেটিও।

তবে তাতে সমর্থন লাগবে ডি পল-ডি মারিয়াদেরও। তবেই না মেসির কাজটা সহজ হবে। ব্রাজিলকে হারানোর রণকৌশল সফল হবে লিওনেল মেসির দলের। চলে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত সময়। যার জন্য ২৮ বছরের অপেক্ষা বুইন্স এইরেসের।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে থাকা কোটি কোটি সমর্থকরা যে মুহূর্তটার জন্য প্রার্থনায় বসেছেন বারবার। এরপর মঞ্চে দেখেছেন তাদের হৃদয় ভেঙে যাওয়ার চিত্র। স্বপ্ন গুড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য। হতভম্ব হয়ে মনকে বুঝিয়েছেন পরেরবার হবে। আসলে হয়নি ২৮ বছরেও। শেষবার এই মারাকানাতেই তো, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখা হয়নি অল্পের জন্য।

মারিও গোৎজে শেষ করে দিয়েছিলেন সব। এবারও কি তেমন কিছু হবে? মেসি যদি আরেকবার প্রমাণ করেন- ফুটবল দেখলে তাকে ভালোবাসতেই হবে। এমিলিয়ান মার্টিনেজ যদি আরেকবার বাজপাখি হন। তার ভাষায়, 'যেটার জন্য আমরা ঘর ছেড়েছিলাম' সেটি হবে। 

ডি মারিয়া যদি আরেকবার নিজের ঝলক দেখান। ডি পল চেনান নিজেকে। লাউতারো ঠিকঠাক খুঁজে পান জালের দেখা। অথবা নায়ক হয়ে ওঠেন আকাশি-সাদা জার্সি গায়ের অন্য কেউ। তাহলে এই মৃত্যুর মিছিলেও, ভয়ের ভয়ংকরতার ভেতরও। ভোর রাতে চিৎকার করে উঠবেন কেউ।

তাতে ঘুম ভেঙে যাবে পাশেই শুয়ে থাকা ঘুম পাগল কারো। তিনি ঘুম ভেঙে জানতে পারবেন মেসি আন্তর্জাতিক শিরোপাটা পেয়ে গেছেন। ফুটবল না বুঝলেও তিনি নিশ্চয়ই রাগবেন না! অলিতে-গলিতে উৎসব হবে তা তো বলাই যায়। হয়তো হাসিহীন ঘরটাতেও একটু হলেও আনন্দ বয়ে যাবে।

মেসি তো এমনই মোহ জাগানিয়া। অ্যাসিস্ট কিংবা গোল করে ও করিয়ে তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ করতে পারেন কয় জন? তেমন কিছু আরেকবার ব্রাজিলের বিপক্ষে, মারাকানায় হলে কিন্তু মন্দ হয় না। 

এমন হলে হবে গল্প। মেসির ওই গল্পে আর বিষাদ ভর করবে না একটুও। থাকবে জয়ের হাসি। আনন্দের কান্না। উৎসবের আবহ। আনন্দ প্রকাশের অদ্ভুত সব ভঙ্গি। ধৈর্যের ফল পাওয়ার তৃপ্তি। মেসির অ্যাসিস্ট কিংবা গোলের গল্প লেখা হবে পাতায়। মেসির এবার গল্প দরকার। সাফল্যের গল্প। শিরোপা জয়ে গল্পটা তবে এবারই হোক... লিওনেল, হবে তো?