রেফারিং বিতর্কে উত্তাল দেশের ফুটবল। রেফারির সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে ক্লাবগুলো। রেফারিং নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনও।

রেফারিং নিয়ে সমালোচনায় কোড অফ কন্ডাক্ট ভঙ্গ করায় সাম্প্রতিক সাম্প্রতিক সময়ে বাফুফের শোকজ ও আর্থিক জরিমানা শিকার হয়েছে কিছু ক্লাব। রেফারিদের সম্মান ও স্বার্থ রক্ষায় বাফুফে যেখানে এমন ভূমিকায় সেখানে খোদ বাফুফে সভাপতি গত পরশু দিন সংবাদ মাধ্যমের সামনে সরাসরি বলেছেন যে রেফারির সিদ্ধান্ত এক দলের পক্ষে (বসুন্ধরা) ও আরেক দলের বিপক্ষে (সাইফের) যাচ্ছে। বাফুফে সভাপতির প্রকাশ্যে এমন বক্তব্যের পর ফুটবলাঙ্গনে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। 

দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ ব্যক্তি রেফারিং নিয়ে এমন মন্তব্য এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না সাবেক ফিফা রেফারি ও চার দশকের বেশি সময় রেফারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত এম আর মুকুল, ‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না উনি (সভাপতি) এটা বলেছেন। রেফারি ফুটবলের অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রেফারিদের শাস্তি, সমালোচনা সব কিছু গোপনীয়। আমি কখনো রেফারিং নিয়ে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য শুনিনি।’ সালাউদ্দিনের বক্তব্য সম্পর্কে সাবেক রেফারি মনসুর আজাদের প্রতিক্রিয়া, ‘দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের খেলার বিচারকদের সম্পর্কে সুবিবেচনা প্রসূত মন্তব্য করা প্রয়োজন। এমন কোনো মন্তব্য না করাই শ্রেয় যা খেলার বিচারকদের মানসিকভাবে প্রভাব ফেলে।’

দায়িত্বশীল পদে থেকে এমন মন্তব্য ফুটবল কর্তাদের নতুন কিছু নয়। এই রেফারিং ইস্যুতেই সিনিয়র সহ-সভাপতি ও রেফারিজ কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম মুর্শেদী কয়েক সপ্তাহ আগে বলেছিলেন, ‘বিদেশি রেফারি বুঝবে না কোনটা বড় দল কোনটা ছোট দল। রেফারিরা আইন অনুযায়ী বাঁশি বাজান তাদের কাছে বড়-ছোট দল বিবেচ্য নয়।’ 

রেফারিজ কমিটির চেয়ারম্যানের পর এবার সভাপতি সরাসরি রেফারিদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দুই ক্লাবের পক্ষ-বিপক্ষের কথা বলেছেন যা রেফারিদের জন্য খুবই দুঃখজনক। বাফুফে সভাপতির এমন মন্তব্যে অনেক বর্তমান ও সাবেক রেফারি অখুশি হয়েছেন। অনেকে নানা কারণে এর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হলেও এই দুই সাবেক রেফারি করেছেন। 

রেফারিদের শাস্তির ব্যাপারে ফিফা গোপনীয়তা রক্ষা করে। যা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনও অনুসরণ করে। এর কারণ সম্পর্কে মনসুর আজাদ বলেন, ‘ওই রেফারির প্রতি যেন কোনো দলের আস্থাহীনতা জন্ম না নেয় এবং ওই রেফারিরও যেন কোনো দলের প্রতি আক্রোশ বা দুর্বলতা না জন্মায়।’ যেখানে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে এত গোপনীয়তা সেখানে বাফুফে সভাপতির সরাসরি দু’টি দলের রেফারিং নিয়ে মন্তব্য করায় রেফারি ও ক্লাবগুলোর মধ্যে এক প্রকার বিশেষ ধারণা সৃষ্টি হলে মোটেও অমূলক হবে না। রেফারির দুই দলের পক্ষ-বিপক্ষের সিদ্ধান্তটা অনেকটা স্ববিরোধী বক্তব্য হলেও ফুটবলের স্বার্থে এমন মন্তব্যে কোনো সমস্যা দেখেন না বলে সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। অন্য দিকে ফুটবলের স্বার্থেই সঠিক বিষয়টি তুলে ধরেও সাম্প্রতিক সময়ে শোকজ পেয়েছেন বাফুফের এক সহ-সভাপতি ও শীর্ষ এক ক্লাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। 

সুনির্দিষ্ট দুটো ক্লাব নিয়ে মন্তব্য করলেও রেফারিং সমস্যার বিষয়টি সভাপতি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে দেখছেন বলে মন্তব্য করেছেন দুই সাবেক রেফারি, ‘সভাপতি খুব গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি দেখছেন যা ইতিবাচক। তিনি রেফারিদের সমস্যা অনুধাবনের চেষ্টা করছেন।’  

শনিবার বাফুফে ভবনে হেড অফ রেফারিজ আজাদ রহমানের সঙ্গে বসেছিলেন বাফুফে সভাপতি। পরের দিন রোববার কমলাপুর স্টেডিয়ামে শীর্ষ কয়েকজন রেফারি, সহকারী রেফারি নিয়ে আলোচনা করেন সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, লিগ কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান সহ আরো কয়েকজন। যেখানে ফেডারেশন কাপের সাইফ-আবাহনী ও লিগের বসুন্ধরা-পুলিশের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনাই বেশি হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে বিতর্ক এড়াতে বক্সের মধ্যে হাতে বল লাগলেই পেনাল্টি দেয়ার ব্যাপারে মতামত আসে। রেফারিরা বিষয়টি বিধি সম্মত নন বলে মন্তব্য করেন। পরবর্তীতে হেড অফ রেফারিজ আজাদ রহমান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতার বিষয় বিবেচনা করে রেফারিদের লজ অফ দ্য গেম সূচারুভাবে ও আরো সচেতনভাবে খেলা পরিচালনার অনুরোধ জানান। 

ঘরোয়া ফুটবলে রেফারিং নিয়ে বিতর্ক-সমালোচনা সব সময় ছিল। তবে এখন সেই বিতর্ক সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। বিষয়টি ক্রমান্বয়ের ফল বলে মনে করেন মনসুর আজাদ, ‘নতুন ও ভালো মানের রেফারি তৈরির ব্যাপারে তেমন কার্যত ভুমিকা নেই। এক সময়ে এসে সংকটে  পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ মনসুর আজাদ আগে রেফারিজ কমিটিতে ও প্যানেলভূক্ত ম্যাচ কমিশনার ছিলেন। তার মতো দক্ষ একজন রেফারিং ব্যক্তিত্বকে এখন ফেডারেশন তেমন সম্পৃক্ত করে না। দেশের অন্যতম সিনিয়র রেফারিং ব্যক্তিত্ব মুকুলও এখন অনেকটা দূরে। রেফারির এই কঠিন পরিস্থিতিতে মুকুল তার সতীর্থ রেফারিজ কমিটির সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রয়াত মনিরুল ইসলামকে স্মরণ করলেন, ‘তিনি দারুণভাবে সবার সঙ্গে আলোচনা করে পদক্ষেপ নিতেন। ফেডারেশন ও রেফারি উভয়ের স্বার্থ রক্ষায় তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ফলে তার সময় তেমন কোনো সংকট হয়নি।’

সাম্প্রতিক সময়ে রেফারিজ কমিটির পাশাপাশি রেফারিজ বিভাগও করা হয়েছে। এরপরও রেফারিং বিষয়ে তেমন উন্নতি চোখে পড়ছে না মনসুর আজাদের, ‘রেফারিজ কমিটি, বিভাগ থাকলেও সামগ্রিক বিষয়টি দুই-তিন জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভারত সহ অনেক দেশে কয়েকজন সাবেক রেফারিদের সমন্বয়ে রেফারি বিভাগ গঠিত হয়। আমাদের এখানে রেফারিজ বিভাগ অপূর্ণাঙ্গ।’

ফিফা-এএফসির নির্দেশনায় হেড অফ রেফারিজ নিয়োগ দিয়েছে বাফুফে। এ পদটি পূর্নাঙ্গ পেশাদার হলেও এ পদে বাফুফে নিয়োগ দিয়েছে আংশিক পেশাদারভাবে। হেড অফ রেফারিজ সাবেক ফিফা রেফারি আজাদ রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা বিভাগের উপ-পরিচালক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করে পড়ন্ত বিকেলে ফেডারেশনে আসেন। 

ফিফা-এএফসির অনুদানের ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মনসুর আজাদ, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে রেফারির বিভিন্ন বিষয়ে অনুদান আসে। যা রেফারিংয়েই ব্যয় হওয়ার কথা। এর কতটুকু রেফারিংয়ের উন্নত প্রশিক্ষণ বা রেফারিদের জন্য খরচ হয়?’ সাবেক ফিফা রেফারি তো দূরের কথা, খোদ রেফারিজ কমিটির বিগত চেয়ারম্যানই সেই অনুদানের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব নিতে পারেননি।  

২০১২ সালে বাদল রায় রেফারিজ কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার পর সম্মানী বৃদ্ধি পেয়েছিল রেফারিদের। এরপর ১০ বছর হলেও সেই হারে বাড়েনি সম্মানী। গত বছর দুই আগে কিছুটা বেড়ে এখন ২৪০০ টাকা সম্মানী। 

রেফারিরা যাতায়াত ভাড়া পান খুবই সামান্য। সেটা আগে নিজেদের পকেট থেকে রেফারিদের খরচ করতে হয়। কয়েক মাস অনেক সময় বছর পার হওয়ার পর রেফারিরা সেটা পেয়ে থাকেন। এজন্য রেফারিরা খরচ বাঁচাতে নিজেদের শরীরের উপর ধকল নেন। ফলে ভ্রমণক্লান্তি ও ফিটনেসে কিছুটা প্রভাব পড়ে। যার প্রতিফলন হয় অনেক সময় ম্যাচের সিদ্ধান্তে। এই প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেফারি বলেন, ‘ঢাকার বাইরে খেলা থাকলে নিয়মানুযায়ী এক দিন আগে ও এক দিন পর থাকতে হয়। এসি বাস, ভালো হোটেল ও আনুষঙ্গিক সব কিছুর জন্য তিন দিনে ব্যয় হবে ৬-৭ হাজার। সেখানে ফেডারেশন দেবে সর্বসাকুল্যে চার-সাড়ে হাজার, সেটাও কয়েকমাস পর। এজন্য বাধ্য হয়ে রেফারিরা অনেকক্ষেত্রে ভ্রমণক্লান্তির শিকার হয়েই রেফারিং করে।’ 

মানুষ মাত্রই ভুল। নানা সীমাবদ্ধতায় ও অনিচ্ছায় রেফারিরা ভুল করতে পারেন। বাফুফে রেফারিদের ভুলের সাজাও দেয়। তবে অনেকের দৃষ্টিতে এখানে থাকে পক্ষপাত, ‘অনেকে লঘু পাপে গুরু দন্ড পাচ্ছে আবার অনেকে গুরু পাপে লঘু শাস্তি’ -নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও রীতি। 

অনেক সময় আবার রেফারি নিজের ভুলে নিজে পস্তায়। খেলোয়াড়, কোচের অসদাচরণের বিষয় রিপোর্টে উল্লেখ করলেও মাঠে কার্ড দেখান না। ফলে এ রকম অন্যায় বারংবার হয়। সাইফ স্পোর্টিং শেখ রাসেল ম্যাচ পরবর্তী ঘটনা অনেকটা এ রকম। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সহকারী রেফারি জুনায়েদ শরীফের প্যান্টে লাথির ছাপের ছবি তুলে রেখেছেন সেই ম্যাচের রেফারি। ভিডিও ফুটেজে বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ায় এবং রেফারি বিটুরাজ কোনো কার্ড না দেখানোয় ডিসিপ্লিনারি কমিটির অধিকতর তদন্ত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার উপায় ছিল না। শেখ রাসেল-সাইফ ম্যাচের সেই ঘটনা থেকে অনেক রেফারির শঙ্কা, ‘এ রকম ঘটনার বিচার না হলে জটলা সৃষ্টি করে রেফারির লাঞ্চিত ঘটনার সংখ্যা বাড়বে।’

স্বল্প সম্মানী, সেটাও বকেয়া, ন্যুনতম সুবিধাও অপ্রতুল, নেই উন্নতর প্রশিক্ষণ এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রেফারিং বিতর্কের দায় অনেকাংশে ফেডারেশনের কাঁধেই যায়। এত সীমাবদ্ধতা নিয়েও বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন রেফারিরা। প্রতিকূল ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মাঠে নামার পর সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়ার দায়িত্ব রেফারিরই। সেই সিদ্ধান্তে ভুল হলে দায় নিতে হয় তাকেও!  

গত বছর রেফারিদের ভুলে তুমুল সমালোচনার মধ্যে আকস্মিকভাবে নির্বাহী কমিটি ও জরুরি কমিটির সভা ছাড়াই রেফারিজ কমিটি ভেঙে ছিলেন বাফুফে সভাপতি। এক বছর পর পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। জাতীয় ফুটবল দল যেমন ব্যর্থতার চক্রে পড়েছে ঘরোয়া ফুটবলের রেফারিং সংকট সেই রকম চক্রে পড়তে যাচ্ছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এর থেকে দ্রুত উত্তরণ কাম্য ফুটবলপ্রেমীদের। 

এজেড/এটি/এনইউ