বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম কমপ্লেক্সে ২৩১ বছরের পুরোনো মসজিদ
ক্রিকেট, শ্যুটিং, সাঁতার বাদে দেশের অন্য খেলাগুলো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম কমপ্লেক্স নির্ভর। সকাল থেকে রাত অবধি খেলোয়াড়, কোচ,কর্মকর্তাদের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই কমপ্লেক্স। অনুশীলন, খেলার ফাকে অনেকেই যান পল্টন ময়দান জামে মসজিদে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বিদেশি খেলোয়াড়-কোচরাও এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন।
মসজিদের চার পাশে ক্রীড়া স্থাপনায় ঘেরা। সামনে মুহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম, এক পাশে ভলিবল, কাবাডি স্টেডিয়াম, আরেক পাশে রোলার স্কেটিং ও পল্টন ময়দান, অন্য দিকে হকি স্টেডিয়াম। এক তলা মাঝারি আয়তনের এই স্থাপনাটি ঢাকার অন্যতম ঐতিহাসিক মসজিদও। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম কমপ্লেক্সে পল্টন ময়দান সংলগ্ন এই মসজিদটি দাড়িয়ে আছে বহুকালের সাক্ষী হিসেবে।
বিজ্ঞাপন
মসজিদের ভেতরে একটি বোর্ডে লেখা রয়েছে এর সংক্ষিপ্ত জন্ম ইতিহাস। বর্তমান ইমাম মোঃ সাইফুল মসজিদটি সম্পর্কে বলেন, ‘পল্টন ময়দান ঐতিহাসিক, এর চেয়েও ঐতিহাসিক এই মসজিদ। আরবীতে একটা জন্মকথা লেখা ছিল। সেটা সবার জানার জন্য বাংলা করা হয়েছে।’
বিজ্ঞাপন
হিজরী ১২১২ ও ইংরেজি ১৭৯১ সালে প্রতিষ্ঠা সময় লেখা বোর্ডে। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও জমি দাতা হিসেবে নাম লেখা রয়েছে খাদেমা শাওফা বিনতে আল কুদাঈ নামে এক মহিলার৷
ক্রীড়াঙ্গনের বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকের মতে এই মসজিদটি আরো আগের মুঘল সময়কার। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক পরিচালক ফারুকুল ইসলামের ধারণা, ‘ঢাকা শহরের কয়েকটি পুরাতন মসজিদের মধ্যে এটি একটি। মুঘল আমল ও এর কাছাকাছি সময় এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা হয়।’ তার সঙ্গে আরো কয়েকজন একমত পোষণ করলেও এর স্বপক্ষে কোনো দলিল বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মুঘল আমলে এই মসজিদের ইতিহাস খুজে পাননি, ‘মুঘল আমলের স্থাপনা নিয়ে আমার বই রয়েছে। সেখানে বঙ্গভবনের পাশের মসজিদটির বর্ণনা আছে। এই মসজিদটিও বেশ পুরনো হলেও মুঘল আমলের নয়।’
দেশের অন্যতম সিনিয়র ক্রীড়া সংগঠক মহিউদ্দিন আহমেদ। ৭০ বছর পার হওয়া সংগঠকের কাছে এই মসজিদের একশ বছরের বেশি সময়ের বর্ণনা পাওয়া গেল, ‘পল্টন ময়দান তখন বিস্তীর্ণ ভুমি ছিল। সেই পল্টন ময়দানের মধ্যে এই মসজিদটি ঠিক এই জায়গাতেই ছিল। মতিঝিলের আরামবাগে আমার জন্ম৷ আমার বয়স পাচ বছর থেকে মসজিদ দেখে আসছি। এখন বয়স ৭৫ এর কাছাকাছি। আমার বাবা মসজিদের পাশ দিয়ে অফিস যেতেন। বাবার মুখে এই মসজিদের আরো কয়েক বছরের গল্প শুনেছি। ফলে ১০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাস আমারই জানা। এটি অবশ্যই কয়েক'শ বছর পুরনো মসজিদ।’
ছোটবেলা থেকে দেখে আসা ঐতিহাসিক মসজিদটির অফিসিয়াল দায়িত্বও পেয়েছিলেন মহিউদ্দিন, ‘স্বাধীনতার পর পল্টন ময়দান ও স্টেডিয়াম এলাকা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধীনে দেয় সরকার ১৯৭৪ এনএসসি অ্যাক্টের মাধ্যমে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অন্যান্য স্থাপনার মতো পরিচালক প্রশাসন এই মসজিদেরও প্রধান। আমি এনএসসির দায়িত্বে থাকাবস্থায় কিছুটা কাজ করেছিলাম মসজিদের।’
ঐতিহাসিক মসজিদের পরিচালনায় ও কর্মকান্ডে রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। দেশের অধিকাংশ মসজিদের সাথে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্পৃক্ততা থাকলেও এই মসজিদের সঙ্গে নেই, ‘ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত মসজিদগুলো ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। এই মসজিদ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীভুক্ত সংস্থা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আওতাধীন’ -বলেন ইমাম সাইফুল। সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে অনেক মসজিদ পরিচালনায় নানা কমিটি থাকে। এই মসজিদে সেই রকম কমিটিও নেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক প্রশাসনের দায়িত্বে মূলত এই মসজিদ। প্রশাসন পরিচালকের দায়িত্ব থাকলেও হকি স্টেডিয়ামের প্রশাসকই মূলত এটি দেখাশোনা করে আসছেন।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আওতাধীন মসজিদ হলেও এর দিকে খুব খেয়াল নেই প্রতিষ্ঠানটির। দুই যুগের বেশি সময় স্থায়ী ইমাম নেই ৷ আগের ইমাম মোবারকের অবসরের পর খাদেম সাইফুল ইমামের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ান আরেক খতিব। মসজিদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে হকি স্টেডিয়ামের প্রশাসক মসিউর বলেন, ‘সাইফুল সাহেব জুমা ব্যতীত ওয়াক্ত নামাজ পড়ান। তিনি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে সম্মানী পান। সম্প্রতি ইমামের জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। মসজিদে মুয়াজ্জিন, খাদেম আরো কয়েকজন রয়েছেন তাদের সম্মানী মুসল্লীদের দান থেকেই হয়।’
ক্রীড়াঙ্গনে প্রয়াত ব্যক্তিদের অনেকেরই জানাজা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়৷ গত ২৫ বছরে ক্রীড়াঙ্গনের প্রায় সব জানাজা পড়িয়েছেন সাইফুল, ‘অনেক দিন থেকে ক্রীড়াঙ্গনে প্রয়াতদের জানাজা পড়াই। একশ'র উপর ক্রীড়াবিদ, সংগঠক,কোচের জানাজা পড়িয়েছি।’ জানাজা ছাড়াও স্টেডিয়াম এলাকায় ক্রীড়াবিদ,সংগঠকদের জন্য দোয়া ও ইফতার মাহফিল সাইফুলই করে থাকেন।ইমামের দায়িত্ব পালন করা সাইফুল নারায়ণগঞ্জ থাকেন। ফজরে ওয়াক্তে তার পরিবর্তে ইমামতী করেন মুয়াজ্জিন। স্টেডিয়াম এলাকায় ক্রীড়াঙ্গনের চেয়ে বেশি লোক স্টেডিয়াম মার্কেটের ক্রেতা-বিক্রেতা৷ ফজর ছাড়া বাকি চার ওয়াক্ত পুরো মসজিদ ভরে যায় মুসল্লিতে৷ রমজানের সময় তারাবী নামাজও মুসল্লী থাকে অনেক। তারাবী হলেও ঈদের নামাজ হয় না এই মসজিদে।
ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি ভেতরের মুল অংশ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, টাইলস থাকলেও বর্ধিত অংশ টিনসেড ও সাধারণ সিমেন্টের পাকা করা। ঐতিহাসিক মসজিদটি উন্নয়ন ও সংস্কারের ভাবনা ছিল প্রধানমন্ত্রীর, ‘আমার সঙ্গে একবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) ব্যক্তিগত আলাপের সুযোগ হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী মসজিদটির সৌন্দর্যবর্ধন ও আরো নানা পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেও এই কমপ্লেক্সের পাশেই বায়তুল মোকাররম থাকায় এই মসজিদ বড় করার প্রকল্প এক পর্যায়ে স্থগিত হয়ে যায়’ -বলেন মসজিদের ইমাম।
মসজিদটি জন্মলগ্ন থেকে একই জায়গা রয়েছে। কিছুটা বর্ধিত হলেও খুব বড় সংস্কার বা পরিবর্তন হয়নি। দুইশ বছর পার হওয়া মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সংরক্ষণের তালিকায় নেই।
অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখি রায় সংরক্ষণের ব্যাখ্যা সম্পর্কে বলেন, ‘কোনো স্থাপনা ১০০ বছরের বেশি হলে সেটা প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। খুব সম্ভবত এই মসজিদটি আমাদের সংরক্ষণ তালিকায় নেই। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শুধু ১০০ বছর নয়; এর পাশাপাশি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, মৌলিক স্থাপনা অক্ষুণ্নতাও বিবেচনা করা হয়। এই মসজিদটি প্রয়োজনে আমরা আরো একবার পরিদর্শন করতে পারি।’
ঢাকা স্টেডিয়াম নির্মাণ হয়েছে পঞ্চাশ দশকে। এর আগে খেলাধুলা পল্টন ময়দানেই হতো। দেশের বর্ষীয়ান সাংবাদিক কামরুজ্জামান পল্টন ময়দান ও মসজিদ সম্পর্কে বলেন, ‘অনেক প্রাচীন ইতিহাস ঘেটে যতটুকু জেনেছি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় পল্টন ময়দানে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পল্টন ময়দানে খেলাধুলার চর্চা বাড়ে। চল্লিশের দশকে একবার ভারত থেকে ক্রিকেট দল এসেছিল। সেই দল পল্টন ময়দানে ম্যাচ খেলেছিল। ব্যাটসম্যান নাইডুর শটে পল্টন মসজিদের মিনারে লেগেছিল। সেটা অবশ্য রাতের মধ্যেই মেরামত করা হয়েছিল।’
এজেড/এটি