চাহিদা বাড়ছে, সচেতনতা কমছে —তরুণ খেলোয়াড়দের ইনজুরির ঝুঁকি কে দেখবে?
খেলাধুলা মানেই গতি, শক্তি, পরিশ্রম আর আত্মনিবেদনের চূড়ান্ত সংমিশ্রণ। কিন্তু এর মাঝেই বাড়ছে এক নীরব শত্রু ইনজুরি। বিশেষ করে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী তরুণ খেলোয়াড়দের মধ্যে “ওভারইউজ ইনজুরি” বা অতিরিক্ত ব্যবহারজনিত ইনজুরি এখন বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমস্যার শুরু কোথায়
আজকের ক্রীড়া-জগতে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে চাপও। অনেক কোচ, ক্লাব ও অভিভাবক ছোটবেলা থেকেই শিশুদের একটিমাত্র খেলায় মনোযোগ দিতে উৎসাহ দেন—উদ্দেশ্য, একজন পেশাদার তারকা তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে এই একমুখী অনুশীলনই হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের বড় বাধা।
বিজ্ঞাপন
শিশুর শরীর তখনো বাড়ছে, হাড় ও টেন্ডন শক্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। একই ধরণের অনুশীলন বা মুভমেন্ট বারবার করলে শরীরের একটি অংশে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, অন্য অংশ দুর্বল থাকে। ফলাফল—হাঁটু, কাঁধ, কোমর বা গোড়ালিতে ব্যথা, স্ট্রেস ফ্র্যাকচার, টেন্ডিনাইটিস কিংবা গ্রোথ প্লেট ইনজুরি।
গবেষণা কী বলছে
Bell (২০২২) এর গবেষণায় দেখা যায়, যারা ১২–১৪ বছর বয়সেই একটিমাত্র খেলায় বিশেষায়িত হয়, তাদের ইনজুরির ঝুঁকি ২.৩ গুণ বেশি।
Fabricant (২০২৩) দেখিয়েছেন, তরুণ অ্যাথলেটদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার, টেন্ডিনাইটিস, এবং গ্রোথ প্লেট ইনজুরি।
আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস জানিয়েছে—তরুণ বয়সে ওভারলোড, বিশ্রামের অভাব ও অনুপযুক্ত ট্রেনিংয়ের কারণে ইনজুরি এখন “শিশুদের মধ্যে নীরব মহামারি।”
বাংলাদেশেও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। স্থানীয় পর্যায়ের ক্রিকেটারদের এক জরিপে দেখা গেছে, মোট ইনজুরির প্রায় ৭০% ছিল ওভারইউজ ইনজুরি।
বিজ্ঞাপন
মনস্তাত্ত্বিক কারণও আছে
তরুণ খেলোয়াড়রা চায় দ্রুত উন্নতি করতে। দলের জায়গা, কোচের প্রশংসা, বা জাতীয় পর্যায়ে ওঠার স্বপ্ন তাদের প্রতিদিনই বাড়তি অনুশীলনে ঠেলে দেয়। কিন্তু শরীর ও মন দুটোই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অনেকেই ব্যথা লুকিয়ে খেলে, যাতে বাদ না যায়। কিন্তু এতে ছোট ইনজুরি বড় বিপদে রূপ নেয়। একসময় শরীর আর সাড়া দেয় না, তখন বিশ্রাম নয়, রিহ্যাবই একমাত্র পথ।
একজন ফিজিওথেরাপিস্টের অভিজ্ঞতা থেকে...
আমার কাজের মাঠে (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বয়সবিত্তিক বিভিন্ন দলে) প্রায়ই এমন তরুণদের দেখি যাদের বয়স ১৬–১৮, কিন্তু শরীরের অবস্থা যেন ৩০ বছরের খেলোয়াড়ের মতো। কারও হাঁটু ক্ষয়ে গেছে, কারও কাঁধে স্থায়ী ব্যথা, কেউ বা টেন্ডন ইনজুরিতে ভুগছে। এই ইনজুরিগুলোর বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য ছিল। যদি তারা বয়স অনুযায়ী বৈচিত্র্যময় অনুশীলন, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও নিয়মিত ফিজিওথেরাপিস্ট অথবা স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এর পর্যবেক্ষণ পেত, তাহলে হয়তো আজ দেশের গর্ব হয়ে উঠত।
ওভারইউজ ইনজুরি চেনার উপায়
• নির্দিষ্ট জায়গায় বারবার ব্যথা বা অস্বস্তি
• বিশ্রাম দিলে কমে, খেললে বাড়ে
• পারফরম্যান্সে ধীরে ধীরে পতন
• ঘুমে সমস্যা, ক্লান্তি বা আগ্রহ কমে যাওয়া
এসব লক্ষণ দেখলে তা উপেক্ষা না করে স্পোর্টস ফিজিওথেরাপিস্ট বা স্পোর্টস বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় সমাধান
- ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত একাধিক খেলায় অংশ নিতে দিন। এতে শরীরের সব অংশ ভারসাম্যপূর্ণভাবে গড়ে ওঠে।
- প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন বিশ্রাম দিন। শরীরও বিশ্রাম চায়—এ সময়েই সে পুনরুদ্ধার হয়।
- ধীরে ধীরে ট্রেনিং লোড বাড়ান। হঠাৎ ইন্টেনসিটি বা সময় বাড়ালে টিস্যু সহ্য করতে পারে না।
- নমনীয়তা ও শক্তি ট্রেনিংকে গুরুত্ব দিন। শুধুমাত্র কার্ডিও বা স্কিল নয়, ফ্লেক্সিবিলিটি ও কোর স্ট্রেন্থও জরুরি।
- প্রতি তিন মাস অন্তর শারীরিক মূল্যায়ন করান। এতে ইনজুরি রিস্ক আগেই ধরা পড়ে।
- পুষ্টি ও ঘুমে যত্নশীল হন। পর্যাপ্ত পানি, সুষম খাদ্য ও ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম শরীরকে অনুশীলনের জন্য প্রস্তুত রাখে।
কোচ, অভিভাবক ও ক্লাবের ভূমিকা
ইনজুরি প্রতিরোধ শুধু খেলোয়াড়ের দায়িত্ব নয়।
• কোচদের উচিত বয়স অনুযায়ী ট্রেনিং পরিকল্পনা করা।
• অভিভাবকদের বুঝতে হবে “বেশি অনুশীলন মানেই উন্নতি” ধারণাটি ভুল।
• ক্লাব ও ফেডারেশনগুলোর মধ্যে নিয়মিত স্পোর্টস মেডিসিন বিভাগ থাকা উচিত, যেখানে খেলোয়াড়দের পর্যবেক্ষণ করা হবে।
শেষ কথা
খেলোয়াড়ের সাফল্য শুধু তার প্রতিভায় নয়, বরং কতটা সচেতনভাবে সে নিজের শরীরকে প্রস্তুত করছে তা দিয়েই নির্ধারিত হয়। অতি অনুশীলন বা অতিচাপ কখনো উন্নতি আনে না; বরং ক্যারিয়ারের আয়ু কমিয়ে দেয়। তরুণ প্রতিভারা দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত আমাদের দায়িত্বও তাদের নিরাপদ রাখা, সঠিক দিকনির্দেশ দেওয়া। তাই আজই সময় দ্রুত নয়, টেকসই খেলোয়াড় গড়ে তোলার। ইনজুরি-মুক্ত একটি ক্রীড়াবান্ধব প্রজন্মই হতে পারে বাংলাদেশের ক্রীড়ার আসল শক্তি।
লেখক : স্পোর্টস ফিজিওথেরাপিস্ট, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড
এফআই