দুলাল মাহমুদ

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে কোনো আর্কাইভ নেই। পুরোনো তথ্য, ছবি পাওয়া খুবই দুষ্কর। ক্রীড়া সাংবাদিক, লেখক তো বটেই; সাবেক ক্রীড়াবিদ, কোচ, সংগঠকের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে কোনো তথ্যের প্রয়োজনে ছুটতেন ক্রীড়াজগতের সম্পাদক দুলাল মাহমুদের কাছে। ক্রীড়াজগতে তার কক্ষ ছিল সাবেক ক্রীড়াবিদ, সাংবাদিকদের জন্য তথ্য সংগ্রহ ও আড্ডার স্থল। আগামীকাল থেকে সেই আড্ডা আর হবে না।

২ নভেম্বর ১৯৯৬ সাল। সেই দিন দেশের ক্রীড়া পাক্ষিক ম্যাগাজিন ক্রীড়াজগত এর সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেছিলেন মাহমুদ হোসেন খান দুলাল। যিনি দুলাল মাহমুদ নামে ক্রীড়াঙ্গন ও গণমাধ্যমে বিশেষ পরিচিত। আজ ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ এ সম্পাদক হিসেবে শেষ কর্মদিবস পালন করলেন। ক্রীড়া লেখক, সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিক কোনো অবসর নেই। ক্রীড়াজগত ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের একটি পত্রিকা। তাই সরকারি চাকরি নিয়ম অনুযায়ী ৫৯ বছর বয়সে অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা। দুলাল মাহমুদের আনুষ্ঠানিক শেষ কর্ম দিবস হওয়ায় সকাল থেকে ক্রীড়াজগত অফিসে ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই এসেছেন। কেউ এসেছেন ফুলের তোড়া নিয়ে, কেউ ক্রেস্ট। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী পরিচালক, পরিচালকবৃন্দ ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই বেশ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে বিদায় জানিয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনে সবার প্রিয় দুলাল মাহমুদকে, যার লেখায় ইতিহাস-যুক্তি ধারালো ও ব্যাপক গভীরতা থাকলেও তার কথা একেবারেই উল্টো। অত্যন্ত নরম ও মিষ্টিসুরে। বিদায়ের দিনে সেটা আরও নরম ও মায়াবী, ‘ক্রীড়াজগত আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্রীড়াজগত ভালো থাকলে দূর থেকেও আমি শান্তি পাব। আপনারা আমার পরবর্তী জীবনের জন্য দোয়া করবেন এবং ক্রীড়াজগতের পাশে থাকবেন।’ 

সাবেক হকি খেলোয়াড় ও সংগঠক ইউসুফ আলীর পুরোনো তথ্য খোঁজাই নেশা। ব্যক্তিগত কাজের ফাঁকে যখনই সময় পান, তখনই এসে ক্রীড়াজগতের পুরোনো ফাইল ঘাটতেন। দুলাল মাহমুদের শেষ কর্মদিবসে ক্রীড়াজগতে এসেছিলেন ইউসুফ আলী। ক্রীড়াঙ্গনে আবেগপ্রবণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ইউসুফ প্রিয় মানুষের অবসরে যাওয়ার দিনে আরও বেশি আবেগাক্রান্ত, ‘শুধু আমি নই, অনেক সাবেক ক্রীড়াবিদ-সংগঠক মতিঝিল-পল্টন কিংবা স্টেডিয়াম এলাকায় এলে  ক্রীড়াজগতে একটু ঢুঁ দিতেনই। কারণ দুলাল ভাই আছেন, পুরোনো গল্প, ইতিহাস-ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ এই ব্যস্ততাপূর্ণ জীবনে। কাল থেকে আর সেটা হবে না। দুলাল ভাইকে সবাই মিস করবে, দুলাল ভাই আরও বেশি মিস করবেন, তার জীবনই ক্রীড়াজগত।’

১৯৯৬ সালে সম্পাদক হলেও ১৯৮২ সালে ক্রীড়াজগতে তার প্রথম লেখা প্রকাশ হয়। এরপর ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন। বাংলার বাণী, দৈনিক আজাদে কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালের ২ নভেম্বর সম্পাদক হিসেবে ক্রীড়াজগতে যোগদান করেন। এরপর ক্রীড়াজগতই তার জীবন। টানা ২৯ বছর কাটিয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন ভবনের নিচতলা কক্ষে। ক্রীড়াজগত ও দুলাল মাহমুদ যেন সমার্থক শব্দ।

১৯৭৭ সাল থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে প্রকাশিত হচ্ছে পাক্ষিক ক্রীড়া ম্যাগাজিন ক্রীড়াজগত। তৌফিক আজিজ খান, বদিউজ্জামান, শামসুদ্দিন মেহেদীর পর চতুর্থ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন দুলাল মাহমুদ। বিগত তিন সম্পাদক মিলে ১৯ বছর সম্পাদনা করেছেন। দুলাল একাই ২৯ বছরের সম্পাদক। একই পত্রিকায় এত বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম ছাড়া খুব বেশি কারো নেই বাংলাদেশের গণমাধ্যমে।

আগে ক্রীড়াজগত ছিল ৪৮ পাতা। সেটি এখন ৬৪ পাতা হয়েছে, যা প্রকাশনায় কাজ করেছেন সম্পাদকসহ মাত্র ৬ জন। পত্রিকা প্রকাশনায় ফটোসাংবাদিক, প্রুফ রিডার থাকা বাধ্যতামূলক। কয়েক বছর যাবৎ এই পদগুলো শূন্য। জনবল ছাড়াও কারিগরি-যান্ত্রিক সংকটও রয়েছে। অনেক দুর্যোগ, সীমিত জনবল নিয়েও বিশ্বকাপ বা বিভিন্ন সময় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। করোনা ছাড়া কখনো ক্রীড়াজগত ১ ও ১৬ তারিখ বাজারে যায়নি এমন ঘটনা ঘটেনি। এখন মানুষ তৎক্ষণাৎ খবর জানতে চায়। পরের দিন পত্রিকায় বিশ্লেষণ পড়তে চায়। পনেরো দিন পর পাক্ষিকের প্রয়োজনীয়তা ধরে রাখছে ক্রীড়াজগত ভিন্নভাবে। দৈনিক পত্রিকাগুলো জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের পূর্ণ ফলাফল করতে পারে না জায়গা সংকুলানের জন্য। সেটা প্রায় পুরোটাই প্রকাশ করে ক্রীড়াজগত ইতিহাসের রেকর্ডের জন্য।

দেশের অনেক ক্রীড়া সাংবাদিকের হাতেখড়ি ক্রীড়াজগতে লেখালেখির মধ্য দিয়ে। যারা এখন অনেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত ক্রীড়া সাংবাদিক। অনেকে ক্রীড়া সাংবাদিকতা থেকে অন্য পেশা, অন্য বিটের রিপোর্টিংয়ে গেলেও ক্রীড়াজগতে লেখালেখির মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। নতুন ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিক তৈরির পাশাপাশি পুরোনোদের ধরে রাখাটাও দুলাল মাহমুদের অনন্য গুণ। শুধু ক্রীড়া লেখক নয় ক্রীড়াবিদদেরও তিনি লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশের কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ বশির আহমেদ, রণজিৎ দাস সহ আরও অনেকে ধারাবাহিকভাবে ক্রীড়াজগতে লিখেছেন, যার নেপথ্যে দুলাল মাহমুদ।  ক্রীড়াজগতের ‘মাঠ-গ্যালারি-স্টেডিয়াম’ কলাম ক্রীড়াঙ্গনে বেশ সমাদৃত। বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান দুই দশকের বেশি সময় ধরে লিখেছেন। এটিও অনন্য এক বিষয়। কোনো পত্রিকায় একটানা প্রায় ২৫ বছর একজন লেখক এক বিষয়ে কলাম লেখার ঘটনা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। কামরুজ্জামান এখন অসুস্থ হওয়ায় এতে খানিকটা ছেদ পড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।

সম্পাদক দুলাল মাহমুদের চেয়ে গবেষক, ক্রীড়া লেখক দুলাল মাহমুদের বিস্তৃতি যেন আরও বেশি। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে গবেষণা, ইতিহাস-তথ্য ভিত্তিক বই খুবই কম। যে কয়টি রয়েছে এর সিংহভাগই দুলাল মাহমুদের লেখা। ক্রীড়া লেখনী শক্তিও তার অসীম। ক্রীড়াঙ্গনে যে কোনো বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখতেন প্রায়ই। যা ছিল অত্যন্ত সুখপাঠ্য। সম্পাদক হিসেবে আনুষ্ঠানিক অবসর হলেও ক্রীড়া লেখক ও গবেষক দুলাল মাহমুদের কাছে ক্রীড়াঙ্গন ও গণমাধ্যমের প্রত্যাশা এখনো অনেক।

এজেড/এফএইচএম