ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব
বিকেএসপি : ক্রীড়া বিজ্ঞানের কোটি টাকার যন্ত্রপাতি এখন ‘জাদুঘর’
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু। ৩৮ বছর অতিবাহিত হলেও বিকেএসপি কাঙ্ক্ষিত ‘এক্সিলেন্স ইন স্পোর্টস’ হয়ে উঠতে পারেনি। ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের বিকেএসপির ‘ক্রীড়ায় শ্রেষ্ঠত্ব’ অর্জন করতে না পারার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে তুলে ধরা হয়েছিল কোচদের ও কোচিংয়ের সংকটের চিত্র। দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো আজ। যেখানে উঠে এসেছে দুই যুগ পার করা ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের বেহাল পরিস্থিতি এবং ক্রীড়াঙ্গনে এর প্রভাব।
কোটি টাকার মেশিন অকেজো
ক্রীড়া উন্নয়নে গবেষণা ও বিজ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে বিকেএসপি ২০০০ সালে ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ যাত্রা শুরু করেছিল। শুরুর সময় কয়েকটি দামি মেশিনও কেনা হয়। কোটি টাকা দামের সেই মেশিনগুলো এখন অকেজো। জাদুঘরে যেমন সাজিয়ে রাখে তেমনি পড়ে আছে ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে।
বিজ্ঞাপন
বিকেএসপির ক্রীড়া বিজ্ঞানের উপ-পরিচালক আবু তারেক যন্ত্রপাতির বর্তমান হাল-চাল সম্পর্কে বলেন, ‘মোশন অ্যানালাইসিস যেটির মাধ্যমে ক্রীড়াবিদদের গতি, চাকিং পরিমাপ করা যায় সেটা অনেকদিন থেকেই অচল। ভিউ টু ম্যাক্স মেশিনের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের দৌড়ের সময় অক্সিজেন কনজাম্পশন পরিমাপ করা যায় সেটাও ব্যবহার অনুপযোগী, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মেশিন আইসো কাইনাটিড যেটির মাধ্যমে খেলোয়াড়দের মাসেল বা শারীরিক সক্ষমতা পরিমাপ করা হয় সেটাও ঠিক নেই। এই মেশিনগুলো ঠিক থাকলে খেলোয়াড় ও সর্বোপরি ক্রীড়াঙ্গন অনেক উপৃকত হতো।’
ক্রিকেটে প্রায়ই বোলারদের চাকিং নিয়ে শোরগোল পড়ে। আইসিসি নিষেধাজ্ঞা বা সতর্কতার পর বোলারকে ল্যাবে পরীক্ষা দিয়ে শোধরাতে হয়। বাংলাদেশের কয়েকজন বোলারকে সেই পরীক্ষা দিতে হয়েছে ভারত ও অন্য দেশে গিয়ে। বিকেএসপির যন্ত্রপাতি ঠিক থাকলে আরও কিছু সংযোজনের মাধ্যমে এখানেই অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ-সম্ভাবনা ছিল।
বিজ্ঞাপন
সাইকোলজির কিছু যন্ত্রপাতিই ‘শেষ’ ভরসা
খেলাধুলা শুধু ফিটনেস বা শরীর নির্ভর নয়, মানসিকও। একজন ক্রীড়াবিদের মানসিক দৃঢ়তা, পূর্বানুমান করার ক্ষমতার ওপর পারফরম্যান্স নির্ভর করে। তাই বিকেএসপি ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে সাইকোলজিক্যাল টেস্টের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি রয়েছে।
রিঅ্যাকশন প্রায় সকল খেলার সঙ্গেই সম্পর্কিত। তাই এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহারের ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এরপরও মাঝে মধ্যে সেটা ব্যবহার করা হয়। ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে খেলোয়াড়দের দূরত্ব পর্যবেক্ষণের জন্য ডেথ পারসেপশন, পূর্বানুমান ক্ষমতা নির্ধারণের জন্য অ্যান্টিসিপেশন টাইমার, আরচ্যারি, শুটিং ও ক্রিকেটের মতো খেলায় বল বা লক্ষ্যবস্তু সঠিকভাবে দেখার জন্য ভিশন টেস্টার।
প্রায় দুই যুগ ধরে বিকেএসপির সাইকোলজিস্ট হিসেবে কাজ করছেন নুসরাত শারমিন। তিনি বিকেএসপির শিক্ষার্থীদের সাইকোলজিক্যাল সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে বলেন, ‘প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং ইন্সট্রুমেন্টাল টেস্ট এই দুই মাধ্যমে আমরা খেলোয়াড়দের সাইকোলজি নির্ধারণ করে থাকি। আমাদের কয়েকটি যন্ত্রপাতি সচল রয়েছে যার মাধমে আমরা কয়েকটি টেস্ট করতে পারি। এ ছাড়া সাইকোলজিক্যাল প্রশ্নের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের পরিমাপ করি। প্রতি সপ্তাহে খেলোয়াড়দের গ্রুপ কাউন্সিলিং কিংবা প্রয়োজনে খেলোয়াড়রা আমাদের কাছে আসে।
জনবল ও দক্ষতার চরম সংকট
ক্রীড়া বিজ্ঞানের মেশিন পরিচালনা ও গবেষণার জন্য লোক প্রয়োজন। ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে নেই পর্যাপ্ত লোকবল। ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে অনুমোদিত পদ ১২। পরিচালক প্রশিক্ষণ অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। আবু তারেক মূলত স্পোর্টস বায়োমেকানিক্স বিভাগের। তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে উপ-পরিচালকের। ক্রীড়া বিজ্ঞানে মোট পাঁচটি শাখা- স্পোর্টস মেডিসিন, স্পোর্টস সাইকোলজি, স্পোর্টস বায়োমেকানিক্স, এক্সারসাইজ ফিজিওলজি ও সায়েন্স অফ স্পোর্টস ট্রেনিং। পাঁচটি শাখার মধ্যে লোক নেই দুটিতেই।
ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের উপ-পরিচালক আবু তারেক বলেন, ‘ক্রীড়া বিজ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে দক্ষ ও প্রয়োজনীয় জনবল প্রয়োজন। যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নের পাশাপাশি দক্ষ জনবলও প্রয়োজন। এই দু’টির সমন্বয় হলে ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের মাধ্যমে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক কিছুই প্রদান করা সম্ভব হবে।’
একে তো জনবল সংকট এর মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক জটিলতাও। ২০০০ সালে ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ শুরু হলেও রাজস্ব খাতের অর্ন্তভুক্ত হয়েছে ২০১১ সালে। রাজস্বখাত ভুক্ত হওয়ার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো পদ স্থায়ী হয়নি। ফলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর চাকরি নবায়ন করতে হয় এই বিভাগের কর্মকর্তাদের। পদ স্থায়ী না হওয়ায় এখনো পরিচালক, উপ-পরিচালক পদে আলাদা সরাসরি নিয়োগের পরিবর্তে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েই চলছে। আবার কিছু পদ রয়েছে রাজস্বের বাইরে অস্থায়ীও।
বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা কর্মকর্তাদের খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স ও ফিজিওলজি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। মেশিনের অপর্যাপ্ততা ও সমস্যার জন্য এখন তারা ক্লাস নেওয়াতেই বেশি ব্যস্ত। স্পোর্টস মেডিসিন, ফিজিওলজি ও বায়োমেকানিক্স এই বিষয়গুলোর ওপর এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে। সেখানে গবেষণার কর্মকর্তারা নিয়মিত ক্লাস নেন।
গবেষণায় নেই স্থায়ী বরাদ্দ
গবেষণা ব্যয়বহুল বিষয়। বিদেশি জার্নাল অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে কিনতে হয়। আবার নিজস্ব গবেষণাতে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে আর্থিক বিষয় জড়িত। বিকেএসপি ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে গবেষণা ও প্রকাশনায় স্থায়ী কোনো বরাদ্দ নেই। ফলে বছরে একবার স্পোর্টস সাইন্স জার্নাল প্রকাশ করে ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ। এখানে বিকেএসপির গবেষণা কর্মকর্তারা নিজেরা লেখেন আবার কখনো অন্য লেখকদের লেখাও প্রকাশ করেন। অন্য লেখকদের জন্য নেই কোনো সম্মানীর ব্যবস্থাও। এই জার্নাল ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই পড়ার সুযোগ পান না। শুরুর দিকে জার্নালের মান খুবই ভালো ছিল।
কমনওয়েলথের স্বর্ণ ও ফুটবলার মামুনুলের নেপথ্যে ক্রীড়া বিজ্ঞান
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় কয়েকটি সাফল্যের মধ্যে অন্যতম ২০০২ সালে কমনওয়েলথ গেমসে শুটার আসিফ হোসেন খানের স্বর্ণজয়। সেই স্বর্ণজয়ের পেছনে বিকেএসপির ক্রীড়া বিজ্ঞানের ভূমিকা রয়েছে। ২০০০ সালে বিকেএসপিতে ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ পথচলা শুরুর পর ক্রীড়াবিদদের বিশেষত শুটারদের সাইকোলজি নিয়ে অনেক কাজ হয়েছিল। কমনওয়েলথে শুটার আসিফ ও ২০০৪ সালে ইসলামাবাদ এসএ গেমসে শুটার শারমিনের পেছনেও ক্রীড়া বিজ্ঞানের ভূমিকা রয়েছে।
মামুনুল ইসলাম জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক। তিনি বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন জিমন্যাস্ট হিসেবে। জিমন্যাস্ট থেকে ফুটবলে আসার পেছনে রয়েছে ক্রীড়া বিজ্ঞানের ভূমিকা। বিকেএসপির তৎকালীন পরিচালক প্রশিক্ষণ ফারুকুল ইসলাম এ সম্পর্কে বলেন, ‘মামুনুল জিমন্যাস্টিক্সে ছিল। সেখানে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না, আবার পারফরম্যান্সও তেমন ছিল না। এক পর্যায়ে ঝড়ে পড়ার উপক্রম হয়। তখন স্পোর্টস সাইকোলজিস্টরা তার ফুটবল আগ্রহ খুঁজে পায়। এরপর ফুটবল কোচরা তার স্কিল দেখার পর তাকে ফুটবলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।’ মামুনুলও স্বীকার করলেন বিষয়টি, ‘বিকেএসপিতে এক খেলায় ভর্তি হওয়ার পর আরেক খেলায় যাওয়ার ঘটনা খুবই রেয়ার। আমার রূপান্তরের পেছনে ফারুক স্যার ও খালেক স্যারের অবদান অনেক। তাদের এই সহযোগিতা না পেলে হয়তো আমি ফুটবলারই হতে পারতাম না।’
ক্রীড়া বিজ্ঞানের বিভাগের ইতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘২০০১-২০০৭ পর্যন্ত ক্রীড়াঙ্গনে অত্যন্ত সফলতম সময়। কমনওয়েলথ, এসএ গেমসে স্বর্ণ, জুইয়ের ইসলামিকে পদক। ওই সময় যে সকল খেলোয়াড় বিকেএসপিতে উঠে এসেছে এবং ভর্তি হয়েছে সেই সকল গুণগত মানের পেছনে ক্রীড়া বিজ্ঞানের ভূমিকা ছিল।’
ক্রীড়া বিজ্ঞানের অপার সম্ভাবনার ‘অপমৃত্যু’
ক্রীড়া বিজ্ঞান পথচলার পর সাফল্য আসছিল নিয়মিতই। এরপর যখন এটা আরও বিকশিত হওয়ার কথা। উল্টো এখন সেটি অস্তিত্বের সংকটে। এই রকম পরিস্থিতি হওয়ার কারণ সম্পর্কে ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৭ সালে আমি বিকেএসপি থেকে চলে আসি। এর আগে ও পরপরই ক্রীড়া বিজ্ঞানে নিয়োগকৃত বিদেশি স্পোর্টস গবেষক ও সাইনিস্টরা চলে যায়। তাদের চুক্তি বা প্রকল্প আর নবায়ন হয়নি। একে তো তারা চলে গেল, আমাদের এখানে যারা তৈরি হচ্ছিল ডাক্তার দেবাশীষ, রাজীব তারাও অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যায়। ফলে শূন্যতা তৈরি হয়। আমার পরবর্তীতে বিকেএসপির নেতৃত্বে যারা এসেছিলেন, তারাও এটিতে তেমন মনোযোগ দেননি। দায়িত্ব ছাড়ার পরও বিভিন্ন সময় আমি মন্ত্রীদের ক্রীড়া বিজ্ঞানের বিষয়ে অবহিত করেছি, তারাও বিষয়টিতে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। ধীরে ধীরে যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নের পরিবর্তে অকেজো, জনবল সংকট ও দক্ষতার সমস্যা দেখা দেয়।’
বিকেএসপিতে কোচরা শুরু থেকেই অবহেলিত। কোচরা নবম গ্রেডে চাকরি শুরু করেন। গবেষকরা চাকরিতে প্রবেশ করেন ষষ্ঠ গ্রেড দিয়ে। এ নিয়ে কোচদের শুরু থেকেই একটা আক্ষেপ ছিল। কোচদের সঙ্গে ক্রীড়া বিজ্ঞানের গবেষক-কর্মকর্তাদের একটা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ছিল অনেক দিন থেকেই। ফারুকুল ইসলাম চলে যাওয়ার পর ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ আরও দুর্বল হয়ে যাওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ বলে মনে করেন অনেকে।
দেবাশীষ চৌধুরীকে সবাই এখন বিসিবির চিকিৎসক হিসেবেই চেনে। দেবাশীষের ক্রীড়াঙ্গনে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল বিকেএসপির ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে। ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে স্পোর্টস মেডিসিনের চিকিৎসক হিসেবে পথচলা। ২০০০-২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি বিকেএসপিতে কর্মরত ছিলেন। শুরুর দিকে বিকেএসপির ক্রীড়া বিজ্ঞানের কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি বলেন,‘তৎকালীন পরিচালক প্রশিক্ষণ ফারুক ভাইয়ের ব্রেণচাইল্ড ছিল; অনেকটা তিনি এককভাবেই এই স্বপ্ন দেখেছিলেন। তখন সবাই অনেক উৎসাহ নিয়ে কাজ করছিল। আমি ছাড়া স্পোর্টস বায়োমেকানিক্স, ফিজিওলজি, সাইকোলজি সব বিভাগেই ভারতীয় বিশেষজ্ঞ ছিল।’
বাংলাদেশের অন্যতম সেরা নারী অ্যাথলেট ফৌজিয়া হুদা জুই। ঐ সময় ভারতের সেরা জাম্পার ছিলেন অঞ্জু ববি। এই দুই জনের মধ্যে গবেষণা করেছিল ক্রীড়া বিভাগ,‘সেই সময় স্পোর্টস সায়েন্স থেকে গবেষণায় দেখা গেছে জুই এবং ববির মান একদম কাছাকাছি। নিউট্রিশন, ড্রেস ও কিছু বিষয়ে ববি এগিয়ে’-বলেন দেবাশীষ।
বিকেএসপির বর্তমান পরিচালক প্রশিক্ষণ কর্নেল মোঃ গোলাম মাবুদ হাসান ক্রীড়ানুরাগী। তিনি ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের উন্নয়ন সবচেয়ে জরুরি মনে করে বলেন, ‘ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ খুবই অবহেলিত। টেকসই ক্রীড়া উন্নয়ন ও উন্নত বিশ্বের দলগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে হলে ক্রীড়া বিজ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের এখানে যন্ত্রপাতি অধিকাংশ অকেজো আবার জনবল সংকট রয়েছে। বাজেট বৃদ্ধি ও জনবল পূরণের জন্য ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে আমরা চাহিদা দিয়েছি। বিকেএসপি এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে কারণ ক্রীড়া বিজ্ঞানের কার্যকরী পদক্ষেপ ছাড়া ক্রীড়াঙ্গনে উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
ক্রীড়া বিজ্ঞান ও গবেষণা কেন জরুরি
খেলা এখন আর শুধু নিছক বিনোদন নয়। অর্থ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেক কিছুই জড়িত। বিশ্ব কিংবা মহাদেশীয় পর্যায়ে একটি পদক কিংবা ট্রফির পেছনে থাকে অসংখ্য পরিশ্রম ও পরিকল্পনা। খেলোয়াড়দের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সম্ভাবনা উদ্ভাবনসহ অনেক বিষয় ক্রীড়া গবেষণা ও বিজ্ঞানে সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল চীনের ক্রিকেট উন্নয়নে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। চীন অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি পদকধারী দেশ। চীনের সামগ্রিক ক্রীড়াঙ্গন খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। সেখান থেকে বুলবুলের স্পষ্ট উপলব্ধি, ‘ক্রীড়া বিজ্ঞানের মাধ্যমে চীন এখন বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের শিখরে। সেখানের স্পোর্টস বায়োমেকানিক্স এত উন্নত মানের যা আমাদের ধারণারও বাইরে। ক্রীড়া বিজ্ঞান ছাড়া কখনোই বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে এগোনো সম্ভব নয়।’
বিসিবির চিকিৎসক ও স্পোর্টস মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ দেবাশীষ উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের দ্রুতমানবের টাইমিং ১০ সেকেন্ড। অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ীর টাইমিং ৯ সেকেন্ড। এই এক সেকেন্ড ব্যবধান কমাতে ক্রীড়া বিজ্ঞানের বিকল্প নেই।’ বাংলাদেশের অন্যতম ক্রীড়া বিষয়ক গবেষক বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী মুহাম্মদ জুয়েল। তিনি ক্রীড়া বিজ্ঞান ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন, ‘ক্রিকেটে আমরা অনেক ম্যাচেই শেষ ওভারে বা খুব কাছে গিয়ে হারি। ফুটবলে শেষ মুহূর্তে গোল হজম। সাঁতার, অ্যাথলেটিক্সের মতো টাইমিং নির্ভর খেলায় ন্যানো সেকেন্ডের ব্যবধানে পদক হারাই। যারা সাফল্য অর্জন করে তারা একেবারে পারফেক্ট। ঐ পারফেক্ট পর্যায়ে যেতে হলে বিজ্ঞান ও গবেষণার বিকল্প নেই।’
সাবেক দ্রুততম মানব ও বিকেএসপির সাবেক কোচ আব্দুল্লাহ হেল কাফী বলেন, ‘চিকিৎসক যেমন রোগ নির্ণয় করতে পরীক্ষা করেন। তেমনি আমাদেরও খেলোয়াড়দের সমস্যা চিহ্নিত ও সম্ভাবনা উদ্ভাবনে ল্যাব পরীক্ষা প্রয়োজন। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তীতে কোচরা অনুশীলন বা পরিকল্পনা করতে পারে। এই পরীক্ষা ছাড়া অনুশীলন হচ্ছে অনেকটা রোগ না জেনেই ওষুধ দেওয়ার মতো অবস্থা।’
বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ক্রিকেটে উন্নয়নশীল দেশে নানা প্রকল্প করেছেন। বিসিবি সভাপতি হওয়ার পরই তার পরিকল্পনা ছিল একটি উন্নত মানের ভালো ক্রীড়া ল্যাব করার। এখনও সেটা আশা দেখেন তিনি, ‘আগের ক্রীড়া উপদেষ্টাকে আমি স্পোর্টস ল্যাবের কথা বলেছিলাম। এই উপদেষ্টাকেও বলব, আধুনিক ক্রীড়া ল্যাব না থাকলে আমরা ক্রীড়াঙ্গনে এগোতে পারব না। শুধু ক্রিকেট নয়, আমি চাই অন্য খেলাগুলোর সামগ্রিক উন্নয়ন। ক্রিকেটের সঙ্গে গলফ, আরচ্যারি কয়েকটি খেলার কানেকশন রয়েছে আবার ফুটবলের সঙ্গে অন্য কয়েকটি। ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ ল্যাব হলে আমরা সামগ্রিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনে এগিয়ে যাব।’
ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি
বাংলাদেশের মানুষ খেলাপ্রেমী। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও বাংলাদেশে ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেনি। বিকেএসপি খেলাধুলার প্রতিষ্ঠান হলেও এখানে খেলা শেখানোর পাশাপাশি একাডেমিক পড়াশোনা হয়। মূলত খেলাধুলা নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা, গবেষণার সুযোগ সেই অর্থে নেই। ক্রীড়া সম্পর্কিত গবেষক জুয়েল তাই ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তুললেন, ‘ক্রীড়ায় উন্নত বিশ্বে সব জায়গায় ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তারা সারা বছর সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে এবং খেলায় সেটা প্রয়োগ করে। আমাদের এখানে কোনো ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় নেই। যেটা খুব প্রয়োজন।’
এজেড/এফআই