ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্ব
বিকেএসপি : শীতে হয় না সাঁতার, আঞ্চলিক কেন্দ্র চলছে ‘খুড়িয়ে’
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু। ৩৮ বছর অতিবাহিত হলেও বিকেএসপি কাঙ্ক্ষিত ‘এক্সিলেন্স ইন স্পোর্টস’ হয়ে উঠতে পারেনি। বিকেএসপির ‘ক্রীড়ায় শ্রেষ্ঠত্ব’ অর্জন করতে না পারার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া প্রতিবেদক আরাফাত জোবায়ের।
ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে তুলে ধরা হয়েছিল কোচদের ও কোচিংয়ের সংকটের চিত্র। দ্বিতীয় পর্বে উঠে এসেছিল দুই যুগ পার করা ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের বেহাল পরিস্থিতি এবং ক্রীড়াঙ্গনে এর প্রভাব। তৃতীয় পর্ব ছিল বিকেএসপি শিক্ষার্থীদের অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা এবং জাতীয় পর্যায়ে সেরা হয়েও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেভাবে সাফল্য না পাওয়ার নেপথ্য কারণ নিয়ে। আজ চতুর্থ পর্বে বিকেএসপির অবকাঠামো ও আঞ্চলিক কেন্দ্রের সমস্যাদি তুলে ধরা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
শীতে হয় না সাঁতার
সাঁতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলা। যত অনুীশলন তত টাইমিংয়ের উন্নতি, সাঁতারে এমনই ব্রত। অথচ সাভার বিকেএসপিতে শীতকালে পুলেই নামতে পারেন না সাঁতারুরা। কারণ শীতের মধ্যে পানি গরম করার জন্য হিটিংয়ের ব্যবস্থা নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই সুইমিংপুল থাকে ইনডোরে। বাংলাদেশে আউটডোরে হওয়ায়, শীতের তীব্রতা বেশি।
বিজ্ঞাপন
দুই বার অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করা সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর বিকেএসপির সাঁতারের অনুশীলন সম্পর্কে বলেন, ‘শীতের তীব্রতার উপর নির্ভর করে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত অনুশীলন হয় না। কখনো কম থাকলে একটু পর ও আগে শুরু হয়, আবার বেশি হলে আগে বন্ধ ও পরে শুরু হয়। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা না থাকলে দুই মাসের বেশি সময় সাঁতার বন্ধ থাকে শীতের সময়।’ ২০১৬ সালে এসএ গেমসে রেকর্ডসহ দুই স্বর্ণ জেতেন সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা। তিনি শীতকালে সাতার বন্ধ থাকা সম্পর্কে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশেই হিটিং ব্যবস্থা না থাকায় শীতে সাঁতার অনুশীলন বন্ধ থাকে। সাঁতারে অনুশীলন বন্ধ রাখলে টাইমিং ও পারফরম্যান্সে সেটার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’
বিকেএসপির বর্তমান পরিচালক প্রশিক্ষণ কর্ণেল গোলাম মাবুদ হাসান খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেষ্ট। ছুটি শেষেই যেন সাঁতারুরা পুলে নামতে পারেন, সংশ্লিষ্ট শাখাকে সেই ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
ইনডোরে ধুলাবালিতে কোর্ট স্লো
সম্প্রতি বিকেএসপিতে ইনডোর কমপ্লেক্স হয়েছে। সেখানে টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টনসহ আরো কয়েকটি খেলার অনুশীলন হয়। নতুন কমপ্লেক্সেও সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ইনডোর কমপ্লেক্সে ধুলোবালি প্রবেশ করে। যা টেবিল টেনিসের টেবিলের উপর পড়ে। এতে ক্রমেই টেবিল ধীরগতির হচ্ছে। যা সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে কোচ মোস্তফা বিল্লাহ বলেন, ‘ধুলোর জন্য আমাদের টেবিল স্লো হয়ে যাচ্ছে। এতে বল আসছে কম গতিতে। এতে প্রকৃত অনুশীলনে ব্যাঘাত ঘটছে। আন্তর্জাতিক বা জাতীয় পর্যায়ে বল খুব দ্রুত সময়ে আসে।’
ভেন্টিলেশন সমস্যায় কয়েক কোটি টাকার ইনডোর
ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ভলিবল, আরচ্যারিসহ অনেক খেলার অনুশীলন উন্মুক্ত মাঠে হয়। অতিরিক্ত গরম কিংবা বৃষ্টিতে খোলা মাঠে অনুশীলন করা দুরহ। সেই বিবেচনায় একটি ইনডোর করেছিল বিকেএসপি। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে ইউরোপের আদলে সেই ইনডোর করলেও কাজে আসেনি। কারণ শীতপ্রধান দেশে অধিকাংশ ইনডোর বেশি গরম। সেই আলোকে ইনডোর নির্মাণ করায় অতিরিক্ত গরম ছিল। ফলে সেখানে কয়েক মিনিট অবস্থান করলেই ঘাম ঝড়ে পড়ত। তাই অনুশীলন করা যায়নি।
এত টাকা ব্যয়ে ইনডোর নির্মাণের পরও অনুশীলন করতে না পারায় অনেক সমালোচনা হয়েছিল। এটা নিয়ে তদন্ত হয়েছিল। বিগত সময়ে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে উঠেছিল এটি। পরবর্তীতে সেটা আবার সংস্কার করে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা হয়। এরপর থেকে অল্প হলেও অনুীশলন শুরু হয় সেখানে।
আঞ্চলিক বিকেএসপিতে যেতে কোচদের অনীহা
বিকেএসপির শীর্ষ পর্যায়ের কোচরা সাভার কেন্দ্রেই থাকতে চান। তাদের অনেকেই আঞ্চলিক পর্যায়ে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নন। ফলে সেখানে থাকা শিক্ষার্থীদের অনুশীলন ও সুযোগ-সুবিধায় খানিকটা ঘাটতি থাকে। কোচদের এমন অনীহা প্রসঙ্গে একাধিক কোচ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে বলেন, ‘একে তো আমাদের সম্মানী কম। সবার পরিবারই এই ক্যাম্পাস বা সংলগ্ন এলাকায় থাকে। পরিবার রেখে অনেকেই যেতে আগ্রহী হয় না।’ কোচরা উৎসাহে যেতে না চাইলেও প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশনায় যেতে হয় খানিকটা বাধ্য হন।
আঞ্চলিক কেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা মনোবিদের আওতার বাইরে
বিকেএসপিতে মাত্র দুই জন মনোবিদ। সেই মনোবিদও ঢাকায় সাভার প্রধান কেন্দ্রে। আঞ্চলিক কোনো কেন্দ্রে মনোবিদ নেই। ফলে কয়েকশ শিক্ষার্থী মনোবিদের সেবার আওতার বাইরে। অথচ অনেক খেলায় ঢাকার বাইরে শিশুরা নানা মানসিক পীড়নে ভোগেন। তারা দীর্ঘদিন এই সেবার বাইরে। সম্প্রতি ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ অনলাইনে প্রতি আঞ্চলিক কেন্দ্রে এক ঘন্টা করে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করেছে।
চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় সদর হাসপাতালে
খেলাধূলার সঙ্গে ইনজুরি নিবিড়ভাবে জড়িত। আঞ্চলিক বিকেএসপিগুলোতে চিকিৎসার সমস্যা প্রকট। ছোটখাটো ইনজুরিতেও খেলোয়াড়দের নিয়ে ছুটতে হয় সদর হাসপাতালে। আঞ্চলিক পর্যায়ের সকল বিকেএসপিই শহর থেকে খানিকটা দূরে। ফলে অসুস্থ ক্রীড়াবিদদের খানিকটা কষ্টই করতে হয়।
জনবল সংকট
সাভার বিকেএসপির বাইরে আরো সাতটি আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে। সেই আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো এখনো পরিপূর্ণ হয়নি। এর পেছনে অন্যতম কারণ জনবল সংকট। আঞ্চলিক কেন্দ্র চালু হলেও এখনো মন্ত্রণালয় থেকে জনবলের অনুমোদন হয়নি। ফলে লোক নিয়োগ বা পদায়ন করতে পারছে না বিকেএসপি। আঞ্চলিক বিকেএসপির প্রধান সমস্যা হিসেবে জনবল সংকটই মনে করেন পরিচালক প্রশিক্ষণ কর্ণেল গোলাম মাবুদ হাসান, ‘আঞ্চলিক বিকেএসপিগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময় কিন্তু জনবল সংকটের জন্য সেখান থেকে উৎকর্ষতা পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না।’
ফুটবল, ক্রিকেট, হকির শুরুই আঞ্চলিক পর্যায়ে
দেশের তিন শীর্ষ খেলা ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি। গত কয়েক বছর এই তিন খেলার শিক্ষার্থীরা শুরুর দিকে ঢাকার সাভার কেন্দ্রে আসতে পারেন না। নবম শ্রেণীতে উঠার পর তারা ঢাকায় আসেন। এর আগে আঞ্চলিক কেন্দ্রে থাকতে হয়। আঞ্চলিক পর্যায়ে এই তিন শীর্ষ খেলার বেসিকের উপর নির্ভর করে পরবর্তী সময় তাদের বেড়ে উঠা। বিকেএসপির সাবেক কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম এই বিষয়ে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের শুরুর দিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ। শুরুর শিক্ষাই মূলত ভিত। এরপর ধীরে ধীরে তারা গড়ে উঠেন। ঢাকার বাইরে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোতে সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি রয়েছে।’
শুরুর লক্ষ্য থেকে এখন খানিকটা ভিন্ন
অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফারুকুল ইসলাম বিকেএসপিতে এক যুগের বেশি সময় ছিলেন। দশ বছর ছিলেন পরিচালক প্রশিক্ষণই। তার সময়ে আঞ্চলিক বিকেএসপির পথচলা শুরু হয়। শুরুর দিন থেকে সাম্প্রতিক সময়ে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোর উদ্দেশ্যের ভিন্নতা দেখতে পান তিনি, ‘আঞ্চলিক বিকেএসপি হয়েছিল স্থানীয় মেধাবীদের চিহ্নিত করে কয়েক মাস ট্রেনিং করে এরপর সাভার বিকেএসপিতে স্থানান্তর। ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে সেগুলো গড়ে তোলা হলেও এখন সময়ের পরিক্রমায় আঞ্চলিক বিকেএসপি পূর্ণাঙ্গ রুপেই কাজ করছে। সেখানে প্রশিক্ষণ, একাডেমিক কাজ একসঙ্গেই চলছে। দুই-তিন বছর অনুশীলনের পর ঢাকা আসছে। দিনাজপুর ছাড়া অন্য বিকেএসপিগুলোতে সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি রয়েছে এখনো।’
বিকেএসপির সাবেক কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম আঞ্চলিক বিকেএসপির সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণ ভালো উদ্যোগ। এর পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি নিয়ে খেলোয়াড়রা প্রশিক্ষিত হয়ে উঠলে এটার দীর্ঘমেয়াদীয় প্রভাব পড়বে।’
কোন কেন্দ্রে কোন খেলা
ঢাকা : ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, টেবিল টেনিস, সাঁতার, বাস্কেটবল, ভলিবল, জুডো, উশু, তায়কোয়ান্দো, টেনিস, শুটিং,
জিমন্যাস্টিক্স, ভারত্তোলন, অ্যাথলেটিক্স, আরচ্যারি।
দিনাজুপর : ক্রিকেট, হকি, সাঁতার।
খুলনা : ফুটবল,টেবিল টেনিস।
রাজশাহী : বক্সিং।
বরিশাল : তায়কোয়ান্দো, কাবাডি, কারাতে, উশু।
সিলেট : ফুটবল, ব্যাডমিন্টন।
চট্টগ্রাম : স্কোয়াশ, কাবাডি।
কক্সবাজার : আগে আরচ্যারি ছিল এখন নেই।
এজেড/এইচজেএস