ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসহ দেশ ও জাতির অনেক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের শুধু শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে নয়, ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে অসামান্য অবদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ক্রীড়া বিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্বে ক্রীড়াক্ষেত্রে ডাকসুর ভূমিকা নিয়ে সাবেক ক্রীড়া সম্পাদকদের বক্তব্য তুলে এনেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্মের চার বছর পরেই শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র অফিসের আত্মপ্রকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ সেই হিসেবে নব্বই উত্তীর্ণ বৃদ্ধ! ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষার্থীদের ক্রীড়া পদচারণায় মুখরিত থাকত এই মাঠ৷

ফুটবল মাঠের পাশে ছিল ৪০০ মিটারের এক অ্যাথলেটিকস ট্রাক৷ সেই ট্র্যাকে দৌড়েই সুলতানা কামাল, রওশন আক্তার ছবিরা দেশসেরা স্প্রিন্টার হয়েছেন। পাকিস্তান আমলেই গড়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের শরীর চর্চার জন্য জিমনেসিয়াম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিমনাস্টিকসে একমাত্র ব্লু পাওয়া আহমেদুর রহমান বাবলু তাদের সময়কার জিমনেসিয়ামের বর্ণনা দিলেন এভাবে, ‘সেই সময় জাপানি সামগ্রী ছিল। আমাদের একজন ট্রেনার ছিল। সব মিলিয়ে নিরিবিলি সময়ে ভালোই অনুশীলন করতাম।’

আশির দশকে জিমনেসিয়ামের সেই দৃশ্য এখন আর নেই। সেই সময় অনার্স ও মাস্টার্স সব বর্ষ মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে ছাত্র সংখ্যা ছিল সাত-আট হাজারের নিচে। বিভাগ সংখ্যা ও শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা গত তিন যুগে বেড়েছে বহুগুণে। অনার্স ও মাস্টার্স সব মিলিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা বিশ হাজারের বেশি। মোট শিক্ষার্থীর দুই-তিন শতাংশ এখন জিমমুখী। সেই কয়েকশ শিক্ষার্থীর চাপ নিতে পারছে না জিমনেসিয়াম।

শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শাহজাহান আলীর কন্ঠে অসহায়ত্বের সুর, ‘অনেক শিক্ষার্থী এখন স্বাস্থ্য সচেতন। তাদের অনেকে জিমনেসিয়ামে আসেন। এক সঙ্গে অনেক শিক্ষার্থী আসলে আমাদের সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যায়।’ আয়তন ও সামগ্রী স্বল্প হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীকে অপেক্ষামান থাকতে হয় অনুশীলনের জন্য। আবার যারা বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের ক্রীড়াবিদ তারাও একটু বেশি জিমনেসিয়ামে গিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন না।

ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ আশির দশকে মাঝামাঝি সুইমিংপুলের লাগোয়া একটি মাল্টিপারপাস জিমের কাজ শুরু করে। কয়েকটি পিলার গাথার পর সেই কাজ এখনো থমকে আছে প্রায় তিন যুগের বেশি। মাল্টিপারপাস জিমনেসিয়াম হলে ভলিবল, হ্যান্ডবল, শরীর চর্চাসহ নানাভাবে অনেক শিক্ষার্থী ও ক্রীড়াবিদ এটি ব্যবহার করতে পারতেন।

অবসরে যাওয়া সাবেক পরিচালক শওকতুর রহমান চিনু যখন শারীরিক শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন। এর কিছু দিন পরেই এই জিমনেসিয়ামের কাজ শুরু হয়। অবসরে গেলেও সেই জিমনেসিয়াম সেই অবস্থায়। এর কারণ সম্পর্কে এই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘সম্পূর্ন আমলাতান্ত্রিক কারণ। প্রকৌশলী বিভাগের আন্তরিকতার অভাবে এখনো এটি এভাবে পড়ে আছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন যুগে অসংখ্য হল, বিভাগ, প্রশাসনিক অফিস নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে। ক্রীড়া অবকাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অনেকটা গুরুত্বহীন জিমনেসিয়াম এর একটা ক্ষুদ্র চিত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পিরিয়ডে পদকজয়ী ২ অলিম্পিয়ান এসেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অনেক বিদেশি দল বাংলাদেশ সফরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে অনুশীলন করেছে। শুধু অনুশীলন ও প্রীতি সফর নয় আন্তর্জাতিক আয়োজনের সাথেও সম্পৃক্ত এই মাঠ। অনূরধ্ব-১৭, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, হুইলচেয়ার ও ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোর ভেন্যুও এটি৷ 

নব্বই দশকে জাতীয় ফুটবল দলের সিংহভাগ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অনেক দিন অনুশীলনও হয়েছে সেখানে। মোহামেডানের মাঠ সংকট দীর্ঘদিনের। মোহামেডানের অনুশীলনের অন্যতম ভেন্যু ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ। মোহামেডানের সাবেক তারকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী কায়সার বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের অনুশীলন মিস করেন এখনো, ‘তখন আমাদের মোহামেডানের অনুশীলনই দেখত কয়েক হাজার দর্শক আসতো।’

কেন্দ্রীয় মাঠের পাশাপাশি হলের মাঠেও ফুটবল ক্লাবগুলো অনুশীলন করেছে। জগন্নাথ হলের মাঠে জুনিয়র ডিভিশন ক্রিকেট হয়ে আসছে বেশ কয়েকবছর। কেন্দ্রীয় মাঠেও হয় ক্রিকেট বোর্ডের অনুমোদিত আসর। বিসিবির উদ্যোগে ২০০২-০৩ সালের দিকে কেন্দ্রীয় মাঠে ক্রিকেটের অংশটুকু উন্নত করা হয়। ক্রিকেট বোর্ড নিজস্ব অর্থায়নে কেন্দ্রীয় মাঠের ক্রিকেটের অংশ ছোট গ্যালারি নির্মাণ করতে চাইলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের সম্মতি না থাকায় সেটা আর হয়নি।

ফুটবল মাঠটি ক্রিকেটের তুলনায় খানিকটা অনুন্নত। ফুটবল মাঠের উপর চাপও বেশি ফলে পরিচর্যার সময়ও থাকে কম। ক্রিকেট বোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ এখনো ব্যবহার করলেও ফুটবল ফেডারেশন গত কয়েকবছর যাবত অবশ্য ব্যবহার করছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় আন্ত শুটিং প্রতিযোগিতা আয়োজন করত। জাতীয় শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশগ্রহণ ছিল নিয়মিত। শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে শুটিং রেঞ্জও ছিল। গুলি, অস্ত্রের অনিয়মে শেষ পর্যন্ত শুটিং স্থগিত হয়ে যায়। রেঞ্জও উঠে যায়।

আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও আভ্যন্তরীণ ক্রীড়া আয়োজনের জন্য প্রায় ২০ লাখের মতো বাজেট বরাদ্দ পায় শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র। এই বাজেটের মধ্যেই অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ সম্পন্ন করতে হয়। ফুটবল, ক্রিকেট মাঠ ব্যবস্থাপনা ও যাবতীয় কিছু সেই বাজেটের মধ্যেই। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাজেটে আমাদের সমস্যা নেই। সব কিছুই ঠিক মতো হচ্ছে। কোনো সময় বিশেষ খেলাধুলা থাকলে তখন বিশ্ববিদ্যালয় বাড়তি বরাদ্দ দেয়।’ সাবেক পরিচালক শওকতুর রহমান অবসর নেয়ায় পিছুটান না থাকায় বাজেট নিয়ে খানিকটা সমালোচনাই করলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া ক্ষেত্রে বাজেট অবশ্যই আরো বাড়ানো উচিত। কতৃপক্ষ এদিকে তেমন কোন নজর দেয় না।’

ডাকসুর সর্বশেষ ক্রীড়া সম্পাদক তানভীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া বাজেট ও ক্রীড়া অবকাঠামো নিয়ে হতাশাই প্রকাশ করলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছরে ক্রীড়া অবকাঠামো খাতে সেভাবে এগুতে পারেনি। এটা দুঃখজনক হলেও সত্য৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বড় বাজেট হলেও ক্রীড়া উন্নয়ন ও অবকাঠামোতে তেমন কিছু থাকে না।’ সর্বশেষ ক্রীড়া সম্পাদকের সঙ্গে আশি-নব্বই দশকের ক্রীড়া সম্পাদকরাও একমত পোষণ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দকৃত বাজেট ছাড়াও শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের নিজস্ব কিছু আয় আছে। সুইমিংপুলে বহিরাগতদের সাঁতার শেখানো, খেলার মাঠ বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেয়া শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের অন্যতম আয়ের উৎস।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলা পরিচালিত হয় শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র থেকে। ১৯২৫ সালে এই কেন্দ্র যাত্রা শুরু করলেও প্রথম পরিচালক পায় ১৯৪১ সালে। লে. কর্নেল মতিউর রহমান (সাবেক ক্রিকেটার ইউসুফ রহমান ও সামিউর রহমানের বাবা) ৩০ বছর এই পদে ছিলেন। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত শাহজাহান আলী ব্যক্তি হিসেবে অষ্টম পরিচালক। বর্তমানে শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে ভারপ্রাপ্ত সহ ১০ এর অধিক অফিসার রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাইভেটে ক্লাস নেয়ার মতোই অনেক ক্রীড়া অফিসার ক্রীড়া সম্পর্কিতই আয়মুলক অন্য পেশাও নিযুক্ত। এই প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের বক্তব্য, ‘আমার সকল অফিসারই বিশ্ববিদ্যালয় নিযুক্ত দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করে। অর্পিত দায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা ও উদাসীনতা নেই।’  সুচারুভাবে পালন করলে কি আর ব্লু, ট্রফি, খেলোয়াড় কোটার তালিকা অপূর্ণাঙ্গ থাকে। বর্তমানদের মতো সাবেকরাও দায় এড়াতে পারেন না।

শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র সাড়ে ৩ একরের বেশি জায়গা ছিল। কয়েক বছর আগে শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র থেকে ৩০ কাঠার মতো জায়গা অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। 

এজেড/এটি/টিআইএস/এমএইচ