বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছুদিন আগ পর্যন্তও ভাবাই যেত না যে ভিনদেশি কেউ মনের মানুষ হতে পারেন। ভাবা গেলেও সে মানুষ যে তার জীবনসঙ্গীর বাঙালিয়ানাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেই এমন বদ্ধমূল ধারণা ছিল আমাদের। বদলেছে সময়, তাই সীমানার বাধাবিপত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ডানা মেলছেন কেউ কেউ। দেশ ভিন্ন হলেই দুটো মন ভিন্ন হয়ে যাবে- এমন তো কোথাও লেখা নেই। আজ বলছি, একটি ব্যতিক্রমী গল্প। দুটি ভিন্ন দেশের মানুষের অভিন্ন সত্তায় একীভূত হওয়ার গল্প।

‘শেহ্ওয়ার-মারিয়া’, আপনি যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাক্টিভ হয়ে থাকেন, তাহলে ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছেন জনপ্রিয় এই জুটিকে।

পূর্বপরিচিত না হলে তাদের ভিডিও দেখার সময় আপনার মনে হতেই পারে এটা একটা স্ক্রিন প্লে। আসলে এটা কোনো মুভির স্ক্রিন প্লে নয়। এই নতুন দম্পতির সাংসারিক খুনসুটির একটি নমুনা মাত্র।

যদিও তাদের গল্পটা সবাই জানেন, তবু আরেকবার ছোট করে বলছি। আলোচিত বাংলাদেশি-রোমানিয়ান এই জুটির প্রেম পর্বের শুরুটা ছিল দুজনের 'মিউচুয়াল ফ্রেন্ড' এর মাধ্যম। এভাবে কখন যে তারা নিজেদের অজান্তেই অনন্তকালের অটুট বন্ধনে জড়িয়ে পড়লেন, সে কথা মনে নেই কারোরই।

শেহ্ওয়ার একজন ন্যাটিভ বাঙালি ছেলে। শৈশব ও কৈশোরকাল কেটেছে বাংলার মাটিতেই। উচ্চশিক্ষার জন্য ২০০৫ সালে চলে যান লন্ডনে। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা সিআইপিডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পৃথিবীর সেরা পুলিশ ফোর্স হিসেবে বিবেচিত লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় পাঁচ বছর। বর্তমানে কর্মরত আছেন মানবসম্পদ বিভাগে। অন্যদিকে মারিয়ার বেড়ে ওঠা রোমানিয়ার প্লয়েশতি শহরে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইরাকের কুর্দিস্তানে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এই বাংলাপ্রেমি তরুণী।

এখন শেহ্ওয়ার পরিবার ও স্ত্রী মারিয়াকে নিয়ে অবস্থান করছেন লন্ডনে।

ভ্রমণ, রান্না, কথোপকথন, সাংসারিক খুনসুটি ইত্যাদি বিষয়ে বিনোদনমূলক ও রোমাঞ্চকর ভিডিও করে থাকেন এই দম্পতি। আর সেসব সামাজিক মাধ্যমে আসা মাত্রই ভাইরাল হয়ে যায়। দেশের অসংখ্য মানুষের প্রধান আকর্ষণে থাকেন মারিয়া। রোমানিয়ান এই চমৎকার তরুণীর বাংলা ভাষার সাবলীল বাচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হন সবাই।

এ সম্পর্কে শেহ্ওয়ারকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান- ‘আসলে আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, ওর মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি এক ধরনের মমতা কাজ করত। সেখান থেকেই শুরু’।

ইউটিউব জার্নি - অর্জন সমগ্র

ইউটিউবে জনপ্রিয় এই দম্পতির 'শেহওয়ার অ্যান্ড মারিয়া' নামের চ্যানেলে বর্তমানে সাবস্ক্রাইবার ৩ লাখ ৩০ হাজারের উপরে। প্রথম ভিডিও আপলোড দেওয়ার ৩ মাসের মাথায় ১ লাখ সাবস্ক্রিপশন ল্যান্ডমার্ক স্পর্শ করেছিলেন তারা। মাস চারেক আগে পেয়েছেন ইউটিউব ক্যারিয়ারে কাঙ্ক্ষিত সম্মাননা সিলভার প্লে বাটন। মূলত লকডাউনের সময় থেকেই তাদের ইউটিবিংয়ের সূচনা। ১৪টি সেগমেন্ট নিয়ে বানানো 'লকডাউন ডায়েরি' ভিডিও ব্লগটি দর্শকমহলে ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ঘরে বসে ফ্রিতে লন্ডন শহর ঘুরতে চাইলে আপনিও চ্যানেলটি ভিজিট করতে পারেন। লন্ডনের জনপ্রিয় প্রায় সব জায়গাতেই ভিডিও ব্লগ করেছেন এই দম্পতি। ক্যাম্ব্রিজ, ওয়েস্টফিল্ড শপিং সেন্টার,বাকিংহ্যাম প্যালেস, বরো মার্কেট, ক্যামডেন মার্কেট,লিটেল ভেনিস,কভেন্ট গার্ডেন, ক্যানারি ওয়ার্ফ কিংবা টেমস নদী- বাদ যায়নি কিছুই।

আবার ইউরোপের কিছু জনপ্রিয় স্থানেও রয়েছে তাদের ভ্রমণ ব্লগ। ইটালির ভেনিস ও মিলান, গ্রিসের স্যান্টেরিনি ও মিকোনাস, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, জার্মানির বার্লিন, নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম এবং বার্সেলোনার স্পেনেও রয়েছে তাদের রোমাঞ্চকর ভ্রমণ ভিডিও ব্লগ। ৬০ সেকেন্ডের স্পেশাল সেগমেন্টগুলো আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক দুনিয়ায়।

অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ

'শেহওয়ার অ্যান্ড মারিয়া' তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের বর্তমান ফলোয়ার ৮ লাখের উপরে। পেইজে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে একটা ছোট্ট ইন্ট্রো চিরকুট - 'এক বাংলাদেশি ছেলে আর এক বিদেশি মেয়ের লন্ডন জীবনের ডায়েরি'।

তারপর ধীরে ধীরে নিচে স্ক্রল করতে থাকলে দেখতে পাবেন এই দম্পতির দৈনন্দিন জীবনের ভালো লাগা, খারাপ লাগা, টক ঝাল মিষ্টি কথোপকথন, পারস্পরিক  চ্যালেঞ্জ কিংবা রোমাঞ্চকর ভ্রমণমূলক ভিডিও ক্লিপ। এসব পোস্ট হয়ে যায় রীতিমতো ভাইরাল, মূহুর্তেই পড়ে যায় হাজার হাজার রিয়েক্ট। ফ্যান ফলোয়ার কমেন্ট বক্সে শেয়ার করেন মতামত। এছাড়া একাধিক ফ্যান ক্লাব তাদের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তারই প্রমাণ, যেখানে নিয়মিত পোস্ট করেন তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

সমসাময়িক একটি সাক্ষাৎকারে শেহ্ওয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানান, 'আসলে আমাদের দেশে একটা অমূলক ধারণা ছিল এই বিষয়টি নিয়ে। অনেকেই ভাবেন আমরা যদি ওয়েস্টার্ন কালচারের মেয়েদের কিংবা ছেলেদের বিয়ে করি তাহলে বুঝি বাঙালি হিসেবে আমরা আমাদের নিজস্ব সত্তা হারিয়ে ফেলব। এটা একটা ভুল ধারণা। মারিয়া তো রীতিমতো বাঙালিয়ানায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।'

তিনি আরও যোগ করেন, 'আমি কয়েকটা দেশ ভ্রমণ করেছি। সবখানেই তাদের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে বিদেশিদের বিপুল আনাগোনা থাকে। এসব নিয়ে ইউটিউবে অনেক প্রমোশনাল ভিডিও আছে। তবে আমাদের দেশের যে চমৎকার দর্শনীয় স্থানগুলো আছে, সেগুলো নিয়ে কেউই সেভাবে ভিডিও বানায়নি। আমরা চাইব বাংলাদেশের সুন্দর জায়গাগুলো সবার কাছে তুলে ধরতে।

আমরা অনেকেই বিদেশে এসে এক ধরনের হীনমণ্যতায় ভুগী। বাংলা ভাষা কিংবা সংস্কৃতিকে লুকিয়ে রাখতে চাই। অনেকে এমন আছেন যে বিদেশে বিয়ে করার পর আর কখনোই বাংলা বলতে চান না। এমনকি নিজের জীবন সঙ্গীর সঙ্গেও নন। এটা মোটেই ঠিক না, আমাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটাতে হবে এবং আমাদের ভিডিওগুলোর মাধ্যমে আমরা ইতিবাচক এই পরিবর্তনগুলো আনতে পারছি। আমার বুকটা গর্বে আর আনন্দে ভরে যায়, যখন আমি দেখি যে আমাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এখন অনেক বাংলাদেশি বহুজাতিক দম্পতি তাদের বিদেশি জীবনসঙ্গী/জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে বাংলায় কথা বলছে, তাদেরকে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।'

‘মারিয়া’ আমাদের ভিনদেশি বনলতা

জীবনান্দ দাশ বনলতা সেনের জন্য হাজার বছরের পথ। সে ছিল আমাদের প্রথম বনলতা। তবে দেশের বাইরে আমাদের কি কোনো বনলতা আছে? এমন প্রশ্ন করা হলে মারিয়া অবশ্যই নমিনেট হবেন।  কখনও কখনও এই বিদেশিনী পরম মমতায় কণ্ঠে তোলেন 'একুশের গান', কখনও বা ধারালো গলায় 'বিদ্রোহী' কবিতা। অকপটে প্রকাশ করেন বাংলায় তার মনের ভাব, মনের কথা। এমনকি মাঝে মাঝে দেখা যায়, মারিয়া হুট করে তার ভিনদেশি বান্ধবীর সঙ্গে বাংলা ভাষায় জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। শাড়িও পরছেন, আবার ফুচকাও খাচ্ছেন। সম্প্রতি সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা শেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। এই যে তার বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করার আকুল প্রচেস্টা এর জন্য হলেও আমায় বলতেই হবে, 'মারিয়াই আমাদের ভিনদেশি বনলতা।'

সামাজিক দায়বদ্ধতা

ইউটিউব চ্যানেলের ১ লাখ সাবস্ক্রাইবার হওয়ার পর শেহওয়্যার ও মারিয়া বাংলাদেশি শিশু ফাতিহার (৪) ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। প্রতিমাসেই ফাতিহার খরচ বহন করছেন তারা। চিঠিতে কথাও বলছেন ফাতিহার সঙ্গে। আগামী চার বছর এভাবেই চালিয়ে যাবেন বলেও আশ্বস্ত করেন শেহওয়্যার।

ভক্তদের আগ্রহ, অভিমত  

বর্তমানে দেশের তরুণ-তরুণীদের একটা বিশাল অংশ শেহওয়্যার ও মারিয়াকে অনুসরণ করছে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন তাদের নতুন ভিডিও আপলোড হওয়ার জন্য। পরস্পর ভিন্ন দেশের এই দম্পতিকে ঘিরে কৌতূহলের শেষ নেই তাদের।

ইউটিউব কিংবা ফেসবুকের কমেন্ট বক্সে চলছে প্রশ্নের ঝড়। শেহওয়ার-মারিয়া দম্পতিও খুব উপভোগ করছেন বিষয়টি। তারা ভক্তদের ভালোবাসার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এছাড়া ভক্তদের এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তারা ইতোমধ্যে দুটি সেগমেন্ট করেছেন। সেখানে ভক্তদের কাছ থেকে পাওয়া সর্বাধিক প্রশ্নগুলো নিয়ে শেয়ার করেছেন নিজেদের মতামত।

সীমানার বেড়াজাল টপকে দুটি দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় যে কতটা সুন্দর হতে পারে তার উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন শেহওয়্যার-মারিয়া। কখনও শেহওয়ার গাইছেন রোমানিয়ান বিখ্যাত গান, কখনো মারিয়া গাইছেন বাংলায়। এমন সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত থাকুক। আমরা অনেকেই ক্যারিয়ারে কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখলেই নিজেদের শেকড় ভুলতে শুরু করি। শেহওয়্যার এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী উদাহরণ। দেশের বাইরে থাকলেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তার ভাবনার জায়গাটা অনেক বেশি স্বচ্ছ। 

এএ