মানুষ কবে প্রথম আগুন জ্বালানোর কৌশল শেখে, মিললো নতুন ইতিহাস
ছবি: সংগৃহীত
মানবসভ্যতার ইতিহাসে আগুন এক বৈপ্লবিক সংযোজন। কিন্তু আদিম মানুষ ঠিক কবে থেকে এই আগুন জ্বালাতে শিখেছিল? এতদিন আগের সেই ধারণায় বড় ধাক্কা দিয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের নতুন এক গবেষণা। জানা গেছে, প্রচলিত ধারণার চেয়েও বহু বছর আগে আগুন জ্বালানোর কৌশল আয়ত্ত করেছিল আদিম মানুষ।
গবেষকদের মতে, আজ থেকে প্রায় ১০ লাখ বছর আগেও আদিম মানুষ আগুনের ব্যবহার জানত। তবে সেই আগুন তারা নিজেরা জ্বালাতে পারত না; বরং প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট আগুন সংরক্ষণ করে ব্যবহার করত। আগুন জ্বালানো এবং তা প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল তারা রপ্ত করে অনেক পরে। এতদিন গবেষকেরা মনে করতেন, মানুষ আগুন জ্বালাতে শেখে আজ থেকে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে।
বিজ্ঞাপন
তবে সাম্প্রতিক এক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে জানা গেল, ৫০ হাজার বছর আগে নয়, আজ থেকে অন্তত চার লাখ বছর আগে আগুন জ্বালাতে শিখে গিয়েছিল আদিম মানুষ।
লন্ডন থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার উত্তরে বার্নহাম গ্রামে খননকাজ চালানোর সময় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিদর্শনের খোঁজ পান। সেখানে তারা উনুন আকৃতির পোড়া মাটি, তাপে ভেঙে যাওয়া পাথরের কুড়াল এবং পাইরাইট বা আয়রন সালফাইডের দুটি টুকরা খুঁজে পান। এই পাইরাইট এমন এক ধরনের পাথর, যা ঠুকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে দাহ্য বস্তুতে আগুন ধরানো সম্ভব। সাম্প্রতিক এই অনুসন্ধান নিশ্চিত করে যে, ওই এলাকার আদিম অধিবাসীরা আগুন জ্বালাতে এবং তাকে প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ করতে জানত।
বিজ্ঞাপন
এই আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত মানুষের আগুন জ্বালানোর সবচেয়ে প্রাচীন অকাট্য প্রমাণ মিলেছিল ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলে, যা ছিল আজ থেকে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগের। ধারণা করা হতো, আনুমানিক ওই সময় থেকেই মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। কিন্তু ব্রিটেনের এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি প্রায় চার লাখ বছরের পুরনো ইতিহাস ধারণ করছে। অর্থাৎ, এত দিন যা মনে করা হতো, তার চেয়েও অন্তত সাড়ে তিন লাখ বছর আগে থেকে আদিম মানুষ আগুন জ্বালাতে জানত।
আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়েছে আজ থেকে প্রায় তিন লাখ বছর আগে। আগুন জ্বালানোর জ্ঞান তারও আগে থেকে রপ্ত করেছিল আদিমানবেরা। তাছাড়া আধুনিক মানুষের প্রথম আবির্ভাব হয় আফ্রিকা মহাদেশে। আফ্রিকার বাইরে তারা ছড়িয়ে পড়ে আরও অনেকটা সময় পরে। প্রায় এক লাখ বছর আগে পর্যন্ত আফ্রিকার বাইরে আধুনিক মানুষের (হোমো সেপিয়েন্স) কোনো স্থায়ী অস্তিত্ব ছিল না। আনুমানিক ৬০ হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সরা ইউরোপ মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ব্রিটেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন মিলেছে আজ থেকে প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে। অর্থাৎ, আধুনিক মানুষ ছাড়া ‘হোমো’ গণের অন্য কোনো প্রজাতি আগুন জ্বালানোর এই জ্ঞান আয়ত্ত করেছিল।
আদিমানবের ঠিক কোন প্রজাতি প্রথম আগুন জ্বালাতে শিখেছিল, তা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। কারণ, আধুনিক মানুষ ইউরোপে পা রাখার কয়েক লাখ বছর আগে থেকে আদিমানবের বেশ কিছু প্রজাতি সেই মহাদেশে ঘুরে বেড়াত। যেমন– হোমো ইরেক্টাস, হোমো হাইডেলবার্জেনসিস বা হোমো নিয়ান্ডার্থাল (বর্তমানে আধুনিক মানুষ বাদে হোমো গণের সব প্রজাতিই বিলুপ্ত)। ব্রিটেনের বার্নহামে যে সময়কালের প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী পাওয়া গেছে, ওই একই সময়কালে ব্রিটেনের কেন্ট কাউন্টির সোয়ান্সকম্ব এবং স্পেনের আটাপুয়ের্কোয় কিছু জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, যেগুলো নিয়ান্ডার্থালদের জীবাশ্ম। এ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান, সম্ভবত নিয়ান্ডার্থালরাই সেই সময় আগুন জ্বালানো শিখে গিয়েছিল।
এই প্রত্নতাত্ত্বিক দলের নেতৃত্ব দেন লন্ডনের ব্রিটিশ জাদুঘরের প্রস্তর যুগের সামগ্রী সংরক্ষক নিক অ্যাশটন। গত বুধবার ‘নেচার’ জার্নালে তাদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়।
অ্যাশটন বলেন, ‘এটি ৪ লাখ বছরের পুরনো একটি প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল। এখানে আমরা শুধু ব্রিটেন বা ইউরোপেই নয়, বরং বিশ্বের যেকোনো স্থানের তুলনায় আগুন জ্বালানোর প্রাচীনতম প্রমাণ পেয়েছি।’ তবে বার্নহামেই যে আদিম মানুষ প্রথম আগুন জ্বালানোর ক্ষমতা অর্জন করেছিল, এমন সম্ভাবনা কম বলেই মনে করেন তিনি।
ব্রিটেনের ওই প্রত্নতাত্ত্বিক দলের মতে, মানুষ কীভাবে এবং কখন প্রথম আগুন জ্বালাতে শিখেছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। কারণ এর প্রমাণ খুব কমই টিকে থাকে। ছাই এবং কাঠকয়লা সহজেই উড়ে যেতে পারে। এছাড়া কোনটি প্রাকৃতিক আগুন আর কোনটি মানুষের ধরানো; তার পার্থক্য করাও বেশ জটিল।
যেমন– ইসরায়েল, কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় আদিম মানুষের বসতি এলাকায় ৮ থেকে ১০ লাখ বছর আগের আগুনের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। তবে সেগুলো মানুষের জ্বালানো নাকি দাবানল থেকে সৃষ্ট; তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
গবেষকদের দাবি, আদিম মানুষ বজ্রপাত বা অন্য প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট আগুনকে কাজে লাগাতে শুরু করেছিল আনুমানিক সেই সময় থেকেই। কিন্তু সেগুলো ছিল আগুনের অননুমেয় উৎস। তবে বার্নহামের প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী থেকে বোঝা যায়, ওই সময়ে আদিম মানুষ আগুন জ্বালাতে এবং ইচ্ছামতো তা ব্যবহার করতে পারত। এখানে যে সামগ্রীগুলো পাওয়া গেছে, তার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিকভাবে ধরা আগুনের ফলে তৈরি হওয়া বৈশিষ্ট্যের তুলনায় আলাদা।
নমুনাগুলোতে হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি থেকে বোঝা যায়, আগুন পুরো এলাকায় ছড়ায়নি। একটি নির্দিষ্ট অংশে সম্ভবত কাঠ পোড়ানোর ফলে ওই তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়েছিল। পাললিক শিলায় খনিজ পরিবর্তন থেকেও ইঙ্গিত মিলেছে যে, একই অঞ্চলে বারবার আগুন ধরানো হয়েছে।
বিআরইউ