১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ মহাশূন্যে পাঠিয়েছিল। তারপর বিগত ৬৪ বছরে বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশ মহাকাশে পাঠিয়েছে বিভিন্ন ধরনের ১১ হাজার ১৩৯টি কৃত্রিম উপগ্রহ। এই হিসাব ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। আর হিসাবটি দিয়েছে জাতিসংঘের মহাকাশ-বিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওওএসএ)। 

ইউএনওওএসএ-র হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে মহাকাশে মোট ৭৩৮৯টি কৃত্রিম উপগ্রহ ক্রিয়াশীল ছিল। বাকিগুলো হয় বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় পুড়ে গেছে বা পৃথিবীতে টুকরো টুকরো হয়ে পতিত হয়েছে। অথবা মহাকাশবর্জ্য হিসেবে রয়ে গেছে।

ইউএনওওএসএ জানাচ্ছে, মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহের সংখ্যার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাকি দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। এর পরের স্থানগুলো যথাক্রমে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা, কানাডা, জার্মানি ও লুক্সেমবুর্গের দখলে। 

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, চীন এ পর্যন্ত মহাশূন্যে পাঠিয়েছে আনুমানিক চার শতাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ। চীনের মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি করপোরেশনের তথ্যানুসারে, চীনের তিন শতাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ (২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) সক্রিয় আছে। 

চীন নিয়মিত বিরতিতে উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়েই চলেছে। অথচ ১৯৮১ সালে চীনে এই মর্মে বিতর্ক শুরু হয়েছিল যে, দেশ নিজস্ব প্রযুক্তিতে কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করবে নাকি বিদেশ থেকে আমদানি করবে? 

পেইতৌ উপগ্রহব্যবস্থা

বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে যখন ওই বিতর্ক শুরু হয়, তখন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি উন্নয়ন ও উত্পাদনের দুর্বল ভিত্তির কারণে চীন নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে উন্নতমানের যোগাযোগ-উপগ্রহ তৈরিতে সক্ষম ছিল না। এ কথা সত্য যে, ততদিনে (১৯৭০ সালের ২৪ এপ্রিল) চীন তার নিজের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ তুং ফাং হং-১ (Dong Fang Hong-1) বা ‘ডিএফএইচ ১’ (DFHⅠ) মহাশূন্যে পাঠিয়েছে এবং এর পরপরই চারটি সি-ব্যান্ড (C-band) ট্রান্সপন্ডারসমৃদ্ধ যোগাযোগ-উপগ্রহ ‘ডিএফএইচ ২’ মহাকাশে পাঠাতে সক্ষম হয়। কিন্তু ওই কৃত্রিম উপগ্রহগুলো তত্কালে প্রচলিত ২০ থেকে ৩০টি ট্রান্সপন্ডারসমৃদ্ধ অগ্রসর কৃত্রিম উপগ্রহের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। এমনই এক প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছিল- চীন নিজে অগ্রসর কৃত্রিম উপগ্রহ বানাবে, নাকি বিদেশ থেকে কিনবে?

এই প্রশ্নে লম্বা সময় ধরে বিতর্ক চলেছে, আলোচনা হয়েছে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, চীন নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে, নিজেই নতুন প্রজন্মের অগ্রসর যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহ তৈরি করবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চলতে থাকে কঠোর গবেষণামূলক কাজ। অবশেষে সফলতা আসে। 

১৯৯৭ সালে চীন নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ‘ডিএফএইচ ৩’ কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে উৎক্ষেপণে সক্ষম হয়। এই উপগ্রহের ক্যাপাসিটি ছিল কুড়িটি ‘ডিএফএইচ ২’-এর সমান। এই সাফল্যের মাধ্যমে চীনের মহাকাশ গবেষণা উন্নয়নের মহাসড়কে পা রাখে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে উন্নতমানের যোগাযোগ-উপগ্রহ তৈরি করে চীন কোটি কোটি ডলার বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয় করে। পাশাপাশি সরকারি উপগ্রহ যোগাযোগব্যবস্থা খাতেও সাশ্রয় হয় বিপুল অর্থ। 

‘নিজস্ব উপগ্রহ, নাকি আমদানিকৃত উপগ্রহ?’— এই বিতর্ক শুরুর পর তিন দশক কেটে গেছে। মাঝের সময়টাতে আর কখনও এ ধরনের প্রশ্নের উদয় হয়নি। চীন নিজস্ব প্রযুক্তিতে একের পর এক উন্নত থেকে উন্নততর কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করে গেছে। কৃত্রিম উপগ্রহ খাতে গবেষণা তুলনামূলকভাবে অনেক দেরিতে শুরু করেও চীন ইতোমধ্যেই পেছনে ফেলেছে অনেক উন্নত দেশকে। মহাশূন্যে সক্রিয় কৃত্রিম উপগ্রহের সংখ্যার দিক দিয়ে চীনের অবস্থান বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয়। 

চীন মহাশূন্যে বিভিন্ন শ্রেণির কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে ও পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে একটি শ্রেণি হচ্ছে যোগাযোগ-উপগ্রহ। এ ধরনের উপগ্রহের মধ্যে ভূ-সমলয় যোগাযোগ-উপগ্রহ (geostationary communications satellite) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কোনো দেশ উপগ্রহ-যোগাযোগের ক্ষেত্রে কতটা অগ্রসর, তা এ ধরনের উপগ্রহের মান দিয়ে বিবেচনা করা হয়। 

এ ধরনের উপগ্রহের মান দিয়ে একটা দেশের প্রযুক্তির মান ও সার্বিক শক্তিমত্তাও নিরূপণ করা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। বর্তমানে পৃথিবীর নিরক্ষরেখার (equator) উপরে, ভূ-সমলয় কক্ষপথে, চীনের কয়েক ডজন যোগাযোগ-উপগ্রহ সক্রিয় আছে। সর্বশেষ দেশটি মহাকাশে যোগাযোগ উপগ্রহ পাঠিয়েছে গত ২৭ নভেম্বর, যে-উপগ্রহের নাম ‘চায়নাস্যাট ওয়ান-ডি’। এই উপগ্রহগুলো থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে বিশ্বের প্রায় সকল মানুষ।

২০১৭ সালের এপ্রিলে চীন তার প্রথম হাই-থ্রুপুট (high-throughput) যোগাযোগ-উপগ্রহ ‘প্রাকটিস ১৩’ (Practice ⅫⅠ) সফলভাবে উৎক্ষেপণ করে। এই উপগ্রহটির মোট যোগাযোগ-সামর্থ্য ২০জি (20G)। পরে কক্ষপথে সফলভাবে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে, উপগ্রহটির নতুন নাম রাখা হয় ‘চোংসিং ১৬’ (Zhongxing ⅩⅥ)। ২০১৬ সালের ৬ অগাস্ট চীন ‘থিয়ানথুং ১-০১’ (Tiantong Ⅰ-01) উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠায়। এটি চীনের প্রথম সামুদ্রিক উপগ্রহ। এ উপগ্রহ চীনকে ‘উপগ্রহ মোবাইল যোগাযোগ’-এর ‘সেলফোন যুগে’ প্রবেশ করতে সাহায্য করে।

বর্তমানে চীনের ‘পেইতৌ-৩’ ব্যবস্থার ৩৫টি কৃত্রিম যোগাযোগ-উপগ্রহ মহাশূন্যে সক্রিয় আছে। পেইতৌ-৩ ব্যবস্থার প্রথম উপগ্রহটি মহাশূন্যে পাঠানো হয় ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ এবং সর্বশেষটি পাঠানো হয় ২০২০ সালের ২৩ জুন। ‘পেইতৌ-৩’ (Beidou -3) হচ্ছে ‘বৈশ্বিক উপগ্রহ ন্যাভিগেশান ব্যবস্থা’। এটি গড়ে উঠেছে চীনে; চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে।

১৯৯৪ সালে ‘পেইতৌ ১’ যোগাযোগ-উপগ্রহ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল চীনে। পেইতৌ-১ ব্যবস্থার অধীনে উপগ্রহ ছিল মাত্র ৩টি। এই ব্যবস্থা মূলত চীনের ও আশেপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোর বাসিন্দাদের সেবা দিত। ২০১২ সালের শেষদিকে এসে পেইতৌ-১ পরিত্যক্ত হয়। 

এর আগে ‘পেইতৌ ২’ নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। আর ২০০৯ সালে ‘পেইতৌ বৈশ্বিক উপগ্রহ ন্যাভিগেশান ব্যবস্থা’ নিয়ে কাজ শুরু হয়। ২০১২ সালের শেষ দিকে ১৪টি কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে গঠিত হয় একটি নেটওয়ার্ক।  এই নেটওয়ার্ক এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় বিভিন্ন সেবা দিতে শুরু করে। এসব সেবার মধ্যে আছে : পজিশনিং, ন্যাভিগেশান, টাইমিং ও ইউনিক শর্ট মেসেজ সেবা। 

২০১৮ সালের শেষ দিক থেকে ‘পেইতৌ ব্যবস্থা’-র মৌলিক সেবার আওতায় আসে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট দেশ ও অঞ্চলগুলো। বর্তমানে ৩৫টি কৃত্রিম উপগ্রহসমৃদ্ধ ‘পেইতৌ-৩’র সেবার আওতায় এসেছে গোটা বিশ্ব।

মহাশূন্যে চীনের একাধিক আবহাওয়া-উপগ্রহও (meteorogical satellites) সক্রিয় আছে। এই উপগ্রহ-পরিবারের নাম ‘ফাংইয়ুন’(Fengyun)। এগুলো আবহাওয়াসংক্রান্ত সেবা দিয়ে থাকে। ১৯৮৮ সালে এ-পরিবারের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘এফওয়াই ১-এ’ (FY Ⅰ-A) উৎক্ষেপণ করা হয়। আর ২০১৭ সালে উৎক্ষেপণ করা হয় ‘এফওয়াই ৪’ (FY Ⅳ)। আর ২০২১ সালের ২ জুন দিবাগত মধ্যরাত ১২টা ১৭ মিনিটে নতুন একটি আবহাওয়া-উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে চীন। ফাংইয়ুন-৪বি (এফওয়াই-৪বি) নামক কৃত্রিম উপগ্রহটি লংমার্চ-৩বি রকেটের মাধ্যমে মহাশূন্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পাঠানো হয়। এ নিয়ে চীন এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় ডজন আবহাওয়া-উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১০টি কক্ষপথে সক্রিয় আছে। এই উপগ্রহগুলো জলবায়ু পর্যবেক্ষণ ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে থাকে। এ থেকে চীন তথা গোটা বিশ্ব উপকৃত হচ্ছে।

এছাড়াও মহাশূন্যে সক্রিয় আছে চীনের বেশ কয়েকটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ভূ-পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ, রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ ইত্যাদি। এগুলো চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও চীনা জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী উন্নত উপগ্রহ-সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

[চীনের ‘মহাকাশ-গবেষণা’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহীরা অপেক্ষা করুন ‘নয়াচীনের সাফল্যের মুকুটে সাতটি পালক’ শীর্ষক বইটি প্রকাশের। বইটি খুব শিগগিরই বাংলাদেশের বাজারে আসবে। –লেখক]

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)
alimulh@yahoo.com

এইচকে