‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর’ কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে মিলে বলতে হয়, প্রকৃতির অকৃত্রিম, অনাবিল ও অফুরন্ত সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। আর বাংলার এই অবিচ্ছেদ্য সৌন্দর্যের অংশ কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীর হাওর। এই জেলার সব হাওর আকর্ষণীয় স্পট।

এই ভাটির দেশ কিশোরগঞ্জে রয়েছে অসংখ্য হাওর ও বিল। কিশোরগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের মেঘনা, কালনী, ধনু, নরসুন্দা, মুগড়া আর বাওলাই নদী। মনে হবে কোনো চিত্রকর এসে যেন প্রকৃতিকে এমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলা ঘুরে বেড়ানোর জন্য একটি আকর্ষণীয় জায়গা। হাওর এলাকায় সবুজ শ্যামল বাংলার আসল চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়।

এই কিশোরগঞ্জ হাওর ভ্রমণ পর্যটকদের জলজ সৌন্দর্যের স্বাদ প্রাণ ভরে আস্বাদন করতে দেয়। মুগ্ধতার প্রধান বৈশিষ্ট্য যখন জল তখন সর্বোচ্চ উপযোগিতা পাওয়ার একমাত্র সময় হচ্ছে বর্ষাকাল। বর্ষাকালে চারদিকে পানির কলকল ধ্বনি মুগ্ধ করে। যে দিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। হাওরের আয়নায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সাজগোজ দেখার ঝোঁক কোনো ভ্রমণপিপাসু হৃদয় এড়াতে পারে না। দূর-প্রান্তরে কিছু গ্রাম দেখা গেলেও মনে হয় যেন পানির উপরে গ্রামগুলো ভেসে আছে। হাওরে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানোর সময় এখানকার গ্রামের বাড়িগুলো দেখতেও লাগে বেশ সুন্দর। হাওরে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য ও মনোমুগ্ধকর করে। মনে হয় যেন এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই হাওর। বর্ষাকালে স্থানীয় লোকজন বর্ষার এই মনোরম সৌন্দর্যকে কক্সবাজারের মনোরম দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা করে।

কিশোরগঞ্জ হাওরের প্রধান আকর্ষণ

বাংলাদেশ সহ বিদেশের অনেক পর্যটক হাওরটিকে দেখতে বর্ষাকালে প্রায়ই এখানে ভিড় যেন। হাওরে বর্ষা থাকে বছরের ছয় মাস। পানি আসতে শুরু করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। এই পুরো সময় জুড়েই হাওরে পর্যটকদের ভিড় থাকে। তবে ঈদের সময় ভিড় বেশি থাকে।

হাওরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সুবিশাল রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে মোটরবাইক বা অটোরিকশার মাধ্যমে হাওরের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য কাছে থেকে দেখা যায়। বাঁধ বা সড়কে দাঁড়িয়ে হাওর দেখা সাগর দেখার মতোই উপভোগ্য। নদীর জলের ঢেউ রাস্তায় আছড়ে পড়ার কলকল ধ্বনি মনকে উদ্বেলিত করে।

হাওর এর আকর্ষণীয় জায়গা গুলো হলও মিঠামইনে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দহলিজ, নির্মাণাধীন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ সেনানিবাস, মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে চারশত বছরের পুরোনো দিল্লির আখড়াও সে সময়কার থেকে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল গাছ, জিরো পয়েন্ট (ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম সংযোগ সড়ক), ইটনায় অবস্থিত উল্লেখযোগ্য হাওর, শনির হাওর ও ধনপুরের হাওর, অষ্টগ্রামে বিখ্যাত ১৬ শতকের নির্মাণাধীন পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও অষ্টগ্রাম থেকে কিছুটা দূরে হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর, নিকলীতে গুরই শাহী জামে মসজিদ, নিকলী মোহরকোনা বেড়িবাঁধ, পাহাড় খাঁর মাজার, গুরই প্রাচীনতম আখড়া ইত্যাদি।

যেভাবে যাবেন কিশোরগঞ্জ হাওরে

কিশোরগঞ্জে বেশ কয়েকটি রুটে হাওরে যাওয়া যায়। তবে সহজ হলো সায়েদাবাদ বা গোলাপবাগ বা মহাখালী থেকে বাসে সরাসরি কিশোরগঞ্জ যাওয়ার বাসস্ট্যান্ড। ঢাকা থেকে কিছুক্ষণ সময় পর পর কিশোরগঞ্জ উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যায়। কমলাপুর থেকে সকাল ৭টা ১৫ ও ১০ টা ৪৫ এবং সন্ধ্যা ৬ টা ৪০ এ ট্রেনে সরাসরি কিশোরগঞ্জ শহরে। বাসে বা ট্রেনে কিশোরগঞ্জ শহরে আসতে সাড়ে তিন ঘণ্ট থাকে ৪ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে রিকশায় ৫ মিনিট গেলেই একরামপুর। বাসে আসলে গাইটাল বাসস্ট্যান্ড নেমে অটোরিকশার মাধ্যমে একরামপুর আসতে সময় লাগবে ১০ মিনিটের মতো। এখান থেকে অটোরিকশায় বা সিএনজি করে চামড়াঘাট। চামড়াঘাট থেকে ট্রলারে করে মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, ইটনা ও নিকলী ঘুরে আসতে পারেন। তাছাড়া ইচ্ছে করলে মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, ইটনা মহাসড়ক মোটরসাইকেল বা অটোরিকশার মাধ্যমেও ঘুরতে পারেন।

থাকবেন কোথায়

হাওর ভ্রমণ ভালো করে উপভোগ করতে চাইলে দুুদিন সময় নিয়ে বের হতে হবে কমপক্ষে আপনাকে। থাকার জন্য ভালো মানের বেশ কিছু আবাসিক হোটের রয়েছে। মিঠামইনে থাকতে চাইলে মিঠামইনের উপজেলা পরিষদের ডাক বাংলোয়, মিঠামইন বাজারে কয়েকটি উন্নত মানের আবাসিক হোটেল ও গেস্ট হাউজ আছে। তাছাড়া মিঠামইনে প্রেসিডেন্ট রিসোর্টে ও থাকতে পারেন। তবে এর জন্য সেখানে একরাত কাটাতে ন্যূনতম ৮ হাজার টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা লাগতে পারে।

নিকলীতে থাকতে চাইলে সেখানে মোটামুটি মানের কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। যার মধ্যে চেয়ারম্যান গেস্ট হাউজ ও উপজেলা ডাক বাংলো। ইটনা, অষ্টগ্রামে ও ইচ্ছে করলে থাকতে পারবেন। সেখানেও মোটামুটি মানের আরও কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। আরো ভালো পরিবেশ ও ভালো আবাসিক হোটেলে থাকতে চাইলে কিশোরগঞ্জ সদর এ থাকতে পারবেন।

কোথায় খাবেন

মিঠামইন, ইটনা, অষ্টগ্রাম বাজারে উন্নত মানের আরও কিছু হোটেল রয়েছে। সেখানে খেতে পারেন। নিকলীতে হোটেল ক্যাফে আছে, হোটেল সেতু সহ আরও হোটেল পাবেন। হাওরের সবকয়টি হোটেলে হাওরের তাজা মাছের নানা পদ দিয়ে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকায় ভরপেট খেয়ে নিতে পারবেন।

হাওর ভ্রমণের কিছু টিপস

যাদের পানিতে ভয় রয়েছে তারা হাওর ভ্রমণে সময় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করুন। কারণ এটা হাওর। চারপাশে শুধু পানি আর পানি।

১। বর্ষার মৌসুমে প্রচুর ভ্রমণ প্রেমীরা এখানে ঘুরতে আসেন। ভ্রমণের আগে বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে পোশাক নিয়ে আসবেন।

২। আপনি যদি মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন তাহলে ট্রলারে করে নিয়ে যেতে পারবেন। যদি প্রাইভেট কার নিয়ে আসেন তবে সেটি কিন্তু ট্রলারে নিয়ে যাওয়ার সম্ভব না। তবে সেটি রাখার ব্যবস্থা আছে। আর এর জন্য ১৫০ থেকে ২০০ টাকা খরচ হতে পারে।

৩। যারা সাঁতার জানেন না তারা লাইফ জ্যাকেট নিয়ে অবশ্যই পানিতে নামবেন।

৪। ট্রলার বা নৌকায় উঠার আগে হালকা খাবার এবং পানি নিয়ে নিন।

৫। হাওরে রাস্তায় অনেক মোটরসাইকেল চলে তাই, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময় সতর্ক থাকুন।

৬। শিশুদের প্রতি অতিরিক্ত খেয়াল রাখুন।

৭। নৌকায় উঠে অতিরিক্ত লাফালাফি করবেন না।

৮। নৌকায় ভাড়া করার সময় দরদাম করে নিন।

৯। হাওরের পানি পান করবেন না।

১০। মোবাইল, মানিব্যাগ, ক্যামেরা, ড্রোন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সাবধানে রাখুন।