ওপরে নীল আকাশ। আকাশের নিচ দিয়ে সাদা সাদা তুলোর মতো মেঘ বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। কিছু দূর থেকে দেখা যাচ্ছে আকাশে পাখির সারি। গাঙচিল, মাছরাঙা, বক সারি বেঁধে আকাশে উড়চ্ছে। জাহাজ চলছে। সামনে শুধু পানি আর পানি। দুই পাশে অপরূপ প্রকৃতি।

কোলাহল আর যানজটের শহর ঢাকা ছেড়ে যদি এমন পরিবেশে যাওয়া যেত? আর ঢাকায় যদি এমন পরিবেশ তৈরি করা যেত তাহলে কেমন হতো? 

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ অনুসন্ধান অনুযায়ী, দেশে নদীর সংখ্যা ৪০৫টি। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকলে প্রতিটি নদী-খাল হতে পারে একেকটি গুপ্তধন। নদীপাড়ের এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ করে দিলে বাড়বে দেশি-বিদেশি পর্যটকে সংখ্যা। আসবে রাজস্ব। 

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) জানায়, বাংলাদেশে কোলাহলমুক্ত অনেক নদী রয়েছে, যেগুলোতে খুব সহজেই ক্রুজ শিপ পরিচালনা করা যেতে পারে। শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে যদি বাংলাদেশে ক্রুজ পরিচালনা করা যায় তাহলে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা আয় হতে পারে সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে। 

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি নদীতে ক্রুজ পরিচালনা শুরু হয়েছে। এগুলোতে ভালো সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা। 

পদ্মা-শীতলক্ষ্যায় জনপ্রিয় হচ্ছে ক্রুজ

ক্রুজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশে যে কয়েকটি রুটে রিভার ক্রুজ পরিচালিত হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘পদ্মা ক্রুজ’ নামের প্যাকেজটি। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য দিনব্যাপী ও রাতে পদ্মা নদীতে ভেসে পদ্মা ব্রিজসহ আশপাশের পরিবেশ উপভোগের সুযোগ করে দিয়েছে ঢাকা ডিনার ক্রুজ নামের প্রতিষ্ঠানটি। দিনব্যাপী সাড়ে তিন হাজার আর রাতে মাত্র আড়াই হাজারে ঘুরাফেরা, খাওয়া ও বিনোদনের ব্যবস্থা করেছে তারা।

ঢাকার শীতলক্ষ্যা নদীতেও ক্রুজ পরিচালনা করছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শীতলক্ষ্যা ক্রুজগুলোর প্যাকেজের মধ্যে যাত্রীদের সকালে বাড়ি থেকে তুলে ডেমরা ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় ক্রুজ যাত্রা। দুই পাশে নদী দেখাতে দেখাতে নামানো হবে মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়িতে। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় রূপসী গ্রামের ঐতিহ্য জামদানিপল্লীতে। নদীতে গোসল আর মাছ ধরা শেষে বিকেলে পৌঁছে দেওয়া হয় যার যার বাড়িতে। 

এছাড়া আশুলিয়া থেকে তুরাগ নদীর ক্রুজটিও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা থেকে নিজস্ব পরিবহণে যাত্রী নিয়ে আশুলিয়ায় যায়। সেখানে তিন ঘণ্টার মতো ঘুরিয়ে আশপাশের গ্রাম ও চড়ে ঘোরাফেরার সময় দেওয়া হয়। মাছ ধরা ও পানিতে গোসলের ব্যবস্থাও থাকে। দিনব্যাপী এসব ক্রুজের জন্য সর্বনিম্ন ১২০০ থেকে ৩ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। 

রিভার এন্ড গ্রীণ ট্যুরস নামে একটি ট্যুর অপারেটরের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন হেলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রাহকদের জন্য দিনব্যাপী, সান্ধ্যকালীন ও জোসনা রাতে নদীর বুকে ভেসে বেড়ানোর বৈচিত্র্যময় একাধিক প্যাকেজ দিয়ে থাকে পদ্মা ক্রুজ। এই প্যাকেজে যাত্রীরা পদ্মা ব্রিজসহ আশপাশের মনোরম পরিবেশ দেখতে পারেন। একটি ক্রুজে সর্বোচ্চ ৮০ জন যেতে পারেন। করোনাকালীন সময়ের পর থেকে আমরা ক্রুজে অনেক সাড়া পাচ্ছি। অধিকাংশ মানুষই সান্ধ্যকালীন প্যাকেজগুলো বেছে নেন। 

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই রিভার ট্যুরিজম। বাংলাদেশেও সম্ভাবনাময় এই খাত। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পর্যটনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হতে যাচ্ছে এই রিভার ট্যুরিজম। 

জামিল নামে ঢাকা হলিডেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ট্যুর শাখার কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানায়, ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বর্তমানে আরেকটি রুট খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সেটি তুরাগ নদী থেকে সদরঘাট রুট। ক্রুজটি সকাল ৭টা থেকে যাত্রা শুরু করে দুপুরে সদরঘাটে যায়। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টার মতো অবস্থান করে আবার ফিরে আসে তুরাগে। এই যাত্রায় প্রায় ৫ ঘণ্টা পানিতে চলন্ত অবস্থায় থাকে জাহাজ। যাত্রাপথে দেখা মেলে সদরঘাটের ঐতিহ্যবাহী শ্যামবাজার, বাদামতলীর ফলের আড়ত আর আহসান মঞ্জিলের মতো প্রাচীন স্থাপনা। এই ক্রুজের ভ্রমণের খরচ যাত্রী সংখ্যা ও গ্রুপের ওপর নির্ভর করে।

রকেট স্টিমারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রুটে ভ্রমণ

ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা বেশ কয়েকটি রকেট স্টিমারও বাংলাদেশে ক্রুজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সদরঘাট থেকে রকেট স্টিমারগুলো বর্তমানে বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করছে। যেসব নদীপ্রেমীদের গন্তব্যে পৌঁছানোর কোনো তাড়া নেই তারাই বেছে নিচ্ছেন রকেট স্টিমারকে। কারণ, এই রুটে গেলে পানির ওপর ভেসে থাকা যায় প্রায় ১৬-১৭ ঘণ্টা।

বাংলাদেশের সবচেয়ে লম্বা রুটের ক্রুজের প্যাকেজ সম্পর্কে ঢাকা হলিডেজ জানায়, ঐতিহ্যবাহী রকেট স্টিমারে যাত্রার জন্য তিনদিনের প্যাকেজ রয়েছে তাদের কাছে। প্রথমদিনের বিকেলে সদরঘাট থেকে রকেট স্টিমারের ফার্স্ট ক্লাস এসি কেবিনে করে যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হয় বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জে। সেখানে যেতে পানিতে থাকতে হবে প্রায় ১৬-১৭ ঘণ্টা। এরপর মোড়লগঞ্জ থেকে ২ ঘণ্টা গাড়িতে করে নেওয়া হয় খুলনায়। খুলনায় ষাটগম্বুজ মসজিদসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা ঘুরিয়ে তৃতীয় দিন সকালে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় স্টিমারটি। 

সম্প্রতি রকেট স্টিমারে এই প্যাকেজটি গ্রহণ করা ট্রাভেল ব্লগার সাইখ কিফায়াত হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই নৌভ্রমণের অভিজ্ঞতাটা অন্য যেকোনো ভ্রমণের চেয়ে ভিন্ন। এই প্যাকেজে রকেট স্টিমারে চড়ে একইসঙ্গে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, মেঘনা, পদ্মা, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, বাঁশখালী, গাবখান নদী, সন্ধ্যা নদী, কালীগঙ্গা, কাতছা নদী, বালেশ্বর এবং পাঙ্গুচি, অর্থাৎ মোট তেরোটি নদীর বুক চিড়েই মোরেলগঞ্জ পৌঁছায় স্টিমার। এই রুটে সবচেয়ে অসাধারণ অনুভূতি ছিল কীর্তনখোলা নদীতে। নদীর বুকে ছুটে চলা স্টিমারের উপরের একচিলতে ছাদ, আর আলতো শীতের ভোর এক অদ্ভুত তৃপ্তি নিয়ে ধরা দিয়েছিল আমার কাছে।

আগে সদরঘাট থেকে খুলনা পর্যন্ত যেত এই রকেট স্টিমার। প্রায় সাতাশ ঘণ্টার সফর ছিল তখন। তবে নাব্যতা সংকটের কারণে রকেট স্টিমার এখন আর খুলনা পর্যন্ত না গেলেও বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত যায়। মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত এই প্যাডেল স্টিমারে যেতে প্রায় বিশ ঘণ্টা সময় লাগে। 

নতুন আকর্ষণ সাইলেন্ট বোট

যারা একটু শান্তশিষ্ট ও নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করেন তাদের জন্য সাইলেন্ট বোট নিয়ে এসেছে ইকো মেরিন গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা পোস্টকে জানায়, এই ক্রুজে একসঙ্গে ৩০ জন চড়তে পারবে। রয়েছে ৬টি কেবিন, ডাইনিং টেবিল। এটি খুব ধীরে ধীরে পানিতে চলে। মনে হবে যেন পানিতে ভেসে আছে। ইঞ্জিনের কোনো শব্দ নেই, নেই কোনো ভাইব্রেশন বা নাড়াচাড়া।

যাত্রীদের নিয়ে সকাল ৯টায় পূর্বাচলের কাঞ্চন ব্রিজের সামনে থেকে ছাড়বে ক্রুজটি। সেখান থেকে মুড়ারপাড়ার জমিদারবাড়িসহ বেশ কয়েকটি স্পট ঘুরিয়ে ফের কাঞ্চন ব্রিজের পাশে ফিরিয়ে আনা হবে। দুপুরের খাবারের পর সাড়ে তিনটায় গাজীপুরের ঘোড়াশালে বেশ কয়েকটি স্পট ঘুরায় জাহাজটি। রোববার থেকে বৃহস্পতিবার ২৫ হাজার টাকা এবং শুক্র ও শনিবার ৩০ হাজার টাকায় ভাড়া করা যাবে এই সাইলেন্ট বোট।

পাখির চোখে ঢাকার ছবি/ সংগৃহীত

পরিকল্পনা হচ্ছে ঢাকার ও হাতিরঝিল ঘিরে

ইতোমধ্যে ঢাকার নদীগুলোকে প্রাণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এরপর ঢাকার চারপাশে নৌপথ সচল করে ক্রুজের জন্য প্রস্তত করা হবে এগুলোকেও। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর আদি স্রোতধারা বা চ্যানেলের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে তারা। ইতোমধ্যে সংস্থাটি হাতিরঝিলের আদলে মাস্টারপ্ল্যান (খসড়া) তৈরি করেছে। এই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার আদি এই চ্যানেল পুনরুদ্ধার করা হবে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চ্যানেলেও চলতে পারে ক্রুজ। পুরান ঢাকার অনেককিছুই দেখা যাবে এই পথে। তবে ক্রুজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হতে পারে হাতিরঝিল, গুলশান-বনানী লেক এবং তুরাগ নদী। 

বর্তমানে হাতিরঝিলে পারাপারের জন্য ওয়াটার ট্যাক্সির ২০ মিনিটের রাইড থাকলেও এখানেই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নামানো যেতে পারে ক্রুজ। নগরবাসীও নতুন এই বিনোদনের মাধ্যম নিয়ে আগ্রহী। 

এ বিষয়ে অনিমেষ নামে একজন এনজিও কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকার নদী ও লেকগুলোতে যদি আমাদের ঘুরাফেরার ব্যবস্থা করা হয় সেটা অনেক ভালো হবে। কারণ, ঢাকা শহরে সুস্থ বিনোদনস্থলের অভাব অনেক। আমার মতে প্রথমে হাতিরঝিলকে একটা পাইলট প্রোজেক্ট হিসেবে ধরা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমেই হাতিরঝিলের পরিবেশটা ঠিক করতে হবে। পানির ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। তাহলে মনোরম ও লাভজনক হবে হাতিরঝিলের ক্রুজ। 

জাহাঙ্গীর নামে আরেকজন বলেন, ঢাকার অধিকাংশ নদী, খাল ও ঝিলের পানি পরিবর্তন করতে হবে। ময়লা নিষ্কাশন করে গন্ধমুক্ত করতে হবে। ভালো পরিবেশ তৈরি করে ক্রুজ চালু করতে হবে। তবে সরকার চাইলে এখনই বুড়িগঙ্গাসহ কয়েকটি নদীতে ক্রুজ চালু করতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের জাহাজের ভেতর ইন-হাউজ বিনোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাতে বাইরের কোনো দুর্গন্ধ তাদের নাকে না যায়। 

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাবেদ আহমেদ বলেন, এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। ঢাকাকে ঘিরে দুই-একটি প্রতিষ্ঠান ক্রুজ পরিচালনা করছে। তারা ভালো ব্যবসাও করছে। পদ্মাকে ঘিরে মাওয়া আছে। হিলসা রেস্টুরেন্টসহ বেশ কয়েকটি নামীদামী রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। সেটাই নদী কেন্দ্রিক একটা পর্যটন কেন্দ্র হবে বলে মনে হচ্ছে। আমরা নদী কেন্দ্রিক পর্যটনকে প্রমোট করি। আমাদের সঙ্গে বেসরকারি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচারণা চালালে আরও ভালো হবে। 

এআর/এইচকে