জাবির উপ-উপাচার্য পদ ঘিরে কাদা ছোড়াছুড়ি!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) পদটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। এদিকে সম্প্রতি তিনজনের নাম সম্বলিত একটি ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রেরণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপকের নাম রয়েছে বলে নিশ্চিত করে একাধিক সূত্র।
তালিকায় থাকা তিন অধ্যাপক হলেন- অধ্যাপক আবদুল্লাহ হেল কাফি, অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ ও অধ্যাপক বশির আহমেদ।
তিনজনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক নেতা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফি এগিয়ে রয়েছেন বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। যিনি গত বছর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে ৫ম স্থান অর্জন করেন। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে নিজের অবস্থান পোক্ত করার পর উপ-উপাচার্যের তালিকায় তার নাম থাকাতে উপ-উপাচার্যের দৌড়ে তিনি এগিয়ে রয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকেই।
তবে তিনি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হতে না পারেন সেজন্য নানা ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে দাবি করেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক নেতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফি।
সোমবার (৫ জুন) সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের শিক্ষক লাউঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলন তিনি এ দাবি করেন।
এর আগে অধ্যাপক কাফির বিরুদ্ধে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ‘জাবি প্রো-ভিসি’র দৌড়ে যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত শিক্ষক’ ও একটি অনলাইন পোর্টালে ‘জাবির প্রো-ভিসি পদে নিয়োগের আলোচনা ছেয়ে গেছে সমালোচনায়’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ওই সংবাদে ২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল বিভাগের সভাপতি থাকাকালীন এক নারী শিক্ষকে যৌন নিপীড়ন, ১৯৯৬ সালে ইতিহাস বিভাগের এমফিল পর্যায়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় সাভারের এক প্রকৌশলীর স্ত্রীকে যৌন হয়রানি, ২০০০ সালের ২৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে যৌন নিপীড়ন, ডাকাতি, সন্ত্রাসের অভিযোগে এলাকাবাসীর পক্ষে তার বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির মামলা দায়েরের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক কাফি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আমাকে হেয় করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নব্য আওয়ামী লীগার কয়েকজন আমাকে দমিয়ে রাখতে এসব মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।’
এদিকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক (তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক) সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ১৯৯৬ সালের ১৮ এপ্রিল উপাচার্য বরাবর অধ্যাপক কাফির বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইল করার অপচেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেন। সাভারে এক প্রকৌশলীর স্ত্রীকে নিপীড়নের পর অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়। এতে তিনি সাক্ষী হিসেবে জাকসুর তৎকালীন জিএস আজগর হোসেন ও সদস্য আতাউর রহমানকে সুপারিশ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা দুজন লিখিতভাবে জানান এই অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।
এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালের ৮ জুন আতাউর রহমান এবং একই বছরের ৫ অক্টোবর আজগর হোসেন প্রক্টর বরাবর লিখিতভাবে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। উভয়ে তাদের বক্তব্যে অধ্যাপক কাফির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেন।
নিজ এলাকা টাঙ্গাইলে ডাকাতি ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগকে মিথ্যা উল্লেখ করে অধ্যাপক কাফি বলেন, ‘যে অভিযোগ আনা হয়েছিল তা পরবর্তীতে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। এলাকার নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছিলাম আমি। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদও এই ব্যাপারে রায় দিয়েছিলেন যে, আনীত অভিযোগ মিথ্যা। তদন্ত কমিটিও বিন্দুমাত্র সত্যতা পায়নি এসব অভিযোগের।’
নিজ বিভাগের শিক্ষিকাকে যৌন হয়রানির ব্যাপারে অধ্যাপক কাফি বলেন, আমার বিরুদ্ধে নিপীড়নের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমাকে অভিযোগপত্র ও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কোনোটিই দেখানো হয়নি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে হেয় করার জন্য একটি মহল এই অভিযোগ দায়ের করেছিল।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রচলিত নিয়মানুযায়ী ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির পর স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠন করতে হয়। কিন্তু তা করা হয়নি। অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক আমাকে পদাবনতি দেওয়া হয়েছে।’
এর আগে ২০১০ সালের ৫ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের এক বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অধ্যাপক কাফিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশের ৩ (জ) ধারা অনুযায়ী অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত করে অধ্যাদেশের ৪ (১) (ঙ) উপধারা অনুযায়ী সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপক করা হয়।
তবে সিন্ডিকেটের এ সভায় ভিন্নমত প্রদান করেন তিন সিন্ডিকেট সদস্য। তারা হলেন- অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও অধ্যক্ষ ফয়েজ হোসেন। তারা লিখিত বক্তব্যে বলেন, অভিযোগকারী শিক্ষিকা অত্যন্ত অপরিণত ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং তিনি মিথ্যাচারে দ্বিধা করেন না। বিভাগের প্রায় সবার সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ, তিনি অত্যন্ত সন্দেহপ্রবণ এবং অন্যের দ্বারা অনায়াসে প্ররোচিত হন। এ ধরনের অভিযোগকারীর আনীত অভিযোগে শাস্তি প্রদানের আগে তদন্ত কমিটির মূল্যায়ন যাচাই করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তারা।
শিক্ষক নিয়োগে অযোগ্যতার অভিযোগের ব্যাপারে অধ্যাপক কাফি বলেন, আমাকে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। অ্যাডহক নিয়োগে বিভাগীয় চেয়ারম্যান, অনুষদের ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান, অনুষদের ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আলাউদ্দিন স্যার যাচাই-বাছাই করে আমাকে নিয়োগ দেন।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ তোলা হয়। যখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বার্থে আমার কাজ করার সুযোগ হয় তখনই স্বার্থান্বেষী একটি মহল আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনে। এই অভিযোগগুলো মিথ্যা, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণিত। আমি যদি খারাপই হতাম তাহলে এতজন উপাচার্যের আস্থা অর্জন করতে পারতাম? এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে আমি সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ড. মো. খালিদ কুদ্দুস, সহযোগী অধ্যাপক ড. আলী আকবর, সহযোগী অধ্যাপক রনি বসাক, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর ফেরদৌস হোসেন, অধ্যাপক ড. মো. লুৎফুল এলাহী, সহকারী অধ্যাপক ফারজানা আফরোজ ও ফাতেমা-তুজ-জোহরা এবং প্রভাষক সিনজিনা আকতার।
মো. আলকামা/এমজেইউ