ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসহ চতুর্মুখী সমস্যায় জর্জরিত ঢাবির কুয়েত মৈত্রী হল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল যেন চতুর্মুখী সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, আন্দোলন, স্মারকলিপি, হল-টিউটর ও প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিংয়ে আশ্বাস ছাড়া কোনো সমাধান মিলছে না।
হলের চলমান সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে- সিকদার মনোয়ারা ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস, রয়েছে শিক্ষার্থীদের আবাসিক সিট ও বাস সংকট। এ ছাড়া পর্যাপ্ত ওয়াশরুমের অভাব, খাবারের মান নিয়েও আছে প্রশ্ন। সম্প্রতি যোগ হয়েছে বৃষ্টির পানির ভোগান্তি। গত ২১ সেপ্টেম্বর টানা পাঁচ ঘণ্টার ভারী বর্ষণে হলের নিচতলা তলিয়ে যায়। প্রায় ১৬ ঘণ্টা পানি জমে থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল। প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতার এ হলের অবস্থান আজীমপুর কবরস্থানের পেছনে এবং বঙ্গমাতা হলের পাশে। মূল ক্যাম্পাস থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হলটি।
আরও পড়ুন >> ক্যাম্পাসে অশ্লীলতা বন্ধে ঢাবি প্রশাসনের তোড়জোড়
সিকদার মনোয়ারা ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস, রয়েছে শিক্ষার্থীদের আবাসিক সিট ও বাস সংকট। এ ছাড়া পর্যাপ্ত ওয়াশরুমের অভাব, খাবারের মান নিয়েও আছে প্রশ্ন। সম্প্রতি যোগ হয়েছে বৃষ্টির পানির ভোগান্তি। গত ২১ সেপ্টেম্বর টানা পাঁচ ঘণ্টার ভারী বর্ষণে হলের নিচতলা তলিয়ে যায়। প্রায় ১৬ ঘণ্টা পানি জমে থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থীরা
ঝুঁকিপূর্ণ মনোয়ারা ভবনে বসবাস দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর
বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের সিকদার মনোয়ারা ভবনটি ২০০৬ সালে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে হলের প্রকৌশল শাখা। তবুও দীর্ঘদিন ধরে ওই ভবনের অতিথি কক্ষে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী বসবাস করছেন। এ ভবনে ১৫টি অতিথি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে তিনতলায় ১১০ জন এবং দোতলায় ২৪ শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। এ ছাড়া, অতিথি ফি’র নামে দিতে হচ্ছে বছরে চার হাজার টাকা। বাইরে থেকে সুন্দর করে রঙ করা ভবনটি দেখলে বোঝার উপায় নেই এটি ঝুঁকিপূর্ণ। উলটো এ ভবনে টিউটর নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদিকে, আবাসন সংকট নিরসনে ৩০০ শিক্ষার্থীকে অন্য হলে স্থানান্তর এবং পরবর্তীতে সিট কম বরাদ্দ দেওয়ার দাবিতে গত ১৪ আগস্ট ১০৫ শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর নিয়ে একটি স্মারকলিপি উপাচার্যের কাছে দেওয়া হয়। এতে সমাধানের আশ্বাস পেলেও এখনও কোনো সমাধান মেলেনি— অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
আরও পড়ুন >> একাডেমিক রেজাল্ট ভালো মানে ৬০ ভাগ চাকরির প্রস্তুতি সম্পন্ন
জানা গেছে, কুয়েত মৈত্রী হলে সর্বোচ্চ ৬০০ শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতা থাকলেও প্রতি বছর ৩৫০ শিক্ষার্থীকে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। হলের মূল ভবনে কক্ষের সংখ্যা ৮৯টি। এর মধ্যে ৫৭টি কক্ষে বর্তমানে সাতজন করে আসন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। বাকি ৩১টি কক্ষে ছয়জন করে শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। এ ছাড়া, মূল ভবনের পাঁচটি অতিথি কক্ষে গাদাগাদি করে ১০০ শিক্ষার্থী বার্ষিক চার হাজার টাকা দিয়ে অবস্থান করছেন। এত শিক্ষার্থীর জন্য সেখানে মাত্র তিনটি ওয়াশরুম রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণঘোষিত সিকদার মনোয়ারা ভবনের তিনতলায় ১৫টি অতিথি কক্ষ রয়েছে। যেখানে বর্তমানে ১১০ শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। তাদের জন্য মাত্র দুটি ওয়াশরুম এবং দোতলার ২৪ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র একটি ওয়াশরুম।
হলের সিকদার মনোয়ারা ভবনটি ২০০৬ সালে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রকৌশল শাখা। তবুও দীর্ঘদিন ধরে ওই ভবনের অতিথি কক্ষে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী বসবাস করছেন। এ ছাড়া, অতিথি ফি’র নামে দিতে হচ্ছে বছরে চার হাজার টাকা। বাইরে থেকে সুন্দর করে রঙ করা ভবনটি দেখলে বোঝার উপায় নেই এটি ঝুঁকিপূর্ণ। উলটো এ ভবনে টিউটর নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তৃতীয় বর্ষে আছি, এখনও লিগ্যাল সিট পাইনি। এমনকি আমাদের সিনিয়র চতুর্থ বর্ষের অনেক আপুও লিগ্যাল সিট পাননি। ঝুঁকি নিয়েই মনোয়ারা ভবনের গেস্ট রুমে থাকছি। আবার বছরে চার হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটলে প্রাণহানির আশঙ্কাও থাকছে। আমাদের হলের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা সিট পাচ্ছেন না অথচ অন্য হলের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষেই সিট পেয়ে যাচ্ছেন— এটি তো ব্যাপক বৈষম্য।
দীর্ঘদিনের বাস সংকট, সমাধানের আশ্বাসও দেখেনি আলোর মুখ
বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী, বঙ্গমাতা ও সুফিয়া কামাল হলের প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র দুটি বাস বরাদ্দ রয়েছে। তবে, অধিকাংশ সময় মৈত্রী ও বঙ্গমাতা হলের জন্য একটি বাস পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া, সকালে প্রায় সব বিভাগের ক্লাস থাকায় একসঙ্গে একটি বা দুটি বাসে জায়গা হয় না। ফলে পায়ে হেঁটে কিংবা বিকল্প বাহন ভাড়া করে যেতে হয় অনেক শিক্ষার্থীকে।
আরও পড়ুন >> জবির বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের হল ছাড়ার নির্দেশ
বাস সংকটের সমাধানে অনেকবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও নির্বিকার হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আশ্বাস ও বিভিন্ন অজুহাতে আটকা থাকছে সমাধান— অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে আসন সমস্যায় ভুগছি। যাতায়াতেও ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হয়। তিনটি হলের জন্য মাত্র দুটি বাস। অনেক সময় একটি বাস চলাচল করে। বাসে ৪০-৪৫টি সিট থাকলেও অন্তত ৭০-৮০ শিক্ষার্থী যাতায়াত করেন। অনেকে বাসে উঠতে না পেরে ৪০-৫০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে ক্লাসে যান।
টানা বর্ষণে ১৬ ঘণ্টা পানির নিচে হলের নিচতলা
গত বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা থেকে টানা পাঁচ ঘণ্টার বর্ষণে পানিতে তলিয়ে যায় বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের নিচতলা। এতে হলের দোকানে পানি উঠে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হয়। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে হলটি। সারারাত বিদ্যুৎ না থাকা এবং রুমে পানি ওঠায় নিচতলার কিছু শিক্ষার্থী উপরে অবস্থান নেন। ফলে গাদাগাদি করে প্রায় নির্ঘুম রাত পার করতে হয় শিক্ষার্থীদের। ১৬ ঘণ্টা পর পানি নামলে শিক্ষার্থীরা তাদের কক্ষে ফিরে আসেন। এমন সীমাহীন দুর্ভোগেও প্রশাসনকে পাশে পাওয়া যায়নি— অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
নাম প্রকাশ না করে ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী বলেন, ভোগান্তির এমন রাতেও আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পাশে পায়নি। জরুরি অবস্থা মাথায় রেখে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না প্রশাসনের। ওই রাতে মেয়েগুলো তাদের জিনিসপত্র কোথায় রেখেছে, কী খেয়েছে, কোথায় থেকেছে— এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া উচিত ছিল। সন্ধ্যা থেকে পানি যখন বাড়তে শুরু করে তখনও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। রাত ১১টার দিকে পানি রুমে প্রবেশ করে। তখন বাধ্য হয়ে আমরা উপরের তলায় অবস্থান নেই। একজন হাউজ টিউটর এলেও তার একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না। টানা ১৫-১৬ ঘণ্টা আমরা পানিবন্দি, অথচ নির্বিকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মৈত্রী হলের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী নুসরাত আবাসিক সিট সংকট নিয়ে বলেন, ‘সিট নিয়ে আন্দোলনের পর আমরা উপাচার্য স্যারকে এক মাসের সময় দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো অগ্রগতি আমাদের চোখে পড়েনি। আমরা দুবার প্রভোস্ট ম্যাম ও সিট বণ্টন কমিটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তারা জানিয়েছেন, কমিটি হয়েছে, ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া, প্রতি রুমে ছয়জন দেওয়ার কথা থাকলেও এখনও অধিকাংশ রুমে সাতজন করে থাকছেন। এ বিষয়ে প্রশাসনকে বলতে গেলে উলটো বিভিন্ন কথা শুনতে হয়।’
বাস সংকট নিয়ে এ শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলেন, এটি চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। ৪০ সিটের বাসে ৮০-৯০ শিক্ষার্থী উঠছেন। পৃথিবীর কোথাও, এমনকি লোকাল বাসেও এমন চিত্র দেখা যাবে না। তবুও প্রতি ট্রিপে ৮-১০ শিক্ষার্থীকে হেঁটে বা রিকশায় যাতায়াত করতে হচ্ছে। দুটি হলের জন্য একটি বাস থাকায় সমস্যা বেশি হচ্ছে। মাঝখানে একটি বাস বাড়ানো হলেও সেটি এখন চলছে না। যদি ডাবল ডেকার বাস দেওয়া হয় বা ট্রিপ বাড়ানো হয় তাহলে এ সমস্যা দূর হবে। অন্যথায় সম্ভব নয়।
হলের নিচতলায় বৃষ্টির পানি জমে যাওয়া প্রসঙ্গে প্রশাসনের কোনো গাফিলতি ছিল কি না— জানতে চাইলে নুসরাত বলেন, ‘আসলে এখানে তাদের কিছুই করার ছিল না। সিটি কর্পোরেশনের কাজ এগুলো। হলে পানি ওঠায় বাইরে কোমর পানি ছিল। ফলে কেউ ভেতরে আসতে পারেননি। আর ভেতরে যে ম্যাম ছিলেন উনি তদারকি করেছেন। শিক্ষার্থীদের ওপরের তলায় যেতে বলেছেন। পরের দিন প্রভোস্ট ম্যাম এসে সার্বিক বিষয় দেখভাল করেছেন।’
সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নাজমুন নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত মাসের (আগস্ট) ১২ তারিখ উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ডিনসহ সব হলের প্রভোস্টদের সমন্বয়ে একটি স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিং হয়েছে। সেখানে একটি কমিটিও করা হয়েছে। কমিটি প্রতিটি হল থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। সম্প্রতি একটি মিটিংও হয়েছে এ বিষয়ে। আরও একটি মিটিং হবে। মিটিংয়ে সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হবে এবং যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাস সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, বাস সংকট ছিল, সেটি ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে, বাসগুলো নিয়মিত চলছে। কিছুদিন আগেও অনিয়মিত ছিল। গত ১০-১৫ দিন ধরে শিক্ষার্থীরা আমাকে এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ দেয়নি। সমস্যা হলে তারা আমাকে জানাত।
ঝুঁকিপূর্ণ সিকদার মনোয়ারা ভবন প্রসঙ্গে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা জানি ভবনটি পরিত্যক্ত। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেখানে অনেক শিক্ষার্থী বসবাস করছেন। আমাদের আবাসন সংকট রয়েছে, মৈত্রী হলে সেটি একটু বেশি। আমরা হল-প্রাধ্যক্ষদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছি। তারা তাদের প্রয়োজনীয় কাজ করে যাচ্ছেন। তারা রিপোর্ট দিলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
ঝুঁকিপূর্ণ ওই ভবন থেকে শিক্ষার্থীদের অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে কি না— এমন প্রশ্নে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
এমএসএ/এমএআর/