দক্ষিণ ভারতে শিক্ষার প্রদীপ জ্বেলেছে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

১৯১৭ সালের ২৬ এপ্রিল। তারিখটি হায়দ্রাবাদের জন্য বড় একটি ঘটনা। এইদিনে আসাফ জাহী রাজবংশের সপ্তম নিজাম মীর ওসমান আলী খান ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ফরমান বা রয়েল চার্টার স্বাক্ষর করেন। এ অঞ্চলের উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেই তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের সপ্তম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষিণ ভারতে তৃতীয় ও উপমহাদেশের প্রথম ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। এছাড়া ওসমানিয়া উপমহাদেশে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে আঞ্চলিক ভাষা উর্দু চালু করা হয়।
এখানেই শেষ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যেই এখানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট ডিগ্রীর প্রোগ্রাম শুরু হয়।
শুরুর দিকে কোর্সগুলো পড়ানো হতো গান ফাউন্ড্রি নামক একটি জায়গায় থাকা বিভিন্ন ভবন ও ইন্সটিটিউশন থেকে। পরবর্তীতে ১৯২৮ সালে মীর ওসমান আলী খান বারাঙ্গনা ও কবি মাহ লাকা বাঈ চান্দা’র রেখে যাওয়া ২ হাজার ৫শ একর জমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়।
১৯৩৪ সালে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাসের যাত্রা শুরু হয়। এর কয়েক বছর পর পিংক গ্রানাইট পাথরে নির্মিত আইকনিক আর্টস কলেজ বিল্ডিং উদ্বোধন করা হয়।
সবুজ ঘেরা পরিবেশ এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো, বিশাল খেলার মাঠ, আধুনিক জিমনেসিয়াম এবং সুইমিং পুল ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করেছে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাহসিকতার সঙ্গে শিক্ষাসহ অনেকে ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয়দের উচ্চ শিক্ষার পথ বিস্তৃত করেছে।
ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমেও বেশ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। ১৯৬২ সালে সাংবাদিকতায় ব্যাচেলর ডিগ্রী, ১৯৭৮ সালে লাইব্রেরী ও তথ্যবিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী এবং ১৯৮২ সালে বায়োমিডক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক পর্যায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে সুনামের সঙ্গে এ বিশ্ববিদ্যালয় ১২টি অনুষদ পরিচালনা করছে। এরমধ্যে রয়েছে কলা, সমাজ বিজ্ঞান, আইন, শিক্ষা, ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রযুক্তি, বাণিজ্য, ব্যবস্থাপনা, তথ্য বিজ্ঞান, ফার্মেসী ও অরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ।
৫৪টি ডিপার্টমেন্ট, ৫৫৩ জন জন্য শিক্ষক এবং ১ হাজার ৬৪০ জন নন-টিচিং স্টাফ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয় বড় সম্পদ। ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২১টি এ্যাফিলিয়েটেড কলেজ রয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে ৮টি কলেজ, ৫ কনস্টিটুয়েন্ট কলেজ, ৫টি ডিস্ট্রিকট পিজি কলেজ এবং ১৭টি স্বায়ত্ত্বশাসিত কলেজ রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার।
তেলেঙ্গনা স্টেটের চাহিদা অনুসারে ক্লাস রুমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বাহিরেও নন-ফরমাল শিক্ষা ব্যবস্থাও করেছে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। যার মাধ্যমে এই রাজ্য এবং এর বাইরের শিক্ষার্থীরা প্রফেসর জি রাম রেড্ডি ডিসট্যান্স এডুকেশন সেন্টারের মাধ্যমে ২৬টি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ও ডিপ্লোমা কোর্সে অংশগ্রহণ করতে পারে। ফলে প্রত্যেক বছর প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করে।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী। এটি ছোট্ট একটি টিলার উপর অবস্থিত। একে জ্ঞানের সিন্ধু বলা হয়। কারণ এ লাইব্রেরিতে রয়েছে ৬ লাখ বই এবং এরমধ্যে ৬ হাজার ৮শ ২৫ দুলর্ভ পান্ডুলিপি রয়েছে।
পড়ালেখার পাশাপাশি সব ধরনের আন্দোলেনেও এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তেলেঙ্গনা রাজ্যের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবদান চিরস্মরণীয়।
মলিকিউলার বায়োলজি এবং জেনোমিক রিসার্চ সেন্টারের মত ১৫টি আধুনিক গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভিগেশনাল ইলকট্রনিক্স গবেষণা বিভাগ ভারতে প্রথমবারের মতো গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ও জিও অগমেন্টেড নেভিগেশন সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে। যা ভারতে এয়ার ফোর্স এবং সিভিল এ্যাভিয়েশনের সুনির্দিষ্ট কিছু চাহিদা পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ৪৮ ইঞ্চি রিফলেক্টিং টেলিস্কোপ।
এখন পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ৪০টি প্যাটেন্ট রয়েছে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে ১ লাখেরও বেশি বিভিন্ন প্রকার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
সায়েন্স ফ্যাকাল্টি এককভাবে প্রতি বছর ৪শ’র বেশি হাই ইমপ্যাক্ট গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে থাকে। গবেষণা ভিত্তিক বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বিশ্বের কাছ তুলে ধরছে। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ৩৩টি হোস্টেল রয়েছে।
বিভিন্ন প্রকার সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম আয়োজন করার জন্য সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে এখানে একটি অডিটোরিয়ামও রয়েছে। ভারতের ইউজিসি থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় গ্রেডিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এ প্লাস স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি ইউজিসি থেকে সামগ্রীক গবেষণার উন্নয়নের জন্য প্রায় ৫০ কোটি রূপির বাজেট পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
আইকনিক আর্টস কলেজ ও উইমেনস কলেজের স্থাপত্য নান্দনিকতা ধরে রাখার জন্যও স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ভারতের সংবিধানের রূপকার ড. বি আর আম্বেদকারকেও সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী দিয়েছে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
তেলেঙ্গনা রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও সার্বজনীন করার জন্য কাকাতিয়া, মহাত্মা গান্ধী, তেলেঙ্গনা ও পালামুরু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজকে তরান্বিত করে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যালুমনাইদের তালিকায় রয়েছে কিছু বিখ্যাত লোক, তার মধ্যে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিভি নরশিমা রাও, নভোচারী রাকেশ শার্মা, ক্রিকেট কমেন্টটর হার্শা ভোগলে, আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল এন্ড বায়োলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রেসিডেন্ট এ রাভি বেল্লামকোন্ডা, এডোবি সিস্টেমসের বর্তমান সিইও শান্তনু নারায়ন এবং বিখ্যাত গণিতবিদ মোহাম্মদ রাজিউদ্দিন সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে।
বর্তমানে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮১টি দেশের গড়ে প্রায় ৪ হাজারের কাছাকাছি বিদেশী শিক্ষার্থী রয়েছে। ভারতে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ স্নাতক কোর্স ৩ বছরের এবং স্নাতকোত্তর কোর্স ২ বছরের, এছাড়া ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে ১ থেকে ৩ বছরের। বিদেশী শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য আলাদা হোস্টেল সুবিধা রয়েছে।
আইসিসিআর, স্টাডি ইন ইন্ডিয়া ও নিজস্ব অর্থায়নে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-লেখা করার সুযোগ রয়েছ। বিদেশী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত সকল তথ্য পাওয়া যাবে এই ওয়েবসাইটে https://www.oufro.ac.in/, এছাড়া আইসিসিআর ওয়েবসাইট http://a2ascholarships.iccr.gov.in/ ও স্টাডি ইন ইন্ডিয়া স্কলারশিপ পোর্টাল https://www.studyinindia.gov.in/ ।
লেখক
স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত
জার্নালিজম এন্ড ম্যাস কমিউনিকেশন বিভাগ
ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়