দুই লাখ টাকা দিয়েও ঘর পেলেন না জোবেদা

সাভারে সরকারি ঘর ও গভীর নলকূপ দেওয়ার কথা বলে দুর্নীতির মাধ্যমে অসহায়দের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। ঢাকা পোস্টসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত প্রতারণার একাংশ প্রচার করা হলে নতুন প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে চক্রটি।
সম্প্রতি সরকার দেশের অসহায় মানুষদের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এসবের অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, গৃহহীনদের বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া ও ভূমিহীনদের ভূমিসহ গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া।
এত বড় উদ্যোগকেও একটি চক্র ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। আর এই চক্রের প্রতারণার খপ্পরে পড়েছে দুই শতাধিক অসহায় হতদরিদ্র পরিবার। চক্রটি প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা।
চক্রটির মূল হোতা আল-আমিন তার নিজস্ব ফেসবুক আইডিতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রকাশিত সংবাদ। তিনি দাবি করে বলেন, তিনি নাকি সত্য যাচাই-বাছাইয়ে প্রস্তুত। তিনি অপরাধী হলে নিজেই আইনের কাছে সোপর্দ হবেন। যার প্রমাণ মেলে তার ভুয়া নামের ফেসবুক আইডিতে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাভারে প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম। ‘বঙ্গবন্ধু পক্ষাঘাত ও পেশাজীবী পরিষদ’ (বিপিপিপি) নামের একটি সংস্থা খোলা হয়েছে। যার মহাসচিব আল-আমিন। এর আগেও প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে এবার তিনি প্রতারণামূলক সংস্থা খুলে নিয়েছেন ভিন্ন কৌশল।
বিপিপিপি সংস্থাটির সভানেত্রী ঝুমা। তিনি নিজেও প্রতারণা করে প্রায় ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। তবে তিনি দাবি করে বলেন, ৬০ লাখ টাকা নাকি দিয়েছেন সংস্থার মহাসচিব আল-আমিনকে। তারা সবাই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে নিজেকে বাঁচাতে কৌশল হিসেবে মহাসচিবের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন ঝুমা, যার একটি কপি রয়েছে ঢাকা পোস্টের হাতে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সাভার উপজেলা ও আশুলিয়ার দরিদ্র দুস্থ নারীদের বঙ্গবন্ধু পক্ষাঘাত ও পেশাজীবী পরিষদ (বিপিপিপি) ও সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে গভীর নলকূপ ও ঘর দেওয়ার কথা বলে মহাসচিব আল-আমিন আশুলিয়ায় ১৫০টি পরিবারের কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রণতি পালমা, সালমা মেম্বর ও রাহিমার মাধ্যমে। সাভারের বিরুলিয়া থেকে বিরুলিয়ার ইউপি সদস্য সেলিনা বেগম টাকা তুলে দিয়েছেন আল-আমিনকে।
চক্রটির খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে অত্যন্ত কষ্টে দিন পার করছেন বৃদ্ধা জোবেদা। জোবেদা ঢাকা পোস্টকে জানান, তার কাছ থেকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার কথা বলে দুই লাখ টাকা নিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলরের স্ত্রী ও উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নার্গিস বেগম। কিন্তু এক বছরে করে দিতে পারেননি কোনো ঘর।
অপর ভুক্তভোগী জনাব আলী বলেন, তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন সংস্থাটির সভানেত্রী ঝুমা খান। জনাব আলী বলেন, ঘর দিই-দিচ্ছি করে আর দিচ্ছেন না। এখানেও কোনো রকম ঘরেন অস্তিত্ব মেলেনি।
ব্যবসায়ী রউফ বলেন, আমি ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। আমাকেও কোনো কিছুই দেওয়া হয়নি। আমার সঙ্গে আরও তিনজন তিন লাখ টাকা দিয়েছেন। তাদেরও কিছুই দেয়নি।
এ ব্যাপারে নার্গিস বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তিন লাখ টাকা তিনজনের কাছ থেকে নিয়ে ঝুমাকে দিয়েছি। এখন তারা টালবাহানা করছেন। বিষয়টির সুরাহা না হলে আমি আল-আমিনসহ ঝুমার বিরুদ্ধে মামলা করব।
এ ব্যাপারে ঝুমা খান বলেন, আমি ৬০টি পরিবারের কাছে টাকা নিয়ে আল-আমিনকে দিয়েছি। আল-আমিন বলেছেন তিনি নাকি মন্ত্রণালয়ের সচিব। এর মধ্যে ৩৭টি ঘর নির্মাণ সম্পন্ন করে দিয়েছেন আল-আমিন। বাকিগুলো দিচ্ছেন না। প্রতিটি ঘরের জন্য ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা নিয়েছি। আল-আমিনকে দিয়েছি ৬০ হাজার করে। এসবের প্রমাণ আমার কাছে আছে।
অভিযোগের সূত্র ধরে আল-আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট। আল-আমিন সংস্থার কথা স্বীকার করলেও প্রতারণার কথা মানতে নারাজ। অত্যন্ত চতুর আল-আমিনের বিরুদ্ধে যে সহযোগীই অভিযোগ করেন, তাকেই প্রতারক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন বলে জানা গেছে।
তিনি বলেন, একটি ঘর দিতে খরচ হয় ৪ থেকে ৫ লাখ। আমি প্রত্যেক প্রতিনিধির কাছ থেকে ঘরপ্রতি ৩০ হাজার নিয়েছি। কেউ যদি সুযোগ নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে, আমি নিজেই ব্যবস্থা নেব। দুর্নীতির খবর পেয়ে আমি ইতোমধ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। দুদকেও অভিযোগ করেছি। আমি নিজেই ব্যবস্থা নেব। তবে বঙ্গবন্ধু পক্ষাঘাত ও পেশাজীবী পরিষদের কোনো নিবন্ধন আছে কি না, জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি আল-আমিন।
এ ব্যাপারে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম আরা নিপা বলেন, প্রতারণার বিষয়টি খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ঋণগ্রস্ত অসহায় লোকজন প্রতারণার শিকার হয়ে মানবেতর ও চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের দাবি, দ্রুত প্রতারকদের আইনের আওতায় আনা হোক। এবং তাদের ঘর অথবা টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
মাহিদুল মাহিদ/এনএ