মেঘনাতীরে ৩ দিনব্যাপী বাউল মেলা শুরু

‘মনমোহিনী রাধে জয়, রাধে জয়’ টেনে টেনে গাইছেন এক বাউল। সাথেই সতীর্থরা সুর মেলাচ্ছেন। ঢোল, খোল, করতাল আর একতারার সুরে মাথা দোলাচ্ছেন অনেকে। পাশেই মেঘনার জল চকচক করছে চাঁদের আলোতে। জ্বলছে একটি প্রদীপ। চিত্রটি নরসিংদী সদরের কাউরিয়াপাড়া এলাকায় বাউল ঠাকুরের আখড়ার।
বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হয় ৩ দিনব্যাপী এই মেলা। মেঘনাতীরে সাতশ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মেলা চলবে আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
আয়োজকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আনুমানিক ৭০০ বছর আগে নরসিংদীতে এক বাউল ঠাকুর ছিলেন। তিনি নিজেকে শুধু বাউল বলেই পরিচয় দিতেন। এ জন্য বাউল ঠাকুরের প্রকৃত নাম জানেন না এখানকার কেউই। সেই বাউল ঠাকুরের স্মরণে তার আখড়াধামে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই মেলা। তবে কে প্রথম এখানে বাউল মেলার আয়োজন করেন তার প্রকৃত তথ্য জানা নেই কারও।
সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায়, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এই পর্যন্ত মেলার আয়োজন করছেন স্বর্গীয় মনিন্দ্র চন্দ্র বাউলের পরিবার। বর্তমানে এই মেলায় আয়োজকদের মধ্যে রয়েছেন মনিন্দ্র চন্দ্র বাউলের পরিবারের সদস্য সাধন চন্দ্র, মৃদুল বাউল মিন্টু, শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু, মলয় বাউল রিন্টু এবং প্রাণেশ কুমার ঝন্টু।
বাউলের আখড়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় জমিয়েছেন পুণ্যার্থী। বেশিরভাগ সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও অন্য ধর্মের মানুষজনও চোখে পড়ার মতো।
কথা হয় মৌলভীবাজার থেকে আসা পুণ্যার্থী শ্রী সাধন চন্দ্রের সাথে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই এখানে আসা হয়। জীব উদ্ধারের পথ দেখিয়েছেন আমাদের বাউল ঠাকুর। ঠাকুরের দেখানো মানবকল্যাণের এই পথ অনুসরণ করতেই এখানে আসা।’
মাধবদী থেকে এসেছেন হারাধন মল্লিক। তিনি বলেন, ‘আমার ঠাকুরমা, বাবা সবাই এই বাউল ঠাকুরের আখড়ায় আসতেন। আমিও ছোটকাল থেকেই এখানে আসি। এখন আমারও শেষ বয়স, আমার হাত ধরে আমাদের পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যরা আসে। মানসিক শান্তি এবং জগতের সকল জীবের মঙ্গল কামনা করতেই এখানে আসা।’
আখড়ায় গান গাইছিল অর্জুন বাউল। তিনি বলেন, ‘আমাদের গাওয়া গানগুলো সাধারণ বাউলসংগীত না। এগুলো শত শত বছর ধরে চলে আসা মানবতার গান। মানবকল্যাণের নিমিত্তেই আমাদের এসব পরিবেশনা।’
অন্যদিকে, এই মেলাকে কেন্দ্র করে নদীপাড়ের এক কোণে বসেছে চড়কি, নাগরদোলাসহ সাপের খেলার আয়োজন। পাশেই দুই সারিতে শ’খানেক বাচ্চাদের খেলনার দোকান। মাটির পুতুল, হাড়ি, কলসসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র বিক্রি হচ্ছে পুরোদমে। সেই সাথে রয়েছে বিভিন্ন খাবারের সমারোহ।
মেলায় পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন হাজীপুর এলাকার বাসিন্দা বিশ্বজিৎ কুমার সাহা। ছেলে আদিত্য সাহার জন্য কিনছেন মাটির খেলনা। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বেত ও মাটির বিভিন্ন সামগ্রীর সাথে। তিনি বলেন, মেলাটা বহু পুরোনো। প্রতিবছরই পরিবার-পরিজন নিয়ে আসা হয়।
মেলায় ঘুরতে আসা সুভাস দাসের সাথে কথা হয়। তিনি বলেছেন, ‘আসলে মেলাটা এমনই হওয়া উচিত। সবাই শান্তিপূর্ণভাবে ঘোরাঘুরি করছেন। বাচ্চারা নাগরদোলায় দুলছে, অন্যদিকে আশ্রমে আরাধনা চলছে। সব মিলিয়ে বিষয়টা অসাধারণ।’
মেলায় ঘুরতে এসেছে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তধারা নাট্য সম্প্রদায়ের একদল কর্মী। আলাপচারিতায় হাসান মাহমুদ সনেট নামে এক সদস্য বলেন, ‘শুধু সনাতন নয়। সকল ধর্মের মানুষের কাছেই এই মেলার গ্রহণযোগ্যতা আছে। মানবকল্যাণ ও মানবের প্রতি প্রেমের কথা এখানকার বাউলসাধক বলে গেছেন।’
আখড়াবাড়ি এবং মেলার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রাণেশ কুমার ঝন্টু বাউল। তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পৈত্রিকসূত্রে এই মেলার আয়োজন করে আসছি আমরা। আনুমানিক সাতশ বছরেরও অধিক সময় আগে কোনো এক বাউলসাধক এখানে এসে আখড়া স্থাপন করে মানবধর্ম ও মানবকল্যাণের জয়গান গেয়েছেন। সেই থেকে এখানে এই আয়োজন। বুধবার রাতে বৈঠক ও প্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তবে তিনদিনব্যাপী মেলা বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হয়।
রাকিবুল ইসলাম/এমএসআর