রাতের আঁধারে অসহায় মানুষের দরজায় ইউএনও
বিদায় নিলেন ‘মানবিক ইউএনও’ খ্যাত রাজশাহীর তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মাহাতো। বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) তানোরে ছিল তার শেষ কর্মদিবস। গত ১৪ মার্চ তাকে নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় বদলি করা হয়। শেষ কর্মদিবসেও মানুষের সেবা করেছেন তিনি।
গত কয়েকদিন রাতের আঁধারে উপজেলার এতিম, অসহায় ও দুস্থ মানুষের দরজায় কড়া নেড়েছেন ইউএনও। সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো উপহার সামগ্রী।
উপহার নিয়ে ছুটে গেছেন বিভিন্ন এতিমখানা, কওমি মাদরাসা, মন্দির ও গির্জায়। বিদায়ের খবর জানিয়ে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। ইউএনওর এমন কর্মকাণ্ডের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। বিদায়বেলায় মানবিক কাজের জন্য প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।
২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি তানোরে যোগ দেন ৩১তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মাহাতো। শুরু থেকে মানবিক কাজের জন্য সবার প্রিয় হয়ে উঠেন তিনি।
ইউএনওর প্রচেষ্টায় ৪৯ বছর পর নিজের ঠিকানা খুঁজে পান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মুক্তিযোদ্ধা উপজেলার মোহাম্মদপুর আদিবাসীপাড়ার বাসিন্দা নাইকা মার্ডি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাকে ঘর ও জমি দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘ ১০ বছর ধরে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভূমি অফিসে ধরনা দিয়েও বসতবাড়ির ছয় শতক জমি নিজের নামে করাতে পারেননি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ফলে চার সন্তানের ভবিষৎ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় ছিলেন। সংবাদ পেয়ে তার বাড়িতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দুর্যোগ সহনীয় একটি ঘর ও জমি দেওয়ার ঘোষণা দেন ইউএনও সুশান্ত কুমার মাহাতো।
এমন নানা কাজের জন্য জনপ্রিয় তিনি। দাফতরিক কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতেন পথে-প্রান্তরে। তানোরের দুই পৌরসভা ও সাত ইউনিয়নে প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনতেন তিনি। সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িতে দিতেন।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প তদারকি করতেন সুশান্ত কুমার। মুজিববর্ষে দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য নির্মিত ঘর বুঝিয়ে দেন। এসব ঘর নির্মাণকাজ তদারকি করেন তিনি। তার প্রচেষ্টায় ঘর পেয়েছেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মানুষ।
অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত উপজেলা গড়তে চেষ্টা চালিয়েছেন ইউএনও। রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সরকারি খাস জমি উদ্ধার করেছেন। দখল হয়ে যাওয়া কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থাপনার সম্পত্তি উদ্ধার করেন তিনি।
সম্প্রতি তনোর ও মুণ্ডুমালা পৌরসভা নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বপালন করেন সুশান্ত কুমার মাহাতো। নির্বাচনের পরিবেশ সুন্দর হওয়ায় পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছেন ভোটাররা।নির্বাচনের পরিবেশ দেখে সন্তুষ্ট ছিলেন জয়ী ও পরাজিত প্রার্থী।
করোনা প্রতিরোধে সামনের সারিতে ছিলেন ইউএনও। সাধ্যমতো সহায়তা নিয়ে মানুষের দরজায় গেছেন। সচেতনতা বৃদ্ধি; এমনকি করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছেন কঠোরভাবে। একসময় তিনিও করোনায় আক্রান্ত হন। করোনা ধরা পড়ে তার পরিবারের সদস্যদেরও। তবু দমে যাননি। করোনাজয় করে আবার নেমে পড়েন করোনা প্রতিরোধ যুদ্ধে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে দৃঢ় প্রত্যয়ী সুমান্ত কুমার মাহাতো। এজন্য সবার মাঝে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন। উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধির হাতে তুলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বই। ১৩ মার্চ জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নে নিজ হাতে গড়া মাহাতো ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করেন এক হাজার বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বই।
জানতে চাইলে ইউএনও সুশান্ত কুমার মাহাতো বলেন, সরকারের একজন কর্মচারী হিসেবে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিয়ম মেনে পালন করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ বুকে ধারণ করে কাজ করছি। অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করিনি, করব না। সবার দোয়া নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে চাই।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এএম