তিন সন্তানকে খাওয়াতে পারছি না

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তিন নবজাতককে প্রি-নান দুধ খাওয়াতে হচ্ছে। যার এক কৌটার দাম প্রায় এক হাজার টাকা। কিন্তু দরিদ্র আবদুল করিম সারা দিন ভ্যান চালিয়ে যা আয় করেন, তা দিয়ে বাচ্চাদের দুধ কেনা, পরিবারের খাদ্যদ্রব্য ও অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ ও ওষুধ কিনতে পারছেন না। এ অবস্থায় তিনি সচ্ছল ও বিত্তবানদের কাছে আকুতি জানান।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ৮ নম্বর পাগলাকানাই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের চরখাজুরা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল করিম। পেশায় তিনি একজন ভ্যানচালক। তার বাবা মারা যাওয়ার পর বিধবা মা, স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তান নিয়ে একটি টিনের খুপরিতে বসবাস করছেন। স্ত্রী আলোমতি, বড় মেয়ে কণা ও ছোট মেয়ে কণিকা।
সরেজমিনে জানা যায়, একটি ছেলেসন্তানের আশায় করিম দম্পতি আবারও সন্তান নেন। গত ২৪ মার্চ সদর হাসপাতালে আলোমতির কোলজুড়ে আসে তিনটি ছেলেসন্তান। তাদের নাম রাখা হয় আহাদ, আরিফ ও আলিফ। আলোমতি অসুস্থ থাকায় তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। আর নবজাতকদের রাখতে হয়েছে বাড়িতে দাদির কাছে।
সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আবদুল করিম। এদিকে নবজাতক তিনটি সুস্থ থাকলেও আলোমতি এখনো অসুস্থ। একদিকে সন্তানদের দুধ কেনা, অন্যদিকে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন আবদুল করিম।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় আবদুল করিমের। তিনি বলেন, বিয়ের তিন বছরের ব্যবধানে আমার দুটি মেয়েসন্তান জন্মগ্রহণ করে। একটি ছেলেসন্তানের আশায় আবারও আমার স্ত্রী আলোমতি গর্ভধারণ করেন। এবার একসঙ্গে তিনটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন তিনি। কিন্তু ছেলেসন্তানের স্বপ্নপূরণ হলেও অভাবের সংসারে জমজ তিন বাচ্চাকে তিন সন্তানকে খাওয়াতে পারছি না। তাদের খরচ জোগানো আমার পক্ষে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো।
করিম বলেন, আমার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় বাচ্চাদের বুকের দুধ পান করাতে পারছেন না। আবার দোকান থেকে দুধ কিনে এনে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্যও আমার নেই। এই লকডাউনের মধ্যে ভ্যান চালিয়ে তেমন কোনো ভাড়াও পাই না। সরকারিভাবে বা কোনো বিত্তবান যদি আমাকে একটু সাহায্য-সহযোগিতা করেন, তাহলে আমি এই তিন বাচ্চাকে খাওয়াতে পারব।
নবজাতকদের দাদি রহিমা বেগম বলেন, আল্লাহ আমাদের মন পরীক্ষা করার জন্য এই সন্তানদের পাঠিয়েছেন। অনেক বড়লোকের ঘরেও তো দিতে পারতেন। আমরা পরিবারে পাঁচজন খানেওয়ালা। অনেক টাকা দিনাদায়েক (ঋণ) হয়ে অপারেশন করা হয়েছে। বাচ্চাগুলো ভালো আছে কিন্তু তাদের মা এখনো অসুস্থ। বাচ্চাদের বয়স এখন ২৪ দিন। আমার ছেলে না পারছে বাচ্চাদের মুখে খাবার দিতে, না পারছে বউমার চিকিৎসা খরচ চালাতে।
জমজ ভাইদের ছোট বোন কণিকা ঢাকা পোস্টকে বলে, আমার বাবা খুব গরিব, আমার আম্মু খুব অসুস্থ। আজ চার দিন বড়িতে এসেছে আমার আম্মু। আমাদের ভাইয়েরা মায়ের দুধ পায় না, কিনে খাওয়াতে হয়। আমার আব্বু ক্যাম্নে কী করবে?
প্রতিবেশী হালিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করিম একজন অভাবী মানুষ। তার ঘরে দুইটা মেয়ে আছে। এখন আল্লাহ তার ঘরে একসঙ্গে তিনটা ছেলেসন্তান দিয়েছেন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে করিমের বউ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এদিকে তিন সন্তানের প্রতিদিন এক কৌটা করে দুধ কিনে খাওয়াতে হচ্ছে, যার মূল্য প্রায় ১ হাজার টাকা। করিম তার বউয়ের চিকিৎসা করাবেন নাকি তার বাচ্চাদের দুধ কিনে খাওয়াবেন নাকি তার পরিবারের সবার মুখে খাবার তুলে দেবেন, এ নিয়ে অনেক কষ্টে আছেন।
জমজ সন্তানের মা আলোমতি বেগম বলেন, আমার গর্ভে সন্তান আসার পর থেকেই খুব কষ্টে ছিলাম। সিজার (অস্ত্রোপচার) করে বাচ্চা হওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি অসুস্থ থাকায় বাচ্চাদের বাড়িতে রেখে আমাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। বাচ্চাদের দেখার জন্য ১০ দিন পর আমি বাড়িতে এসেছি। আমি এখন অসুস্থ। আমার শাশুড়ি ও দুই মেয়ে মিলে বাচ্চাদের দেখাশোনা করছে। অভাবের সংসারে বাচ্চাদের দুধ কিনে খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে না।
চরখাজুরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ওয়াদুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করিমের ঘরে আল্লাহ জমজ তিনটি ছেলেসন্তান দিয়েছেন। কিন্তু করিমের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি দিন আনে দিন খান। তার ওপর জমজ তিন সন্তান। তাদের প্রতিদিন অনেক টাকার দুধ লাগে। সেই সঙ্গে তার স্ত্রীও খুব অসুস্থ। আমাদের ইউনিয়নের নির্বাচিত মেম্বর-চেয়ারম্যান যদি তার স্ত্রীকে একটি মাতৃত্বকালীন ভাতা করে দিতেন, তাহলে তারা কিছুটা হলেও উপকৃত হতেন। আমাদের সাধ্যের মধ্যে তার উপকার করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আবদুল লতিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এই সংবাদ পাওয়ার পর হাসপাতালে যাই। আমরা ব্যক্তিগতভাবে এবং অফিসের পক্ষ থেকে নগদ টাকা ও চিকিৎসার জন্য সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। এ ছাড়াও যদি কোনো সুযোগ থাকে, তাহলে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব এবং সন্তানদের জন্যও সহযোগিতা করব।
এনএ