পাল্টে গেছে চিরচেনা কাপ্তাই হ্রদ

কাপ্তাই হ্রদের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুনীল আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশি। লুসাই পাহাড় থেকে বয়ে চলা চিরযৌবনা এক বিশাল জলভান্ডার। কিন্তু অনাবৃষ্টি আর দাবদাহে এখন অনেকটাই জৌলুস হারিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই কৃত্রিম হ্রদ।
চলতি মৌসুমে এখনো বৃষ্টি না হওয়ায় হ্রদের পানি শুকিয়ে গেছে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চিরচেনা কাপ্তাই হ্রদ এক অচেনা হ্রদে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছে কাপ্তাই লেক নির্ভর কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন।
কাপ্তাই হ্রদে পানি না থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হ্রদ সংশ্লিষ্ট জীবিকা নির্বাহকারীরা। কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদের ওপর বিশাল জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল। হ্রদে পানি না থাকায় ১ মে থেকে কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা চলমান আছে। মাছ শিকার ছাড়াও হ্রদকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষরাও বেকার সময় পার করছেন।
রাঙামাটি সদরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম নৌপথ। কাপ্তাই হ্রদের মাধ্যমে সদর থেকে বরকল, লংগদু, নানিয়ারচর, জুরাছড়ি, সুবলংসহ বিভিন্ন উপজেলায় যাতায়াত করা হয়। হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়াতে এসব এলাকায় যাতায়াত করা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে লঞ্চ চলাচল।
ছোট নৌকা বা স্পিডবোটে করে গন্তব্যের কয়েক মাইল আগে নেমে তারপর হেঁটে যেতে হচ্ছে মূল গন্তব্যে। তাছাড়া এসব উপজেলায় উৎপাদিত তরমুজ, কাঁঠাল, আনারস, কলাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল এবং বাঁশ, কাঠসহ বিভিন্ন কাঁচামাল রাঙামাটি শহরে আনার একমাত্র মাধ্যম এই হ্রদ। পানি না থাকায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে এসব পণ্য আনতে হচ্ছে। তাতে একদিকে যেমন পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে নষ্ট হচ্ছে পচনশীল দ্রব্য।
কাপ্তাইয়ের বাঁশ ব্যবসায়ী আবুল কাশেম জানান, চলতি মৌসুমে হ্রদের পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় তারা বাঁশ আনতে পারছেন না। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তাদের তিন থেকে চার মাস পানির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই চার মাসে তারা চরম ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এমনকি বাঁশ সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়বে।
কাপ্তাই কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লোকমান আহমেদ বলেন, পানির ওপর নির্ভর করেই আমাদের ব্যবসা। পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের ব্যবসায় ধস নেমেছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে শত শত শ্রমিক।
ইঞ্জিনচালিত বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিছ বলেন, বর্তমানে হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। পানি কমে গিয়ে হ্রদের বিভিন্ন স্থানে চর জেগে উঠেছে। ফলে বোট চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বৃষ্টি না হলে হ্রদের পানি বাড়বে না এবং নৌপথে জড়িত শ্রমিকরাও তাদের কর্মে ফিরতে পারবে না।
হ্রদে পানি না থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন। পানির অভাবে কেন্দ্রের সবগুলো ইউনিট সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জাহের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে একটি ইউনিট চালু রয়েছে। পাঁচটি ইউনিটে দৈনিক ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। কিন্তু পানির অভাবে সচল ইউনিটে বর্তমানে ২২ থেকে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, রুলকার্ভ অনুযায়ী এ সময় হ্রদে পানি থাকার কথা ৮৮.৮৬ ফুট এমএসএল। কিন্তু পানি আছে ৭৬.০৮ ফুট এমএসএল।
এ বিষয়ে কাপ্তাই ইউপি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ বলেন, কর্মহীন হয়ে পড়া খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মে-জুন মাসের খাদ্য সহায়তা এসে পৌঁছেছে। কর্মহীন প্রতি পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে।
এসপি/জেএস