শেরপুরে সরকারি পশু চিকিৎসা পেতে গুনতে হয় বাড়তি টাকা

শেরপুর সীমান্তের প্রান্তিক খামারিরা পাচ্ছেন না প্রাণিসম্পদ বিভাগের বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবা। তাদের অভিযোগ, সরকারি সেবা পেতে তাদের গুনতে হয় বাড়তি টাকা। তাই বাধ্য হয়ে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকদের কাছ থেকে সেবা নিচ্ছেন খামারিরা। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সেবা না পাওয়ার কারণে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে প্রান্তিক খামারিদের মাঝে।
শুধু তাই নয়, সঠিক পরামর্শ ও সহযোগিতার অভাবে অনেক নতুন খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেউ কেউ আবার খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন। সরেজমিন ঘুরে খামারিদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা যায়।
ঝিনাইগাতী উপজেলার আকলিমা খাতুন। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে-মেয়ের সংসারের হাল ধরতে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন পশু লালন-পালন করবেন। পরে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি লালন-পালন শুরু করেন। ছোট পরিসরে শুরু করলেও আজ তার শতাধিক হাঁস, ২০টি ছাগল ও কয়েকটি গরুর মালিক। কিন্তু এই দীর্ঘসময়ে অনেক পশু ও হাঁস-মুরগি অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে হিমশিম খেতে হয়েছে তার। এ বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমি বর্তমানে ১শ বেশি হাঁস পালি। ৮-১০টা ছাগল পালি। ৪-৫টি গরু পালি। কিন্তু এসব অসুস্থ হলেও আমরা কোনোদিনও সরকারি চিকিৎসা পাইনি। সরকারি ডাক্তার আমরা দেখিনি। পশুর অসুখ হলে দেড় মাইল কিংবা দুই মাইল রাস্তা হেঁটে পোলাপাইন ওষুধ আনে। কারণ, আমাদের বিপদ, আমাদেরই দেখতে হবে।

শুধু যে আকলিমা খাতুন তা নয়, জেলার সীমান্তবর্তী প্রান্তিক খামারিদের অনেকের একই অভিযোগ। খামারিরা জানান, সরকারি সেবা নিতে গেলে নানা ধরনের হয়রানি পোহাতে হয় তাদের। আবার পশু হাসপাতালে ভ্যাকসিনের জন্য গিয়ে ভোগান্তির শিকারও হয়েছেন। কোনো সময় ডাক্তারকে হাসপাতাল থেকে আনতে গেলে গুনতে হয় বাড়তি টাকা।
ঝিনাইগাতী উপজেলার খামারি জাকির মিয়া বলেন, প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনগুলো সঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। কিছুদিন আগে আমি ডাক্তারদের বলছিলাম, আমাদের এলাকায় গরুর বাতনা রোগ বাড়ছে এজন্য ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, এই রোগে অনেক গরু মরে গেছে আমাদের এলাকায়। পরে ডাক্তাররা বলল ১৫ দিন পর এই ভ্যাকসিন আসবে, এরপর দুই মাসের বেশি সময় হয়েছে, তা আর আসেনি। আমাদের গরুগুলো ভ্যাকসিন ছাড়াই থাকল, কি আর করমু। আমাদের তো আর কিছু করার নেই। ওই দিনও আমাদের এলাকায় তিনটি গরু মারা গেছে এই রোগে, যদি ভ্যাকসিনগুলো দিতো, তাহলে হয়তো গরুগুলো মরতো না। অন্তত আমাদের সন্দেহতো আর থাকতো না যে বাতনা রোগেই গরুগুলো মারা গেছে।
আরেক খামারি রুবেল মিয়া বলেন, আমাদের গরু অসুস্থ হয়ে পড়লে সরকারিভাবে কোনো তদারকি নেই। পল্লী চিকিৎসক ছাড়া যদি প্রাণিসম্পদ বা ওই অফিসের কোনো লোকজনকে আমরা আনতে গেলে তাদের ফি দিতে হয়। কমপক্ষে ১৫শ থেকে ৩ হাজার টাকা। তারা বলে যে, আমরা সরকারি ডাক্তার। তাই আমাদেরও দিতে হয় সেভাবেই। কিন্তু ফ্রিতে কোনো চিকিৎসা অসম্ভব ব্যাপার।
শ্রীবরদী উপজেলার প্রান্তিক খামারি আবু মিয়া বলেন, আমরা গ্রাম্য মানুষ। আমরা সাধারণত হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল লালন-পালন করি। কিন্তু এরা অসুস্থ হলে আমরা সরকারি কোনো ডাক্তার পাই না। সরকারিভাবে কোনো উপকারও পাচ্ছি না। অসুস্থ হলে পরে স্থানীয় বাজারে পল্লী চিকিৎসক আছে, তাদের কাছেই যেতে হয় আমাদের।

শ্রীবরদী উপজেলার হারিয়াকোনা এলাকার খামারি রহমান মিয়া বলেন, আমার একটি মুরগির খামার ছিল। সেখানে কয়েক প্রজাতির মুরগি পালন করেছি। কিন্তু ভ্যাকসিন নিতে না পারায় অনেক মুরগি মারা যায়। এর কিছুদিন পর খামারটি বন্ধ করে দিয়েছি। এখন আমি ঢাকাতে থাকি।
খামারি আব্দুল আওয়াল বলেন, ভাই কি আর বলমু। শোনেন তাহলে, আমাদের গরু-ছাগল কিংবা হাঁস-মুরগি অসুস্থ হলে পশু হাসপাতালের ডাক্তাররা সাধারণত গ্রামে আসে না। তারা অসুস্থ এসব পশু নিয়ে তাদের অফিসে যেতে বলে। কিন্তু আমার এখানে থেকে প্রাণিসম্পদ অফিস কমপক্ষে ১৪ কিলোমিটার। এখন আপনি বলেন, এই অসুস্থ গরুটি নিয়ে তাদের অফিসে যেতে আমার কত টাকা ভাড়া লাগবে। আমার মতো ছোট খামারির পক্ষে এতো টাকা খরচ করা সম্ভব না।
শেরপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এবিএম আব্দুর রউফ বলেন, প্রত্যেকটা ইউনিয়নের প্রতিটা ওয়ার্ডে কোনো পশু আক্রান্ত হলে আমাদের ভ্যাটেনারি টিম যেতে বাধ্য থাকবে, সেটা আমার নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফিল্ডে যদি নাও যায়, ভ্যাটেনারি সার্জন অবশ্যই ফিল্ডে যাবেন। জনগণের জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে ভ্যাটেনারি সার্জন। সেটা অফিস কিংবা অফিসের বাইরে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য আমি প্রতিটা উপজেলায় দিক নির্দেশনা দিয়েছি।
নাইমুর রহমান/আরকে