সেই দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে

রোমাঞ্চ আর উত্তেজনার মধ্যদিয়ে ঢাকা পোস্টে প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল। অনলাইন সংবাদমাধ্যমের দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতে টিকে থাকা, নতুন কিছু শিখে নিজের জায়গা তৈরি করা, সবকিছুই ছিল চ্যালেঞ্জিং।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে গত চার বছরে অনেক কিছু শিখেছি। সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে পাঠকের মন বুঝতে শেখা। কখনো গভীর রাত পর্যন্ত রিপোর্ট লিখেছি, প্রতিকূল পরিবেশেও সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। সফলতার মুহূর্ত যেমন এসেছে, তেমনি ব্যর্থতার তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি—পাঠকের ভালোবাসা, সহকর্মীদের সমর্থন, এবং সত্যের পক্ষে নির্ভীকভাবে দাঁড়ানোর সাহস। ঢাকা পোস্ট আমাকে শুধু একজন সাংবাদিক নয় বরং একজন সচেতন নাগরিক এবং মানবিক হতে শিখিয়েছে।
এই চার বছর ঢাকা পোস্টের সঙ্গে পথচলা সহজ ছিল না। তবে প্রতিটি সংগ্রাম, প্রতিটি অর্জন আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করছে।
প্রতিনিয়ত অসংখ্য সংবাদ সংগ্রহ করি, লিখি, প্রকাশ করি, কিন্তু কিছু সংবাদ সত্যিই হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। মনে পড়ে, সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারানো ফারুকের কথা। ট্রাক দুর্ঘটনায় একটি পা কাটা গেলেও প্রাণে বেঁচে যান ফারুক। কিন্তু তার পরিবারে নেমে আসে অভাব নামের কালো ছায়া। একটি প্লাস্টিকের (কৃত্রিম) পা লাগাতে চেয়েছিলেন, টাকার জন্য তাও কিনতে পারছিলেন না। তখনি ‘পা হারানো ফারুকের কাটছে দুঃসহ জীবন’—শিরোনামে ঢাকা পোস্টে সংবাদ প্রকাশিত হলে তার স্বপ্ন পূরণ হয়। ফিরে পান নতুন পৃথিবী।
২০২১ সালের ২৪ মার্চ দরিদ্র ভ্যানচালক আবদুল করিমের দুই মেয়ে থাকার পরও তার স্ত্রী একটি ছেলেসন্তানের আশায় আবারও গর্ভধারণ করেন। স্ত্রী আলোমতির কোলজুড়ে আসে তিনটি জমজ ছেলেসন্তান। তাদের নাম রাখা হয় আহাদ, আরিফ ও আলিফ। মায়ের বুকের দুধ না পাওয়ায়, বাজার থেকে দুধ কিনে খাওয়াতে হচ্ছিল । কিন্তু বাচ্চাদের দুধ, পরিবারের খাদ্যদ্রব্য ও অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারছিল না ভ্যানচালক আবদুল করিম। এমতাবস্থায় ‘তিন সন্তানকে খাওয়াতে পারছি না’—শিরোনামে ঢাকা পোস্টে নিউজ প্রকাশ হয়। এরপর ওই পরিবারটির সহযোগিতায় জেলা প্রশাসকসহ সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসেন।
এ ছাড়া, শত শত দুস্থদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে ঢাকা পোস্টে মানবিক খবর প্রকাশের পর সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ এগিয়ে আসে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই মুহূর্তগুলো খুব অনুভব করেছি, মনে হয় সাংবাদিকতার আসল শক্তি এখানেই। সত্য তুলে ধরা এবং মানুষের উপকার করা।
কিছু হৃদয়বিদারক ঘটনারও সাক্ষী হয়েছি, ঝিনাইদহে ট্রাকের ধাক্কায় নসিমনের ছয় যাত্রী নিহত। একইদিনে শৈলকুপায় পৌর নির্বাচনী সহিংসতায় হত্যা এবং কাউন্সিলর প্রার্থীর মরদেহ উদ্ধার। সড়ক দুর্ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যুসহ একই দিনে উপজেলাতে আটজনের মৃত্যু। যা এখনো মনে পড়লে গাঁ শিউরে ওঠে। ওই ঘটনার কিছুদিন পর যশোর থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে কালীগঞ্জ বারবাজার এলাকায় উল্টে যাওয়া বাসে ট্রাকের ধাক্কায় ৯ জন নিহতের ঘটনায় হাজারো মানুষের আহাজারিও দেখেছি।
ঢাকা পোস্ট আমাকে শুধু সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তোলেনি, বরং আমাকে আরও সংবেদনশীল করেছে। অনেক সময় সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত বা সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছি, যার ফলস্বরূপ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। মনে পড়ে, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার ফুলবাড়ি এলাকায় প্রায় দুই বছর ধরে সেতুর একাংশ ভেঙে পড়ে ছিল। চলাচলের জন্য পাশেই বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হলেও সেটি নড়বড়ে ও জরাজীর্ণ থাকায় সাঁকো দিয়ে গরুর গাড়ি, ভ্যান, রিকশা, সাইকেলসহ মানুষ চলাচল করতে পারতো না। এরপর ‘দুই বছর ধরে সেতু ভাঙা, সাঁকো চলাচলের অনুপযোগী’ শিরোনামে ঢাকা পোস্টে ব্রিজের বেহাল দশা নিয়ে প্রতিবেদন করেছিলাম, যা পরে প্রশাসনের নজরে আসে এবং এক মাসের মধ্যে নতুন ব্রিজ নির্মাণ করে দেয়।
এ ছাড়া, ঢাকা পোস্টে যুক্ত হওয়ার পর কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার কথা, তাদের সাফল্যের কথা তুলে ধরেছি। সেই সংবাদগুলো নীতিনির্ধারকদের নজরে পড়েছে। এরপর ফসলের ন্যায্যমূল্য পেতে, সেচের সমস্যা দূর করতে এবং আধুনিক কৃষি উপকরণ পেতে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে অনেক সংস্থা। ঢাকা পোস্টে নিউজ প্রকাশের পর অনেক কৃষক উপকৃত হয়েছেন। এটি শুধু ঢাকা পোস্টের সাফল্য নয়, আমাকেও কৃষিবান্ধব সাংবাদিক হিসেবে সম্মানের জায়গায় স্থান করে দিয়েছে কৃষি বিভাগ।
এই চার বছরে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি, কখনো সময়ের সঙ্গে লড়াই করেছি, কখনো প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তবে প্রতিবারই একটি বিষয় উপলব্ধি করেছি, সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা।
সামনে আরও অনেক পথ বাকি, তবে বিশ্বাস করি, সত্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে গেলে পথচলাটা আরও সুন্দর হবে।
লেখক : আব্দুল্লাহ আল মামুন, জেলা প্রতিনিধি (ঝিনাইদহ), ঢাকা পোস্ট
এএমকে