‘কোনোমতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি’

গত ২৮ ও ২৯ মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে অতিজোয়ার ও অস্বাভাবিক বাতাস রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছে ভোলার সাত উপজেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ও মনপুরা উপজেলার কলাতলী ইউনিয়নের বাসিন্দারা।
রোববার (১ জুন) সরেজমিনে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন ঢালচর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, কার্যত লঘুচাপটি তার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছে এ জনপদে। ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে অসংখ্য বসতঘর। এতে কেউ হারিয়েছেন বসতঘর, আবার অনেকের ঘর এখন বসবাসের অনুপযোগী। এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া হতদরিদ্র পরিবারগুলো।
ঢালচর গ্রামের বাসিন্দা শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. মিলন। স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় বসবাস করে ঢালচরে। পায়ের সমস্যার কারণে ঠিকমতো উপার্জন করতে পারেন না। বর্তমানে ১২ বছরের ছেলের মাছ ধরার উপার্জিত অর্থেই কোনোমতে তার সংসার চলে। গত ২৯ তারিখ দুপুরে জোয়ারের পানি বাড়তে শুরু করে তার বসতঘরের চারপাশে। এর কিছুক্ষণ পর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার বসতঘরের ভেতরে বুকসমান পানিতে আটকা পড়েন তিনিসহ তার পুরো পরিবার। জোয়ারের পানির চাপে তছনছ হয় তার তিনচালা ঢেউটিনের ঘরটি। ভাগ্যের জোরে পুরো পরিবার প্রাণে বেঁচে গেলেও রাজ্যের চিন্তা তার মাথায়। এখন ঠাঁই নিয়েছেন রাস্তার পাশে অন্যের একটি দোকানে।

মো. মিলন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘরের ভেতরেই ছিলাম। হটাৎ পানিবন্দি হয়ে পড়ি, বুকসমান পানি চলে আসে। কোনোমতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে প্রাণ বাচিঁয়েছি। পরে অন্যের ছোট্ট একটি দোকানে আশ্রয় নিই, পানি নেমে গেলে গিয়ে দেখি আমার ঘরটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। ঘরটি মেরামত করার মতো কোনো সামর্থ্য নাই। জানি না কতদিন অন্যের দোকানে আমাদের থাকতে দেবে, তারপর কোথায় থাকব, কিছুই জানি না।’
ভদ্রপাড়া গ্রামের মো. রফিক পেশায় একজন দুধ বিক্রেতা। তার বসতঘরটি এখন ধ্বংসস্তূপ। ঘরের বিভিন্ন মালামাল লাকড়িতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘গত ২৯ তারিখ রাতে বাইরে তুফান চলছিল। ঘরের মধ্যেই ছিলাম এবং ঘরের চারপাশে পানি ছিল। ওইদিন রাতে নদীর ঢেউ আর বাতাস আমার ঘর তছনছ করে দিছে। পরে রাতের অন্ধকারে পানির মধ্যদিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাই।’
ইয়াসনুর বেগম বলেন, ‘স্বামী-সন্তানদের নিয়ে প্রতিদিনের মতো সেদিন রাতেও ঘরে ছিলাম। রাতে বন্যা শুরু হলে নদীর ঢেউ ঘরে আসতে শুরু করলে আমরা পানিবন্দি হয়ে পড়ি। যখন দেখলাম ঘরের অবস্থা ভালো না, তখন আমার স্বামী, ছেলে ও ছেলের স্ত্রী ঘর থেকে বের হয়ে যাই। একটু দূরে যাওয়ার পরই বুঝলাম ঘরটি ভেঙে পড়েছে, কোনোমতে বেঁচে গেছি। পরেরদিন সকালে এসে দেখি অনেক মালামাল ভেসে গেছে, ঘরটি পুরোপুরি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশে আছে। আমার স্বামী মাছ ধরেন, স্বল্প আয়ের সংসারে কীভাবে নতুন করে ঘর তুলব?’
আরও পড়ুন
কিছুদিন আগেই ঘর তুলেছেন মো. সুমন। জোয়ারের পানির চাপে তার ঘর ও ভিটার মাটি চলে গেছে। জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়েছে বেঁড়ার ঢেউটিন ও ঘরের মালামাল। তিনি বলেন, ‘দ্রুত বেগে আমাদের বসতঘরের ভেতরে পানি চলে আসে, চোখের সামনেই দেখেছি, ঘরভিটার মাটি ও মালামাল চলে যাচ্ছে এবং ঘরের ভেতরে গলাসমান পানি। কিছুই করার ছিল না। আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে।’
শুধু মিলন, রফিক, ইয়াসমিন বেগম, সুমন ও সোহানা নয়, নিজেদের শেষ সম্বল বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখন দিশেহারা অন্যান্যরাও। তাদের দাবি, এখন প্রয়োজন সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে দুর্গত হিসেবে জেলায় ৬৪ হাজার মানুষ চিহ্নিত হয়েছে। ৫ হাজার ৩৬৫টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এরমধ্যে ১০৮টি ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আমরা দুর্গতদের ত্রাণের চাল ও শুকনা খাবার দিয়েছি। ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করা হবে।
এদিকে এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে অতিদ্রুত সরকারি সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন তারা।
মো. খাইরুল ইসলাম/এএমকে