বাস ও লঞ্চে অস্বাভাবিক ভিড়, বাড়তি ভাড়া-হয়রানি চরম

ঈদের ছুটি শেষে এবার কাজে ফেরার পালা বাকেরগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতি ইউনিয়নের বাসিন্দা কামাল হোসেনের। চারজনের পরিবার নিয়ে দ্বিগুনেরও বেশি ভাড়া নিয়ে কায়ক্লেশে বরিশাল রূপাতলীতে এসে নামেন। এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে ঢাকার গাড়ির জন্য যাবেন। কিন্তু ছোট্ট এই পথটুকু যেতে কোনো বাহন পচ্ছিলেন না। কামাল হোসেন বলেন, প্রায় একঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি। শত শত থ্রি-হুইলার চোখের সামনে থেকে যাচ্ছে কিন্তু আমরা একটিতেও উঠতে পারছি না। আমার মত এমন শত শত মানুষ থ্রি-হুইলারের অপেক্ষা করছে। কাল অফিস খুলবে। সড়কে আজ অস্বাভাবিক ভিড়।
কামাল হোসেনের স্ত্রী সুইটি বেগম বলেন, রূপাতলী থেকে নথুল্লাবাদ ১৫-২০ টাকা ভাড়া। এখন ৪০/৫০ টাকাও নিচ্ছে। কেউ এসে জিজ্ঞেস করছে না, কেন এমন ভাড়া আদায় করছে।
কামাল হোসেন-সুইটি দম্পতির মতো বিড়ম্বণা উপেক্ষা করে কর্মস্থলে ফেরার যুদ্ধে নেমেছে বরিশাল বিভাগের মানুষ। অতিরিক্ত ভাড়া, সড়ক ও নদী পথে বিশৃঙ্খলা আর যাত্রী হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
শনিবার (১৪ জুন) সকালে রূপাতলী ও নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে এবং এর আগে শুক্রবার বিকেলে বরিশাল নদী বন্দর ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
নথুল্লাবাদে ঢাকাগামী যাত্রী হুমায়ুন কবির বলেন, বাট টার্মিনাল এলাকায় দীর্ঘ যানজট। কয়েকশ গাড়ি যাত্রী নেওয়ার জন্য বিশৃঙ্খলভাবে রাখা হয়েছে। প্রতিটি গাড়িতে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ৫শ টাকার ভাড়া ৮শ থেকে এক হাজার পর্যন্ত নিচ্ছে। গাড়িতে সিট ৪০-৪২টা, অথচ যাত্রী তুলছে ৬০ জনের বেশি। এগুলো দেখার কেউ নেই। অভিযোগ দেওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের টিম খুঁজেছিলাম, পেলাম না। শুধু ৩/৪ জন ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখছি। তাদের বলে তো কোনো লাভ নেই।
এমন চিত্র শুধু নথুল্লাবাদে নয়, দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো বাস টার্মিনালে হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষ। বেশি টাকা না দিলে সিট দেয় না, পেছনে সিট দেয়, নয়তো দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য বাধ্য করে বলে জানান পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে আসা যাত্রী সিফাত। তিনি বলেন, দুটি টিকেট নিলে একজনকে বসার সিট দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে লঞ্চ টার্মিনালেও হয়রানির, ভোগান্তির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমভি শুভরাজ-৯ লঞ্চের যাত্রী ফিরোজ আকন বলেন, ডেকে কোথাও বিছানা পেতে বসার স্থান নেই। সবখানে লঞ্চ স্টাফরা তোশক বিছিয়ে রেখেছে। প্রতিটি তোষকে যেতে ৬শ টাকা চাওয়া হচ্ছে। তোশক সিন্ডিকেটের কারণে আমরা কোথাও বসতে পারছি না।
একই অভিযোগ করলেন সুরভী-৭ লঞ্চের যাত্রী মানিক হাওলাদার বলেন, বাসে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ৫শ টাকার ভাড়া ১ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। টার্মিনালে একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রশাসনের কাউকে দেখলাম না যে কষ্টের কথা বলবো। সেজন্য পরিবার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি লঞ্চে যাবো। এখানে এসে দেখি তোশক বিছিয়ে ৬/৭শ করে টাকা চাওয়া হয়েছে। এখানেও বন্দরের কেউ নেই যে দেখবে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে কিনা কেউ।
এমভি সুন্দরবন-১১ লঞ্চের এক স্টাফ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সারা বছর যাত্রী থাকে না। ডেকে দুই-তিনশ নিয়ে চলাচল করে। তখন লঞ্চ মালিকরা তোশক পাততে দেয় না। ঈদে একটা-দুটা বিছাতে দেয়। কি করবো, আমাদের সর্বোচ্চ বেতন ৮ হাজার টাকা। এই টাকায় সংসার চলে না দেখে বাড়তি আয়ের জন্য তোশক বিছাতে হচ্ছে।
বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা শেখ সেলিম রেজা বলেন, ছুটির শেষ দিনে অতিরিক্ত যাত্রী চাপ হচ্ছে। পন্টুন সংকট থাকায় লঞ্চগুলো নোঙরের জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। যাত্রীরা ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে উঠছে। তা ছাড়া কেউ হয়রানির শিকার হয়েছে, আমরা অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। যাত্রীদের সেবায় বিআইডব্লিউটিএ, নৌপুলিশসহ অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছেন।
বরিশালের জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার রবিউল হাসান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ঈদ-পরবর্তী যাত্রা নিরাপদ করতে জেলা প্রশাসন বরিশালের মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুল হাসান, মাসুমা আহমেদ লুনা ও শাকিল রোখসাইন বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে দায়িত্ব পালন করছেন। গতকালকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের দায়ে তিনটি বাসকে ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আদায়কৃত ৭ হাজার টাকা যাত্রীদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। লঞ্চে যেন কোনো যাত্রী হয়রানির শিকার না হন এজন্য মনিটরিং করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, ঈদ-পরবর্তী যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে জেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএমকে